রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে নিয়োগ বন্ধ ১৫ বছর
আলী হায়দার মানিক :
ফেনীতে জোড়াতালি দিয়ে চলছে প্রান্তিক মানুষের ইপিআই স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। সচেতনতা ও সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কার্যক্রম পরিচালনায় উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য পরিদর্শক, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক ও ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ে স্বাস্থ্য সহকারীরা দায়িত্ব পালন করে আসছে দীর্ঘদিন। জনবল সংকটে এ কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিগত ১৫ বছর ধরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল বলেও স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
ফেনীর ছয় উপজেলার ৪৩টি ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য সহকারী ২০৫টি পদের মধ্যে ১১৮টি পদ শূন্য রয়েছে। জনবল সংকটের কারণে ওয়ার্ড পর্যায়ে একজন স্বাস্থ্য সহকারীকে নিজ কর্ম এলাকার পাশাপাশি প্রতিনিয়তই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে কর্মরত স্বাস্থ্য সহকারীরা। শিশু ও নারীদের বিভিন্ন মারাত্মক সংক্রামক রোগ থেকে সুরক্ষার জন্য সরকার ইপিআই অব্যাহত রেখেছেন। বর্তমানে ইপিআই কর্মসূচির আওতায় শিশু, কিশোরী ও নারীদের ১১টি মারাত্মক সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
সদর উপজেলার ফাজিলপুর, লেমুয়া, ছনুয়া, মোটবী, কালীদহ ও ধর্মপুর ইউপিতে স্বাস্থ্য সহকারী পদ একেবারেই শূন্য থাকায় পাশবর্তী ইউনিয়নে কর্মরত স্বা¯’্য সহকারী এবং সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শকগণ সিডিউল ভিত্তিতে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ২০১০ সালের পর স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগের জন্য ২০১৫, ২০১৯ ও ২০২৪ সালে তিন দফা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও, দীর্ঘ ১৪ বছরেও নিয়োগ হয়নি স্বাস্থ্য সহকারী। এছাড়াও অবসরজনিত কারণে দিনদিন পদ শূন্যতা বাড়ছে। ফলে প্রান্তিক মানুষের ইপিআই ও স্বাস্থ্য সচেতনতা কার্যক্রম চলছে জোড়াতালি দিয়ে। ফেনী জেলার ছয়টি উপজেলার ৪৩টি ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য সহকারী ২০৫টি পদের মধ্যে ১১৮টি পদ শূন্য রয়েছে। বর্তমানে কর্মরত আছে ৮৭ জন। এর মধ্যে সিভিল সার্জন কার্যালয় ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে পেশনে রয়েছে কয়েকজন।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার সদর উপজেলার স্বাস্থ্য সহকারীর মঞ্জুরীকৃত পদ রয়েছে ৫৯টি, কর্মরত আছে ২৫ জন, শূন্য পদ রয়েছে ৩৪টি। দাগনভূঞা উপজেলার স্বাস্থ্য সহকারীর মঞ্জুরীকৃত পদ রয়েছে ৩৯টি, কর্মরত আছে ১৭ জন, শূন্য ২২টি। সোনাগাজী উপজেলার স্বাস্থ্য সহকারীর পদ রয়েছে ৪৪টি, কর্মরত ২২ জন, শূন্য ছ ২২টি। ছাগলনাইয়া উপজেলার স্বাস্থ্য সহকারীর মঞ্জুরীকৃত পদ রয়েছে ২৯টি, কর্মরত আছে ৮ জন, শূন্য পদ রয়েছে ২১টি। ফুলগাজীতে স্বাস্থ্য সহকারীর মঞ্জুরীকৃত পদ রয়েছে ১৪টি, কর্মরত আছে ৬ জন, শূন্য পদ রয়েছে ৮টি। পরশুরাম উপজেলার স্বাস্থ্য সহকারীর পদ রয়েছে ২০টি, কর্মরত আছে ৯ জন, শূন্য পদ রয়েছে ১১টি। নিয়ম অনুযায়ী স্বাস্থ্য সহকারীরা দুইদিন ইপিআই, দুইদিন কমিউনিটি ক্লিনিকে এবং দুই দিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সাপ্তাহের ছয় দিন নিজ কর্মরত এলাকায় দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কিন্তু স্বাস্থ্য সহকারী পদ শূন্য থাকায় স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ছে বলে জানান সাধারণ মানুষ।
ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা শাহজালাল ভূঁঞা বলেন, দীর্ঘদিন ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ে স্বাস্থ্য সহকারী পদ শূন্য থাকায় স্বাস্থ্য সচেতনতা কার্যক্রম ¯’বির হয়ে পড়েছে। অন্য এলাকা থেকে মাসের কয়েকদিন স্বাস্থ্য সহকারীরা এসে রুটিন মাফিক দায়িত্ব পালন ছাড়া আর কিছুই করছে না।
ফাজিলপুর ইউনিয়নের রিয়াজ জানান, পদ শূন্য থাকায় একজন স্বাস্থ্য সহকারীকে একাধিক ওয়ার্ডে কাজ করতে হয়, ফলশ্রুতিতে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে তাদের হিমশিম খেতে হয় এবং সেবাভোগীরা কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হয়।
কালিদহ ইউনিয়নের কর্মরত স্বাস্থ্য সহকারী সাখাওয়াত উল্যাহ জানান, স্বাস্থ্য সহকারীগণ নিজ নিজ কর্মস্থল ছাড়াও অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাড়তি কোন আর্থিক সুবিধাতো পায়ই না বরং নিজ বেতনের অনেক টাকাই অতিরিক্ত ব্যয় হয়ে যায়।
শর্শদী ও ছনুয়া ইউপির দায়িত্বে থাকা সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক গোলাম সরওয়ার জানান, স্বাস্থ্য সহকারীরা তাদের দায়িত্ব পালনে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে জনবলের অভাবে নিজ দায়িত্বের পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে।
সদর উপজেলা স্বাস্থ্য পরিদর্শক মোস্তফা কামাল জানান, ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ে পদ শূন্য থাকায় সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগসমূহ দেখা দিলে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করতে বেগ পেতে হয়। তারপরও কর্মরত স্বাস্থ্য সহকারীরা তাদের নিয়মিত দায়িত্ব হিসেবে ইপিআই, এইচপিভি টিকা, ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন, কৃমি নিয়ন্ত্রণ সপ্তাহ সহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘোষিত বিভিন্ন দূর্যোগকালীন সময় স্বাস্থ্য সেবা নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছে।
সদর উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়ার কাজ চলমান। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগ আলোর মুখ দেখবে। সংকট থাকা সত্ত্বেও আমরা সাধ্যমত সেবা প্রদান করার চেষ্টা করছি। তবে সেটা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
ফেনীর সিভিল সার্জন ডা: মোহাম্মদ রুবাইয়াত বিন করিম বলেন, শুধুমাত্র স্বাস্থ্য বিভাগ নয় সবকিছুতে পরিবর্তন আসছে। আশা করা যায় স্বাস্থ্য বিভাগেও চাহিদা অনুযায়ী জনবল সরবরাহ করা হবে। জনবল সংকট নিরসন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আমরা যতটুকু সম্ভব সেবা প্রদান করার চেষ্টা করছি। জনবল সংকট দূর হলে ভবিষ্যতে আমরা মানুষের দৌরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে পারবো।