মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম :
প্রত্যেক মুমিনেরই কাম্য জান্নাত। আল্লাহ তা’য়ালা জান্নাতে যাওয়ার পথও আমাদেরকে বাতলে দিয়েছেন। আর তা’হলো সিরাতুল মুস্তাকিম। এ পথে গমন করতে হলে কিছু কর্ম করা আবশ্যক। মহানবী সা. নির্বিঘ্নে জান্নাতে যাওয়ার কতিপয় সহজ আমল বলে দিয়েছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন সালামা (রা) বলেন, যখন মহানবী সা. মদীনায় আগমন করেন, আমিও মদীনায় আসলাম। অত:পর আমি যখন তাঁর পবিত্র চেহারা মোবারকের দিকে দৃষ্টিপাত করলাম, তাঁর চেহারা মোবারক দেখে আমি বুঝলাম যে, তিনি মিথ্যাবাদী নন। তিনি সর্বপ্রথম যে কথা বলেন, তা’হলো হে মানুষেরা! ১. তোমরা বেশী বেশী করে সালাম দাও। ২. অনাহারী (গরীব, মিসকীন, এতিম) কে খানা খাওয়াও। ৩. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখ। (কোন কিছুর মাধ্যমে না পারলে সালাম দিয়ে হলেও আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখ)। ৪. রাত্রের ঐ অংশে নামায পড়, যখন মানুষেরা নিদ্রায় মগ্ন থাকে। অত:পর নির্বিঘ্নে জান্নাতে প্রবেশ কর (তিরমিযী, ইবন মাজাহ; দারেমী; মিশকাত হাদীস নং- ১৯০৭)।
অপর হাদীসে রয়েছে মহানবী সা. একদা প্রশ্ন করেন, ১. আজ কে রোযা রেখেছে? হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) বলেন- আমি। রাসূল সা. আবার প্রশ্ন করেন, ২. আজ কে জানাযায় অংশ গ্রহণ করেছে? হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) বলেন- আমি। রাসূলুল্লাহ সা. আবার প্রশ্নে করেন, ৩. আজ মিসকীনকে কে খাদ্য দান করেছে? হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) বলেন- আমি। মহানবী সা. পূণরায় প্রশ্ন করেন, ৪. আজ কে রোগীর সেবা করেছে? হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) বলেন- আমি। অত:পর মহানবী সা. বলেন- যার মধ্যে এগুলো একত্রিত হয়েছে সে অবশ্যই জান্নাতে যাবে (সহীহ মুসলীম)।
অপর হাদীসে মহানবী সা. বলেছেন- ১. আল্লাহর ইবাদত কর, ২. অনাহারীকে খাদ্য দাও, ৩. সালাম প্রচার কর, ৪. অত:পর নির্বিঘ্নে জান্নাতে প্রবেশ করো (তিরমিযী, মিশকাত হাদীস নং- ১৯০৮)। হাদীস ত্রয়ের মাধ্যমে জানা গিয়েছে যে, জান্নাতে যাওয়ার আমল হলো- ১. সালাম দেওয়া, ২. অন্যকে খানা খাওয়ানো, ৩. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, ৪. শেষ রাত্রে উঠে নামায পড়া, ৫. নফল রোজা রাখা, ৬. জানাযায় অংশ গ্রহণ করা, ৭. রোগীর সেবা করা, ৮. আল্লাহর ইবাদত করা।
সালাম : সালাম ইসলামের একটি উত্তম আমল। সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সুদৃঢ় হয়। জনৈক সাহাবী মহানবী সা. -কে জিজ্ঞেস করেন- ইসলামের কোন আমলটি সবচেয়ে উত্তম। তিনি প্রত্যুওরে বলেন- অন্যকে খানা খাওয়ানো এবং পরিচিত ও অপরিচিত সকলকে সালাম দেয়া (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হাদীস নং- ৪৪২২)। সালামের মাধ্যমে ভালবাসা বৃদ্ধি পায়। রাসূল সা. বলেন, মু’মিন হওয়া ছাড়া কেউ জান্নাতে যাবে না, আর পারস্পরিক ভালবাসা ছাড়া মু’মিন হওয়া যাবে না। আমি কি তোমাদেরকে বলবো কিসের ফলে তোমাদের মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টি হয়? তা’হলো সালাম দেয়া (মিশকাত পৃষ্ঠা- ৩৯৭)।
অন্যকে খানা খাওয়ানো : অন্যকে খাওয়ানোর মত পূণ্য কোন কিছুতে নেই। গরীব-মিসকীনকে খাদ্য দানে আল্লাহ তা’য়ালা বেশী খুশি হন। মহানবী সা. বলেছেন- যে ব্যক্তি পেটভরে আহার করল অথচ তার প্রতিবেশী অনাহারে রাত্রি যাপন করল সে মু’মিন নয় (মিশকাত)।
