দিদারুল আলম মজুমদার :
ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং এ আমি যে মুহাম্মদ ইউনুছেরঅবদানের কথা লিখছি তিনি ফেনীর নিভৃত পল্লী ছাগলনাইয়ার চম্পকনগর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী মুহাম্মদ ইউনুছ যিনি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে পারিবারিকভাবে ইসলামী অনুশাসনের উপর ভিত্তি করে বেড়ে উঠেছেন। ছাত্র জীবনে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তিনি এ পথে আরও সমৃদ্ধ হয়েছেন। আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন বলে কুরআনে বর্ণিত নির্দেশের আলোকে তিনি তার ব্যক্তি জীবন ও পরিবারকে তৈরি করার লক্ষ্যে কাজ করেছেন।
সুদ এমন একটা জিনিস যার থেকে নিজে নিজে বাঁচতে চাইলেও সমাজ ও রাষ্ট্রে সুদের কারবার থাকলে তা থেকে বেঁচে থাকা দুষ্কর। কারণ আমাদের জীবন চলার পথে অনেক লেনদেন থাকে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে। নিজের পোশাক আশাক খাওয়া দাওয়া সহ সকল ব্যবহারিক বিষয়াশয় মিলিয়ে যে রিজিকের ব্যবস্থা হয় তার সাথেই হক হালাল জড়িত। দৈনন্দিন জীবনে আয় রোজগার এবং খরচের সাথে হালাল হারাম জড়িত। আমরা মানুষ হিসেবে চালাক হওয়ার কারণে দুনিয়ার জীবনে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে বসি এবং পার পেয়ে যাই। যা মুনকার নাকিরের কারণে আল্লাহর সাথে করা যাবে না আবার ইয়াওমুল হাশরে যখন চোখ হাত-পা নিজেই কর্ম বলে সাক্ষী দেবে তখন অন্য কাউকে দায়ী করে নিজের দায়িত্ব এড়ানো যাবে না। রাসুল (সা.) বলেছেন তোমরা সকলেই দায়িত্বশীল এবং এই দায়িত্ব-কর্তব্য দিয়ে তোমাদের সকলকে জবাবদিহি করতে হবে। আমরা বলে থাকি যে যত বড় জামা পড়ে থাকি, সে তত বেশি সুদের কারবারে জড়িত। কারণ হিসেবে উল্লেখ করি, যে গার্মেন্টসেউক্ত জামা কাপড় তৈরি হয়েছে ওই গার্মেন্টস ব্যাংক লোন নিয়ে চলছে বিধায় সেখানে সুদ জড়িত আছে।
আর আমি একজন মাওলানা হয়ে সুদের বিরুদ্ধে ওয়াজ করেও বেশি সুদে জড়িত লম্বা কাপড়ের তৈরি জুব্বা পড়ে যাচ্ছি। তাহলে এই জুব্বার কারণেও আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। তবে আমি সুদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে যত দূও সম্ভব জনমত তৈরি করেছি। যা রাষ্ট্রের উপর চাপ হিসেবে পরিগণিত হবে এবং রাষ্ট্র আইন করে সুদ বন্ধ করবে বলে আশা করি। এই ধরনের কর্মসূচির ফলে আমরা আল্লাহর কাছে জবাবদিহি থেকে হয়তোবা বেঁচে যেতে পারি না। হয় আল্লাহর পাকড়াও থেকে কোনভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। এই প্রচেষ্টা বাস্তবায়নে মরহুম মুহাম্মদ ইউনুছ ছিলেন সোচ্চার ব্যক্তি। যার প্রচেষ্টায় এই উপমহাদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
অনেকে ধরনা করে থাকেন ইসলামী ব্যাংক প্রচলিত যে কোন একটি ব্যাংকের মতোই। আসলে কি তাই? কেউ জবাব দিয়ে থাকেন- সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল বলে রাসূল (স:) এর হাদিস দিয়ে। বলে থাকেন বিসমিল্লাহ বলে মুরগি জবাই দিলে হালাল হবে এবং বি বিসমিল্লাহ ছাড়া জবাই দিলে হারাম হবে। উপরোক্ত বিষয় সত্য এবং তার উপর আমল করা অবশ্যই কর্তব্য। তবে এই নিয়ত এবং বিসমিল্লাহির সাথে আরও বহু আমল বা কাজ যুক্ত হবে যা ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথেই আমাকে আপনাকে অনেক সংযত হয়ে এবং আল্লাহ প্রেরিত কোরআন এবং শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ(স:) এর হাদিস পাঠের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান থেকে বাস্তবে কাজ করে যেতে হবে।
আরেকটি কথা হচ্ছে ইসলামী ব্যাংক প্রচলিত ব্যাংকগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরকারের নির্দেশিত পথেই চলছে, যাতে লাভ লোকসানের অংশীদারিত্বের কোন নমুনা নেই বলে যে অভিযোগ রয়েছে তা কিন্তু ঠিক। তবে ব্যাংকের প্রাথমিক পর্যায়ে লাভ-লোকসানের অংশীদারিত্ব ওপেন থাকাতে আমরা বাংলাদেশের মানুষ যাতে সবাই লোকসান দেখিয়ে উত্তর ব্যাংকে দেউলিয়াত্বের দিকে নিচ্ছিলাম তখনই সরকারি নীতির পাশাপাশি ব্যাংকটি এক্ষেত্রে কঠিন অবস্থানে যেতে বাধ্য হয়েছে। তাই এখন যাচাই বাছাই করেই লাভ লোকসানের উপর বিষয়টি ব্যাংকের অবস্থান ঠিক রেখে তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এতে যিনি সুবিধা পেয়েছেন তিনি প্রশংসা করে যাচ্ছেন, আর যিনি কোন ধরনের সুবিধা পায়নি তিনি হরহামেশা এই ব্যাংকিং এর সমালোচনা করে যাচ্ছেন, আর বলছেন কিসের ইসলামী ব্যাংক, এটি অন্যান্য ব্যাংকের চাইতে আরো বড় ডাকাত। তাই ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে এসব বিষয়ে আরো ভাবতে হবে এবং ইসলাম উপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ইসলামি ব্যাংকিং আল কোরআন, রাসুল (সা.)-এর কর্মপদ্ধতি এবং যুগে যুগে ইসলামি বিশেষজ্ঞদের বিধিবিধান অনুসরন করে পরিচালিত একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী নতুন ধরনের ব্যাংক। এখানে নামে-বেনামে যেকোনো ধরনের সুদ নিষিদ্ধ। ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে সুদ নির্মূলকরণ, ন্যায়বিচার,দক্ষতা, স্থিতিশীলতা ্এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে কল্যাণমূলক সমাজ গঠন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নবুয়ত প্রাপ্তির আগে হজরত খাদিজা (রা.) এর ব্যবসায় অংশীদারিত্বের (মুদারাবা) ভিত্তিতে যে ব্যবসা পরিচালনা করেন, তার সূত্র ধরেই ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার উৎপত্তি। যদিও তৎকালীন সময়ে ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিকতার ইতিহাস কেমন ছিলো, তা জানা না গেলেও লেনদেনের সমস্ত পদ্ধতি পরিস্কারভাবে জানার মত লিপিবদ্ধ রয়েছে।
বিশ্বে ব্যাংক ব্যবস্থা অনেক পুরোনো হলেও শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার আবির্ভাব পুরোনো নয়। আধুনিক পৃথিবীতে ১৯৫০ সালের শেষ দিকে পল্লী এলাকায় একটি স্থানীয় ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাকিস্তানে প্রথম একটি ইসলামী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু সে উদ্যোগ সফল হতে পারেনি। মিসরের রাজধানী কায়রো থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে নীল নদের বদ্বীপ ’মিটগামারে’ ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সেভিংস ব্যাংক, যা আধুনিক বিশ্বেও প্রথম আনুষ্ঠানিক ইসলামিক ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃত। একে মিটগামার ব্যাংক বলা হয়।ড. আহমদ নাজ্জার ছিলেন এ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৬৩-৬৭ সাল পর্যন্ত শুধু মিসরেই ৯টি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সবকটি ইসলামি ব্যাংক বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার। ১৯৭১ সালে কায়রোতে প্রথম ইসলামী ব্যাংক হিসেবে ‘নাসের সোশ্যাল ব্যাংক’ পুনরুজ্জীবিত হয়।
প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৩ সালেরডিসেম্বরে সৌদি আরবের জেদ্দা শহরে মুসলিম দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের এক সম্মেলনে নিজ নিজ দেশে অর্থনীতি ইসলামিকরণের যে সিন্ধান্ত নেয়া হয়, দেশে দেশে ইসলামি ব্যাংক গঠন তারই ফলাফল। তাছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ কর্মসূচি ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’ এর আওতায় বিভিন্ন মুসলিম প্রধান দেশের সরকার উদারীকরণ নীতির মাধ্যমে প্রথম ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থাকে অনুমোদন দেয়া আরম্ভ করে। এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা সামিয়াল ডারভিশ, আব্বাস মীরাখন ও মহসীন খান। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ৭৫টি দেশে ৬০০টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা চালু রয়েছে এবং প্রায় ৪০০টি শাখাধারী প্রচলিত ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে। আইএমএফ বলছে ‘ইসলামি ব্যাংকিং প্রচলিত পাশ্চাত্য ধারার চেয়ে অধিকতর সুপ্রতিষ্ঠিত এবং সম্পূর্ন দৃষ্টিকোন থেকে এর কার্যকারিতা প্রমান করতে সক্ষম হয়েছে।
১৯৭৪ সালে সেনেগালের রাজধানী ডাকারে ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) চার্টারে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশসহ ২৮টি মুসলিম রাষ্ট্র। অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আইডিবি চার্টারে সই করেন। সৌদি আরবের জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসি সদস্যভূক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ১৯৭৫ সালের ২০ অক্টোবর আইডিবি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের ইসলামি ব্যাংকিং আন্দোলন জোরদার হয়। সনদ অনুযায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিজ নিজ দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং কার্যক্রম ইসলামি শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালনার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। আইডিবি প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যে বিভিন্ন দেশে ২০টির বেশি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭৮ সালে ডাকারে ইসলামি দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে ইসলামি ব্যাংকের সংজ্ঞা অনুমোদিত হয়। বাংলাদেশও আইডিবির এক সদস্য।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ মহসিনদুবাই ইসলামি ব্যাংকের অনুরূপ একটি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য পররাষ্ট্র সচিবের কাছে সুপারিশ করেন ১৯৭৯সালে। এই সুপারিশের আলোকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং উইং ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিমত জানতে চান। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা পরিচালক এএসএম ফখরুল আহসান বিভিন্ন দেশের ইসলামি ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম দীর্ঘ পর্যালোচনা করে ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইতিবাচক সুপারিশ করেন। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে সোনালী, রূপালী, জনতা, অগ্রণীসহ রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের একটি বৈঠক হয়। সেখানে এসব ব্যাংকে ইসলামি শাখা খোলার সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নূরুল ইসলাম বেসরকারি খাতে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকারি, বেসরকারি ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বিভিন্ন সেমিনার ও কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। তখন মাওলানা আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে ইসলামি ইকোনমিক রিসার্চ ব্যুরো প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
সমসাময়িক সময়ে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য। এগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো ওয়ার্কিং গ্রুপ ফর ইসলামিক ব্যাংকিং ইন বাংলাদেশ, বায়তুশ শরফ ইসলামি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ইসলামি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামি ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (দিবা) এবং বিআইবিএম। দীর্ঘ আলোচনা ও পর্যালোচনা শেষে আইডিবির অংশীদারিত্বে কয়েকজন ব্যবসায়ীর উদ্যোগে প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে ১৯৮৩সালের ৩০মার্চ বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম শরিয়া ভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৮৩ সালের ১৩মার্চ ‘কোম্পানি আইন, ১৯১৩-এর অধীনে সীমিত দায় নিয়ে একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত বিশ্বসেরা এক হাজার ব্যাংকের তালিকায় বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ।
সুকুক বন্ড: সূকুক হচ্ছে এক ধরনের ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল সার্টিফিকেট। প্রচলিত সুদ ভিত্তিক বন্ডের বিকল্প হিসেবে ইসলামি ব্যাংকগুলোর জন্য চালু করা হয়েছে সুকুক বন্ড, যা শরিয়াহ শর্তমেনে পুঁজিবাজারে লেনদেন হয়। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ইসলামি ব্যাংকগুলোর জন্য সুকুক বন্ড চালু করেছে। ইসলামি ব্যাংকগুলোর বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণের (এসএলআর) অর্থ বিনিয়োগের জন্য সরকারের ইসলামিক বিনিযোগ বন্ড ছাড়া তেমন কোনো উপকরণ ছিলনা। এটির রেট অব রিটার্ন খুবই কম। সুকুক চালু করা সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। এরই মধ্যে এ বন্ড ছেড়ে আট হাজার কোটি টাকা তহবিল গঠন করেছে সরকার। সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বন্ড বিক্রি করেছে। এ বন্ডের মাধ্যমে ইসলামি ব্যাংকগুলোরও বিনিয়োগের সম্ভাবনা বেড়েছে।
দেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের বর্তমানচিত্র : ইসলামি ব্যাংকিং ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস বর্তমান সময়ে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডো বা শাখার মাধ্যমে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দেশের ৬১ব্যাংকের ১০টি পূর্ণাঙ্গভাবে এবং ৩২টি নানা উপায়ে শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। মোট শাখা হলো ১০হাজার ৭৬৭টি। এরমধ্যে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকের শাখা এক হাজার ৭৭৮টি। ইসলামি ব্যাংকিং চালু করতে ১০টির বেশি আবেদনপত্র বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রয়েছে। দেশে বর্তমানে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক রয়েছে। এগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি., আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লি., আলআরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লি., সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লি., শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লি., এক্সিম ব্যাংক লি:., ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লি., ইউনিয়ন ব্যাংক লি., স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লি., ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।
শাখা ব্যাংকিং করছে এমন ইসলামি ব্যাংক হলো : প্রাইম ব্যাংক ১৯৯৫সালে ‘হাসানাহ ইসলামীব্যাংকিং নামে পাঁচটি ইসলামি ব্যাংকিং শাখা চালুর মাধ্যমে ডুয়েল ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। তার পথ ধরে প্রচলিত ব্যাংকগুলো শাখাভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ইসলামি শরিয়তের মূলনীতি, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত নীতিমালা এবং দেশ-বিদেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের মানদণ্ড ও নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রচলিত ব্যাংকগুলো ইসলামি শাখা ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ১০টি ব্যাংকের ২২টি ইসলামি ব্যাংকিং শাখা রয়েছে। কয়েকটি ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডো কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রচলিত ব্যাংকের একই শাখায় উইন্ডো ভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম সাদিক’ নামে প্রথম চালু করে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশ ২০০৪সালে। পর্যায়ক্রমে বর্তমানে ১৩টি কনভেশনাল ব্যাংকের রয়েছে ২১২টি ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডো।
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্যই রয়েছে এর শাশ্বত নিয়মনীতি ও পথনির্দেশনা। ইসলামি ব্যাংকিং ইসলামি অর্থনীতির একটি অপরিহার্য অংশ। ইসলামী শরীতের নীতিমালাই হলো ইসলামি ব্যাংকিংয়ের মূলনির্দেশিকা। ওয়ান ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকিং সেবা প্রদানের জন্য ২০২০ সালে আল-নূর ইসলামি ব্যাংকিং চালু করে। বর্তমানে সারাদেশের প্রচলিত ১০৫টি মাধ্যমে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকটি। সিটি ব্যাংকও মানারাহ নামে তাদের ইসলামী শাখা চালু করেছে।
বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের বয়স ৪০ বছর হলেও পৃথক আইন বা নীতিমালা এখনও হয়নি। দেশে ইসলামি ব্যাংক চালু হওয়ার এক বছর আগে ইসলামি ব্যাংকিং আইন’ প্রণয়ন করে থাইল্যান্ড।১৯৭৫ সালে পাকিস্তানে ইসলামি ব্যাংকিং শুরু হয়এবং দেশটিতেও পৃথক ইসলামি ব্যাংকিং আইন রয়েছে। আমাদের দেশে৪০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত শরিয়াহ ভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্রমবর্ধমান এ বিকাশ নিঃসন্দেহে দেশ ও জাতির জন্য একটি সুদৃঢ় ও স্থিতিশীল আর্থিক কাঠামো গড়ে তোলার বার্তা দেয়। মজবুত অর্থনীতি ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সহযোগী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ইসলামি ব্যাংকগুলো।
ইসলামি ব্যাংকিংয়ের প্রসারের জন্য ইসলামি মানি মার্কেট ও বন্ড বাজারকে আরও গতিশীল করতে হবে। ইসলামি ব্যাংকিং-সহায়ক শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং গবেষনা ও সহায়ক প্রতিষ্ঠান বাড়াতে হবে। ইসলামি ব্যাংকগুলোর মৌলিক ধারণা ও বুনিয়াদি কর্তব্য তথা দেশের উন্নয়ন বেকারতে ¡দুরীকরণ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও দরিদ্রদের সমৃদ্ধি আনয়ন করা গেলে দেশে টেকসই অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা করা যায়।
মুহাম্মদ ইউনুছ ২০২২ সালে ইন্তেকাল করার পর তার স্মরণে ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারের নাম ইউনুছ অডিটোরিয়াম রাখা হয়েছে। যার মাধ্যমে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মরহুম মোঃ ইউনুছকে ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থনীতি সংক্রান্ত চিন্তাধারা এবং কর্মসূচিগুলোকে সজাগ করে তুলেন। ইউনুছ মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট নামে একটি ট্রাষ্ট গঠনের মাধ্যমে আমরা আমাদের ব্যক্তি জীবনকে সুদ মুক্ত অর্থ ব্যবস্থায় পরিচালন পদ্ধতি শিখতে ও কিছু চ্যারিটি ওয়ার্ক নিয়মিত করণ এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরিচালনা করতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
লেখক : সভাপতি, ইউনুছ মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট।