দৈনিক ফেনীর সময়

ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক পবিত্র ঈদুল আজহা

ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক পবিত্র ঈদুল আজহা

মোজাম্মেল হোসেন

হে রাসুল (সাঃ) আপনি বলুন, নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কুরবানী এবং আমার জীবন-মৃত্যু একমাত্র মহান আল্লাহর জন্য। (সুরা আনআম-১৬২) মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুইটি। একটি ঈদুল ফিতর, অন্যটি ঈদুল আজহা।প্রতিবছরের ন্যায় এবারও মুসলিম বিশ্বে সমাগত পবিত্র ঈদুল আজহা। আর কয়েকদিন পরে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে মুসলমানরা এই দিনটি ভীষণ উৎসাহ, উদ্দীপনা ও আনন্দের সাথে উদযাপন করবে। এটি আবার কুরবানির ঈদ নামেও সমধিক পরিচিত।

ঈদ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো খুশি বা আনন্দ। তবে ‘ঈদুল আজহা’ একটি আরবি বাক্যাংশ। যার অর্থ হলো ত্যাগের উৎসব। সর্বশক্তিমান মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি পরম শ্রদ্ধা, ভক্তি, এবং আনুগত্যের শীর নত করার উৎসব ঈদুল আজহা। তাছাড়া পারস্পরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের অন্যতম মাধ্যম এ ঈদ। সব ভেদাভেদ ভুলে ত্যাগ ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে মিলিত হয় মুসলিম বিশ্ব । বিশ্বের প্রতিটি মুসলিমের কাছে ঈদ অত্যন্ত খুশি এবং আনন্দ ভাগ করে নেয়ার উৎসব। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সামর্থ্য অনুযায়ী কুরবানি করা আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলমানদের জন্য ঐতিহাসিক নিদর্শন। কুরবানির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, অতএব আপনি আপনার পালনকর্তার উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কুরবানি করুন’। (সূরা কাওসার-২)

আবার আরবি ভাষায় ঈদ শব্দটি সাধারণত দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়- প্রথমত,আনন্দ-খুশি। অপরটি হচ্ছে, বারবার হাজির হওয়া, ফিরে আসা। ঈদ প্রতি বছর আনন্দের পয়গাম নিয়ে হাজির হয় প্রতিটি মুসলিমের দোরে। আবার

আরবি ‘আজহা’ শব্দের অর্থ- ত্যাগ স্বীকার করা, কুরবানি করা প্রভৃতি। অতএব ঈদুল আজহার অর্থ হলো আল্লাহর জন্য নিজের সবকিছু ত্যাগ ও কুরবানি করার মানসিকতা বা চেতনাকে জাগ্রত করা। পশু জবেহ করার মাধ্যমে মনের পশুত্বকে কুরবানি দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রচেষ্টাই ঈদুল আজহার মূল উদ্দেশ্য।

সমগ্র সৃষ্টির একমাত্র রব মহান আল্লাহ তায়ালা। তিনি আমাদের একমাত্র ইলাহ। এ বিশ্ব চরাচরে যা কিছু আছে সবকিছুই তিনি আমাদের উপকারার্থে সৃজন করেছেন। না চাইতে এতোসব কিছু যিনি দিলেন সে মহান রবের প্রতি আমাদের ভালোবাসা কেমন তা যাচাই করে নেয়ার জন্যই তিনি কুরবানির বিধান দিলেন। মানুষ তাঁর পরিবার-পরিজনের সুখ সমৃদ্ধির জন্য নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিতে প্রস্তুত এমনকি জীবনটাও উৎসর্গ করতে রাজি। কিন্তু আল্লাহর দেয়া অসংখ্য নিয়ামাতের শুকরিয়া কিভাবে আদায় করি তিনি তা দেখতে চান এবং আমরা কতোটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত তা যাচাই করে নিতে কুরবানি নামক এ পরীক্ষার আয়োজন। এজন্য কুরবানির গুরুত্ব অনেক।