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা : মহানবী সা. বলেছেন- আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না (মিশকাত, পৃষ্ঠা- ৪১৯)। তিনি আরো বলেন- যে ব্যক্তি নিজ রিযিকের মধ্যে প্রশস্ততা পেতে চায় এবং নিজ আয়ূ দীর্ঘায়িত করতে চায়, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রেখে চলে (সহীহ বুখারী, মিশকাত পৃষ্ঠা ৪১৯)।
শেষ রাত্রে উঠে নামায পড়া : নফল নামাযের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ফযীলতপূর্ণ নামায হলো শেষ রাত্রের নামায তথা তাহাজ্জুদের নামায। রাসূলুল্লাহ সা. তার উপর এ নামায ফরয ছিল। তিনি শেষ রাত্রে স্বীয় স্ত্রীগণ নামাযের জন্য ডেকে দিতেন। সাহাবীগণের মধ্যেও রাত্রের নামাযের প্রচলন ছিল। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- তারা শষ্যা ত্যাগ পূর্বক তাদের প্রতিপালককে ডাকে আশায় ও আসংকায় (সূরা সাজদা- ১৬)। রাসূল সা. বলেন- তোমাদের উচিত শেষরাত্রে নামায পড়া। কারণ এটি তোমাদের পূর্ববর্তী সকল পূন্যবান মানুষের নিয়মিত আমল। এ নামায তোমাদেরকে তোমাদের প্রভূর সান্নিধ্যে পৌঁছিয়ে দেয়, গুনাহ সমূহ দূরীভূত করে দেয় এবং পাপাচার থেকে বিরত রাখে (জামি তিরমিযী, মিশকাত পৃষ্ঠা- ১০৯)।
নফল রোজা রাখা : মহানবী সা. অধিক পরিমানে নফল রোযা রাখতেন। নফল রোযা রাখার অভ্যাস সাহাবায়ে কেরামের মধ্যেও বেশী ছিল। তিনি সোমবার ও বৃহস্পতিবার এবং প্রতিমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ তথা আইয়্যামে যিযের রোযা, আশুরার ও যিলহজ্জের রোযা রাখতেন। সবচেয়ে বেশি রোযা রাখতেন শাবান মাসে।
জানাযায় অংশ গ্রহণ করা : মহানবী সা. বলেছেন- এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের ছয়টি হক রয়েছে। তা’হলো- তার সাথে সাক্ষাত হলে সালাম দেয়া। দাওয়াত দিলে দাওয়াতে অংশ গ্রহণ করা। কল্যাণ কামনা করলে কল্যাণ কামী হওয়া। হাঁচি দিলে হাঁচির জবাব দেয়া। অসুস্থ হলে সেবা-শুশ্রƒতা করা। মুত্যুবরণ করলে তার জানাযায় অংশ গ্রহণ করা (সহীহ মুসলিম)।
রোগীর সেবা করা : অসুস্থের সেবা-শুশ্রƒষা করা সুস্থদের কর্তব্য। আল্লাহ তা’য়ালা মানব সেবায় বেশী খুশি হন। মহানবী সা. বলেন- বিচার দিবসে আল্লাহ তা’য়ালা বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ ছিলাম, তুমি আমার সেবা করনি। মানুষ বলবে- হে প্রভূ! আমরা কিরূপে আপনার সেবা করবো। আপনিই জগতের প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দাহ অসুস্থ ছিল, অথচ তুমি তার সেবা-শুশ্রƒষা করনি। তার সেবা-শুশ্রƒষা করলে আমাকে করা হত, আমার কাছে এর পূণ্য পেতে (মুসলিম, রিয়াদুস সালেহীন পৃষ্ঠা- ৩৫৪)।
আল্লাহর ইবাদত করা : মহানবী সা. হযরত মুয়ায (রা)-কে বললেন- হে মুয়ায! তুমি কি জান, বান্দার উপর আল্লাহর হক কী? আর আল্লাহর উপর বান্দার হক কী? হযরত মুয়ায (রা) বলেন- আল্লাহ ও রাসূল সা. -ই অধিক জ্ঞাত। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন- বান্দার উপর আল্লাহর হক হলো আল্লাহর ইবাদত করা এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক না করা, আর আল্লাহর উপর বান্দার হক হলো- তাকে শাস্তি না দেয়া অর্থাৎ জান্নাত দান করা (সহীহ-বুখারী ও মুসলিম)।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ।