দৈনিক ফেনীর সময়

দুর্নীতির আর্থ-সামাজিক স্বীকৃতি; বেনজীর-মতিউরগংরা এখন সরকারের দায়

দুর্নীতির আর্থ-সামাজিক স্বীকৃতি; বেনজীর-মতিউরগংরা এখন সরকারের দায়

‘এই দুর্নীতিবাজদের যদি খতম করতে পারেন তা হলে বাংলাদেশের মানুষের শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ দুঃখ চলে যাবে। এত চোরের চোর, এই চোর যে কোথা থেকে পয়দা হয়েছে তা জানি না। পাকিস্তান সব নিয়ে গিয়েছে কিন্তু এই চোর তারা নিয়ে গেলে বাঁচতাম। এই চোর রেখে গিয়েছে। কিছু দালাল গিয়েছে, চোর গেলে বেঁচে যেতাম’।

স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধুর শেষ ভাষণ এটি। বঙ্গবন্ধুর সেই আফসোস করা দেশ ও বাস্তবতার মাঝেই আমাদের বসবাস। এখানে দুর্নীতি এখন লতাপাতায় একটি নেটওয়ার্কে যুথবদ্ধ। এই ইন্ডিভিজ্যুয়াল দুর্নীতি মাঝেমধ্যে এক্সিডেন্টালি ফাঁস হয়ে যায়। সেটাকে জায়েজ বা ভুলিয়ে দেয়ার নানা আয়োজন তৈরি করাই থাকে। ফাঁকে কয়েকটা দিন একটু ভয় বা জ্বালাতনে থাকতে হয় মাত্র। সাবেক পুলিশ প্রধান (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য সামনে আসায় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের এই গোত্রের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন আতঙ্কে আছেন। অপকর্মের তথ্য ফাঁস হওয়া ঠেকাতে তারা নানা দিকে চেষ্টাতদ্বির ও সমীহ করে চলছেন পুলিশ, কাস্টমস ও প্রশাসনের পাশাপাশি অন্যান্য ক্যাডারের বেনজীররা।

বেনজীর, আসাদ মিয়া, মতিউরদের ঘটনা সামনে আসায় বেশি অস্থিরতা পুলিশ ও কাস্টমসে। প্রশাসন-প্রকৌশল সংক্রান্ত বিভিন্ন দপ্তরের ঊর্ধ্বতনরাও আতঙ্কে। কারণ এসব সংস্থায় দুর্নীতি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। এ ছাড়া ডিসি-এসপিসহ মাঠপর্যায়ের সব স্তরেই অস্বস্তি চলছে। একজনের দুর্নীতি ধরা পড়লে স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা যায়। তবে এবারের ধাক্কাটা একটু বড়। তাই কে কখন তার বিরুদ্ধে তথ্য ফাঁস করেন সেই শঙ্কা ভর করেছে। এদের অভ্যন্তরীণ গাঁথনি বড় পোক্ত। পদ-পদায়ন-পদোন্নতিসহ নানান সুযোগ-সুবিধা হাতানোতে তাদের কানেকশন আঠার মতো। যে কারণে বিভাগীয় পর্যায়ে দুর্নীতিসহ নানান অভিযোগ তারা উৎরে যান ম্যাজিকের মতো। সঙ্গে সঙ্গে দেশে-সমাজে আসন পাতে সম্মানিত হয়ে।

সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত কিছু প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক দুর্নীতি থাকলেও সেইসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবার নজির কম। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া প্রশাসনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অভিযোগের তদন্ত হলেও ফলোআপ জানা যায় না। বরং কিছুদিন পর পদোন্নতি পেয়ে যান। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ১৯৮৫ সালের শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা কঠোর ছিল। ওই বিধিমালা বহাল থাকলে দুর্নীতিবাজ প্রমাণিত হওয়া কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাতে হতো। কিন্তু ২০১৮ সালে বিধিমালাটি দুর্বল করে ফেলায় দুর্নীতি করেও কঠোর শাস্তি পাচ্ছে না দুর্নীতিবাজরা।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের জিরো টলারেন্স বেশ আলোচিত। আবার হাস্যকরও। তারা যেন দুর্নীতি না করেন সেজন্য বেতন বাড়ানোসহ রাজকীয় নানা প্রণোদনাও দেয়া আছে। বাস্তবে দুর্নীতি আরো বেড়েছে।

ক’য়েক বছর আগে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেছিলেন, প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা অনেক বেশি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। যে কারণে তাকে প্রতিদিন অস্বাভাবিক হারে বিভাগীয় মামলা শুনতে হচ্ছে। অনেকে আবার এসব অপরাধ থেকে বাঁচতে নানাভাবে তদবির করে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও করেন।

এই পরিস্থিতিতে অবশ্য সরকারী প্রশাসনে কারা দুর্নীতি করছে এবং কীভাবে দুর্নীতি করছে সে ব্যাপারে একটি স্বচ্ছ তদন্তের কথা শোনা যাচ্ছিল। দু বছর আগে সরকারের পক্ষ থেকে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের আয়ের বিবরণ প্রকাশের কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু সিদ্ধান্তটি শোনা কথা পর্যায়েই রয়ে গেছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা অনেক বেশি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন কেন? সরকারি কর্মচারী বিধিমালার প্রতি তারা অবজ্ঞা প্রকাশ করছেন কেন? প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনেক বেশি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া এবং সরকারি কর্মচারী বিধিমালার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের একাধিক কারণ থাকলেও মূল কারণ হলো প্রশাসনের দলীয়করণ। সাধারণভাবে প্রশাসন দলীয়করণ করা হলেও মাঠ প্রশাসনে দলীয়করণের শিকড় আরও গভীরে প্রোথিত।প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দলীয় কর্মকর্তাদের বসানোর কারণে প্রশাসনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধের অভিযোগ তদন্ত হয়। কিন্তু তাদের শাস্তি দেয়া হয় না। তাদের আবার প্রমোশন দিচ্ছে বারবার। এ জন্য দুনীতির তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে আইন, বিধি, নীতিমালাসহ সরকারের উদ্যোগ থাকলেও যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে এর বাস্তবায়ন নেই। বরং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একজন আরেকজনকে সুরক্ষা দিচ্ছেন। এতে অনিয়ম করতে আরো বেশি প্ররোচিত হচ্ছেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা।

সরকারি চাকরিজীবীদের দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে ২০১২ সালে প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে জনপ্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার কথা বলা হয়। অথচ সরকারি কর্মচারীকে আচরণবিধি মানাতে না পেরে গত বছরের শেষের দিকে এ নিয়ম বদলে ফেলার প্রস্তাব করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপর সরকার সমালোচনার মুখে পড়ায় সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ সংশোধনীর প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বেআইনি কাজ ও অসদাচরণ সম্পর্কে তথ্য প্রদানকারী ব্যক্তিদের সুরক্ষা না দিয়ে বিতর্কিত আইন প্রণয়ন করে সাংবাদিকদের হয়রানি করা হচ্ছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় এক হাজারের বেশী কর্মকর্তার নামে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১০ জন সহকারী সচিব, আটজন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব, সাতজন উপসচিব, একজন যুগ্ম সচিব ও একজন অতিরিক্ত সচিবের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

অসহনীয় দুর্নীতি বন্ধে একটি সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলেছেন, বাংলাদেশে বার্ষিক আয়কর ফাঁকির পরিমাণ প্রায় দুই লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা, যা দিয়ে মাথাপিছু স্বাস্থ্য বরাদ্দের চারগুণ বাড়ানো সম্ভব কিংবা কয়েকটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয়ে সংযুক্ত যুগ্ম সচিব মো: মনির হোসেনের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারকে তদন্ত করতে চিঠি দেয়া হয় গত বছরের ৬ আগস্ট। গাজীপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক এ এ আলম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বেগম ফারজানা মান্নানের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত বছরের ৩১ আগস্ট ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কাজে তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া হয়। অথচ এখনও তা আসেনি। নরসিংদীর সাবেক জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোর্শেদ জামান বর্তমানে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব, তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার। কিশোরগঞ্জের সাবেক ডিসি মো. সিদ্দিকুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত করছেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার।

বর্তমানে এমন তালিকা বেশ দীর্ঘ। বান্দরবানের ডিসি দিলীপ কুমার বণিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার। গাইবান্ধার সাবেক জেলা প্রশাসক মো: আব্দুস সামাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (স্মারক নম্বর-৪৮৭) গত বছরের ২৬ এপ্রিল এবং বর্তমান রংপুরের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর তদন্ত করতে দেয়া হয়েছে রংপুর বিভাগীয় কমিশনারকে। কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক বর্তমানে টাইঙ্গালের ডিসি নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করছেন রংপুর বিভাগীয় কমিশনার। জয়পুরহাটের সাবেক জেলা প্রশাসক মো. আ. রহিমের বিরুদ্ধে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় (স্মারক নম্বর-২২৭) গত বছরের ১৪ মে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারকে তদন্ত করতে দেয়। কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করে সাময়িক বরখাস্ত পযন্ত করা হয়। পরে তাকে আবার পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। লালমনিরহাটের সাবেক জেলা প্রশাসক এবং হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় (স্মারক নম্বর-২২৪) ওই বছরের ১৪ মে রংপুর বিভাগীয় কমিশনারকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়। চট্টগ্রামের সাবেক ডিসি মো.সামসুল আরেফিন, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল এবং লক্ষীপুরের সাবেক ডিসি এ কে এম টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে। সিলেটের সাবেক জেলা প্রশাসক মো. জয়নাল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ (স্মারক নম্বর-১৭৩) ওই বছরের ১৫ মার্চ তদন্ত করতে দেয় সিলেট বিভাগীয় কমিশনারকে। গত ১০ বছরেও কোনো প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু এসব কর্মকর্তাদের দেয়া হয়েছে পদোন্নতি করা হয়েছে বদলী। আবার বর্তমানে সেই কর্মকর্তারা অনেকেই সচিব, ডিজিসহ অনেক কিছু হয়ে রয়েছেন। তারা এখন সমাজ-সংসারে সফল মানুষ।

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বাজেটের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমলাতন্ত্রের একটি অংশ দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠেছে। এতে জনগণের হয়রানি বাড়ছে। অল্পসংখ্যক দুর্নীতিবাজ আমলার জন্য সারা আমলাতন্ত্রের বদনাম হচ্ছে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ড. আব্দুল মোমেন ২০২০ সালের নভেম্বরে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারি চাকরিজীবীরা। তাঁদের মধ্যে আমলাদের পাল্লাই ভারী। কানাডার টরন্টোয় বাড়ি করা বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে। কানাডায় টাকা পাচারের যে ২৮টি ঘটনার তথ্য জানা যায় তার মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীই বেশি।’ কিন্তু এটা আমল দেননি আমলারা। তার বড় ভাই সাবেক অর্থ মন্ত্রী আবুল মাল মুহিত রসিকতা করে বলেছিলেন, ঘুষকে এখন আর ঘুষ বলা যায় না। এটা স্পিড মানি। আরেকজন সাবেক মন্ত্রী একসময় “ঘুষ খাবেন তবে, সহনীয় মাত্রায় খাবেন” বলে ভাইরালও হয়েছিলেন।

পুলিশ ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মনে করছেন মন্ত্রী থাকা অবস্থায় দূর্ণীতির অভিযোগ ওঠা সাবেক মন্ত্রী, সরকারদলীয় এমপি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম।

এভাবে ক্রমান্বয়ে ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাট খেলো বিষয় হয়ে গেছে। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক সেনাপ্রধান আবদুল আজিজ, ঢাকা মহানগরের সাবেক পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, ডিআইজি জামিল হাসান, এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান কিংবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের প্রশাসনের উচ্চপদকে অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট মোটেই খণ্ডচিত্র নয়। প্রশাসনের কর্তাদের কাণ্ডকীর্তির একটি রূপ। তাদের সম্পদের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বাদশাদের পরিবারের সম্পদকে হার মানায়। দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে চলছে আলোচনা, সমালোচনা ও তীব্র বিতর্ক।

পুলিশ সদর দপ্তরে বিপিএসএ সভায় সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আংশিক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ঢালাও প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে বলে বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএসএ) জানিয়েছে তীব্র প্রতিবাদও। পুলিশ এসোসিয়েশনের সেই বিবৃতির পক্ষে অবস্থান নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথ্য ও সম্প্রদার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে যেন গণমাধ্যমে পুলিশের খবর প্রচারে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে সাংবাদিক-সম্পাদকদের এসোসিয়েশন থেকে পাল্টা বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে এটি স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য হুমকি।

সাবেক ও বর্তমান পুলিশ সদস্যদের সম্পদের হিসাব গণমাধ্যমে আসার বিষয়টি অস্বস্তিকর বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। কিন্তু সেই অস্বস্তি কাটাতে তাঁরা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত চাইলেন না। বিচারও চাইলেন না। উল্টো গণমাধ্যমকে ধমক দিলেন।

সময়ের ব্যবধানে বেনজীর-মতিউরগংরা এখন সরকারের জন্য দায়। পারলে সরকার এখন তাদের চেনে না। অথবা ‘দেখিলে চিনিবো’ রকমের অবস্থা। এটি এক ধরনের চাতুরি। তারা আওয়ামী লীগের কেউ না বলে দাবি করেছেন দলটির সাধারণ সম্পাদকও। তারা অবশ্যই আওয়ামী লীগের কেউ নন। আওয়ামী লীগের কোনো পদে তারা আগেও ছিলেন না, এখনও নেই। কিন্তু, বাস্তবে তারা আওয়ামী লীগের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগ। বিরোধীদল দমন, ২০১৪, ১৮ সালের নির্বাচন তুলে আনতে কতো পরিশ্রম করেছেন তারা। ছিলেন স্মার্ট, দক্ষ হিসেবে প্রচারিত। এখন ওয়ান টাইম ব্যবহৃত টিস্যুর মতো ছুড়ে ফেলা বা অস্বীকার করা আরেক রাজনীতি।

সম্প্রতি দুই প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দূর্ণীতির অভিযোগ প্রকাশ করেছে গণমাধ্যম, তাহলে কি আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এদের বিষয়েও বলবেন এরা আওয়ামীলীগের কেউ নয়।

বিভাগীয় পর্যায়ে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের কাছে রাজনৈতিক ও প্রশাসনের এই সম্প্রদায়ের নানা অপকর্মের ফাইল রয়েছে। বেশ কয়েকজন এমপি,উপজেলা চেয়ারম্যান, স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাসহ ডিআইজি, পুলিশ সুপার, ওসি, ট্রাফিক ইন্সপেক্টর, সাব-ইন্সপেক্টর, পুলিশ প্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তা, আনসার-ভিডিপি কর্মকর্তাসহ আইনশ্ংখলা বাহিনীর অন্তত দুই শতাধিক কর্মকর্তার জমি-জমা, বিদেশে সেকেন্ড হোম, অর্থ পাচার, বিত্তবৈভবের অভিযোগ চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সামনে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে ভেবে তাদের কেউ কেউ স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালানোর আয়োজনেও ব্যস্ত। তাদেরকে সেই সুযোগ দেয়া, না দেয়া পুরোটাই নির্ভর করে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!