কুরবানির উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাকওয়া অর্জন। তাছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ উপহার অথবা যার নামে কোন কিছু উৎসর্গ করা হয়, তিনিই সেটা ভোগ করবেন এটাই সরল কথা। কিন্তু কুরবানি এবং আল্লাহর নামে উৎসর্গকৃত অন্য কিছুর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। যে আল্লাহর জন্য পশু উৎসর্গ করা হয়, তিনি তা স্পর্শও করেন না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন- ‘আল্লাহর কাছে কুরবানির পশুর রক্ত-মাংস কিছুই পৌঁছে না, পৌঁছে কেবল তোমাদের তাকওয়া’ (সুরা হজ্জ-৩৭)

বরং কুরবানি দাতা নিজেই তা ভোগ করেন এবং আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের মাঝে বণ্টন করেন। এটাও মহান আল্লাহরই নির্দেশ। আল্লাহ কখনো মানুষের বাহ্যিক কাজকর্ম দেখেন না। তিনি দেখেন আমাদের অন্তরে খোদা ভীতির গভীরতা। কে, কোন উদ্দেশ্যে, এবং কেন কুরবানি করছে? তা তিনি ভালো করেই জানেন। যাপিত জীবনে মানুষের অন্তরের পশুত্বকে দূর করে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহ লাভ করাই হলো কুরবানির শিক্ষা। এজন্য কুরবানির অন্যতম মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে মনের পশুত্ব ও আমিত্বকে হত্যা করে মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করা এবং একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু আজ তাকওয়ার চেয়ে মাংসলোভীর সংখ্যাই অনেক বেশি। দুর্নীতি, সুদ,ঘুষ, মানুষকে ঠকিয়ে, প্রতারণা করে টাকার পাহাড় বানিয়ে সে টাকায় মস্ত একটা গরু কিনে কুরবানি দিলে কয়েক মণ গোশত হয়তো পাওয়া যাবে ঠিকই, কিন্তু আল্লাহর রহম এবং করুণা হতে বঞ্চিত হতে হবে এটা নিশ্চিত। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-

মনের পশুরে কর জবাই,

পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই।

কশাই! এর আবার কোরবানি! (শহীদি ঈদ)

কিন্তু কয়জনে আমরা এমন কুরবানি করতে পারি। কারণ এই পশু কুরবানি সম্পূর্ণ রূপক। আল্লাহর পথে ত্যাগই ঈদুল আজহার আসল শিক্ষা। আল্লাহর নামে পশু কুরবানি করে তা মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেয়াকে কখনোই দান বলে না বরং তা হলো ত্যাগ। জাতীয় কবি নজরুল তাঁর ‘ঈদজ্জোহা’ কবিতায় লিখেছেন-

চাহি না ক’ গাভী দুম্বা উট,

কতটুকু দান? ও দান ঝুট।

চাই কোরবানী, চাই না দান।

রাখিতে ইজ্জৎ ইসলামের

শির চাই তোর, তোর ছেলের,

দেবে কি? কে আছ মুসলমান?

আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যে কেউ আল্লাহর নামে কুরবানি করে তাঁর জন্য সীমাহীন পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাসুল (সা:)। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘হে মানব সকল! জেনে রাখ, প্রত্যেক পরিবারের পক্ষ থেকে প্রত্যেক বছরই কুরবানি করা আবশ্যক।’ (আবু দাউদ ও নাসাঈ)

হযরত ইবনু উমর (রাঃ) বলেন, মহানবী (সাঃ) মদিনায় দশ বছর অবস্থান করেছেন এবং প্রতিবছরই কুরবানি করেছেন। (তিরমিজি)। রাসুল (সাঃ) আরো বলেন, কুরবানির দিন কুরবানি করাই সবচেয়ে বড় ইবাদত। তবে সে কুরবানি হতে হবে একান্ত আল্লাহর জন্য। কুরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে সওয়াব দান করা হয়। কুরবানির পশুর রক্ত জবেহ করার সময় মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। (মিশকাত)

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায় হযরত ইবরাহিম (আঃ) এর আনুগত্য পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে স্বপ্নযোগে নির্দেশ দিলেন, তুমি তোমার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর জন্য কুরবানি করো। এই আদেশ পেয়ে হযরত ইবরাহিম (আঃ) প্রথমে দশটি উট কুরবানী করলেন। কিন্তু তিনি পুনরায় একই স্বপ্ন দেখেন। অতঃপর ইবরাহিম (আঃ) এবার ১০০টি উট কুরবানি করেন। এরপরেও তিনি যখন একই স্বপ্ন দেখলেন তখন চিন্তিত হলেন এবং ভাবলেন, আমার কাছে তো এই মুহূর্তে প্রিয়বস্তু বলতে আমার প্রাণধিক প্রিয় পুত্র ইসমাইল ছাড়া আর কিছুই নেই। তখন তিনি পুত্র ইসমাইলকে কুরবানী করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে আরাফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। স্নেহের পুত্র হযরত ইসমাইল ছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। স্নেহ-মমতায় ভরা পার্থিব জীবনে পিতার পক্ষে আপন পুত্রকে কুরবানি দেওয়া অসম্ভব এক অগ্নিপরীক্ষা। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশের কাছে শুকরিয়ার মস্তক অবনত করে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) নিঃসংকোচে আপন পুত্রকে কুৃরবানী দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ইসমাইলের গলদেশে চুরি চালিয়ে ঈমানের সে অগ্নি পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন হযরত ইবরাহিম (আঃ)।

কবি কাজী নজরুল খুব চমৎকার করে এবং সাহসী কণ্ঠে উচ্চারণ করছেন-

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ-বোধন!

দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহে খাম্ খা ক্ষুব্ধ মন!

ধ্বনি ওঠে রণি’ দূর বাণীর,

আজিকার এ খুন কোরবানির!

দুম্বা-শির রুম-বাসীর!

শহিদের শির সেরা আজি! -রহ্ মান কি রুদ্র নন?

ব্যস! চুপ খামোশ রোদন! (কোরবানি)

মহান আল্লাহর একান্ত ইচ্ছায় ছুরির নিচে প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল এর পরিবর্তে কুরাবানি হয়ে যায় একটি দুম্বা। যা দেখে বিস্মিত হন হযরত ইবরাহিম (আঃ)। এই প্রতীকী ঘটনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির পরিপূর্ণ আনুগত্য ও ত্যাগ স্বীকার।

ঈদুল আজহার আরো শিক্ষা হলো মহান মালিকের সন্তুষ্টি লাভের আশায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত থাকা। পশু কুরবানি হয় কেবল প্রতীকী অর্থে। প্রকৃত অর্থে কুরবানি দিতে হয় মানুষের লোভ-লালসা, কাম-ক্রোধ, জাগতিক মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতাসহ অন্ততরে লুকায়িত সব পশুত্বকে। হালাল পথে উপার্জিত অর্থ দিয়ে ক্রয় করা পশু কুরবানির মাধ্যমেই এ মহৎ উদ্দেশ্য সম্পন্ন করতে হয়। লোক দেখানো বা অহংকার প্রকাশ পায় এমন কোন ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো কুরবানির এই মর্মবাণী আজ আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। ত্যাগের মহিমার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে প্রদর্শনেচ্ছা, ভোগবিলাস ও অপচয়। তখন ঐশ্বরিক আদেশ ও আধ্যাত্মিকতাকে ছাপিয়ে যায় বস্তুগত ও বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা। ত্যাগের মহিমার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে রসনা বিলাস ও ভোজন উৎসব।

জাতীয় কবির ভাষায়, ‘তোরা ভোগের পাত্র ফেলরে ছুঁড়ে, ত্যাগের তরে হৃদয় বাঁধ’। আল্লাহর জন্য মানুষ তাঁর সর্বোচ্চ ত্যাগ করবে এটাই কুরবানির শিক্ষা। কুরবানির শিক্ষায় সুদৃঢ় হোক আমাদের সামাজিক বন্ধন। পরস্পর মান অভিমান, হিংসা-বিদ্বেষ, ভুলে ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হউক ঈদ আনন্দে। জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে ফিরে আসুক সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও মানবতাবোধের শিক্ষায় পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করে সমাজের গরিব, অসহায় ও দুস্থ মানুষদেরকে ঈদ আনন্দ উদযাপনের সুযোগ করে দেয়া ইসলামের সার্বজনীন শিক্ষা এবং এটাই ইসলামের মূল সৌন্দর্য।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক (বাংলা)।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!