মো : মাঈন উদ্দীন
দেশের পূর্বাঞ্চলে চলমান বন্যায় মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছেই চলেছে, বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় অফিসের তথ্য মতে, দেশের দক্ষিন পূর্বাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যায় ৫৯ লাখের ও বেশি মানুষ আক্রান্ত। ইউনিসেফ জানিয়েছে, বন্যায় ২০ লাখের বেশি শিশু ঝুঁকির মধ্যে আছে। এই শিশু দের বড় অংশ এখনো অভিভাবকদের সাথে আশ্রয় কেন্দ্রে বা উচু জায়গায় অবস্থান করছে। বিগত ৩৪ বছরে বাংলাদেশের প্র্বূাঞ্চলে এটি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বন্যা। বলা যায়, অনেকটা হঠাৎ করেই তলিয়ে গেছে দেশের ১১ জেলা। কারও কোনো প্রস্তুতি ছিল না। ফলে ঘরবাড়ি, সহায়-সম্বল ফেলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছোটেন মানুষ। ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লার প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ সেই সুযোগও পাননি। এসব অঞ্চলে নিজ বাড়িতেই আটকা পড়েছেন লাখো মানুষ।কেউ কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারলেও অনেকে নিরুপায় হয়ে বাড়ির ছাদ, টিনের চাল বা খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন। খাবার নেই। বিশুদ্ধ পানি নেই। রাত নামলেই বিদঘুটে অন্ধকার আর সুনসান নীরবতায় দিন কাটাচ্ছে। বন্যার পানি এখন নামতে শুরু করেছে। এতে আরেক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠছে।
পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলের মাঠ, মাছের খামার। ভেসে গেছে গৃহপালিত ও খামারের গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, আসবাবপত্র। পানির তোড়ে অনেকের বাড়িঘরও ভেঙে গেছে। সব হারিয়ে নিঃস্ব এসব মানুষ এখন নতুন করে বাঁচার স্বপ্নে বিভূর। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ বহু সড়ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা মেরামত করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে।
আকস্মিক বন্যার কারণে অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন এক কাপড়ে। সে ক্ষেত্রে তাঁদেও খাবারের পাশাপাশি কাপড়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এলাকার বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, এসব এলাকায় কীভাবে সংযোগ দেওয়া যায়, তা জরুরি ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে ও পদক্ষেপ নিতে হবে। হতাহতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করার দিকে সরকারকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও দাগনভূঞার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। এসব এলাকায় ক্ষতির কি যে ব্যাপক আকারে হয়েছে তা না দেখলে সহজে অনুমেয় নয়। ক্ষতি হয়েছে রোপা আমন, মাছের ঘের ও পোলট্রি খামারের। বন্যা পরবর্তী সহায়তা ও পুনর্বাসনের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। অত্র এলাকার সমুহে যে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা পুরনের জন্য সরকার ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সমূহকে এগিয়ে আশা উচিত। সেদিন ফেনীর এক বন্যার্ত মহিলার সাথে কথা হল সে বলল ভাই আমার ও ছেলের গায়ের জামা ছাড়া কিছুই নেই, এমনকি পায়ের জুতাও বানের পানিতে আসতে ছিড়ে গেছে। ঘরের খাট, তোষক, প্রিজ, আলমিরা এমনকি আমার অনেকগুলো মুরগি ও হাঁস ছিল সবই শেষ হয়ে গেছে। এখন যে কি করে চলবো ! এমনি হাজারো সমস্যা, কৃষকের বীজতলা ধ্বংস, পুকুরের মাছ, সবজি চাষির দু:খের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। জীবনহানী, ক্ষয়ক্ষতি ও গ্রামীণ অর্থনীতির যে ভয়াবহ বিপর্যয় হল তা উপলব্ধি করে, জরিপ করে পূনর্বাসন ও মেরামত ও অর্থায়নের মাধ্যমে জনগনের পাশে দাঁড়াতে হবে। বানভাসি মানুষকে উদ্ধারের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এগিয়ে এসেছে নানা সংস্থা, সংগঠন ও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-ছাত্রীরা। তারা শুকনো খাবার, পানি, ওষুধ ও কাপড় নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আর্তমানবতার পাশে।
এদেশে এমন অনেকেই আছেন, যাদের বুকে দুঃসময়ে দুঃখী মানুষের জন্য দরদ আছে। দুদিন আগে যে ছাত্রসমাজ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রক্ত ঝরিয়েছিল, আজ তারা বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ জোগাচ্ছে। সন্ত্রাসী, জালেম, স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের জন্য বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র ছাত্রীরা যেভাবে সম্মিলিত ভাবে জনগণ কে নিয়ে মাঠে ছিল তেমনি বন্যার্তদের দূর্দিনেও তারা সাহায্য নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখন পূণর্বাসনের জন্য অন্তবর্তী সরকার সহ সকলে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে হবে। এখন সমস্যা হল স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অনেকেই পলাতক, গা ঢাকা দিয়েছে, এ দূর্যোগ মূহূর্তে তাদের সাহায্যের জন্যে পাড়া-মহল্লায়, ওয়ার্ডে কমিটির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য দেয়া উচিত। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি। কৃষিবহির্ভূত ক্ষুদ্র্র কারখানা ও কুটিরশিল্পও থেমে গেছে। অনেক স্থানে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট নেই। গ্রামের পর গ্রাম বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত রয়েছে।
বন্যায় কৃষি খাতের যে বড় ক্ষতি হয়েছে, তা খুবই দৃশ্যমান। অনেক এলাকায় পাকা আউশ ধান তলিয়ে গেছে। রোপা আমনের বীজতলা, নতুন রোপণ করা আমন ধানের খেত সবই ডুবে গেছে। বিভিন্ন সবজি যেমন: মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, পটোল, ঢ্যাঁড়শ, করলা, ঝিঙা, বেগুন এবং মসলা ফসল হলুদ, মরিচ তলিয়ে গেছে পানির নিচে।
তেলজাতীয় ফসল চিনাবাদাম, তিল, সূর্যমুখী পানির নিচে বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফল আম,কাঁঠাল, লেবু, আনারস, কলা, পেঁপে, সফেদা, লটকন, ড্রাগন ফল নষ্ট হয়েছে। তাছাড়া মাছের ঘের বিনষ্ট হয়েছে। বেরিয়ে গেছে পুকুরে চাষ করা মাছ। বাড়িতে পালিত হাঁস-মুরগি মরে গেছে। গবাদি পশু খুব কমই বেঁচে আছে। গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষতি অনেক বড়।
মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারের বন্যায় ৬৮ উপজেলা প্লাবিত হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন-পৌরসভা ৫০৪। ১১ জেলায় মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৩ লাখ ৬ হাজার ৪০২। পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় দিতে ৩ হাজার ৮৭০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। সেখানে ৩ লাখ ৫২ হাজার ৯৪২ জন আশ্রয় নিয়েছেন। ৩৪ হাজার ৫১৮টি গবাদি পশু আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ১১ জেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে ৫১০টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।
বন্যায় ঘরবাড়ি হারানো, খাদ্য ও পানির সংকট এবং রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও হতাশা দেখা দিচ্ছে। এ মানসিক সমস্যাগুলো অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, যদি তা সময়মতো মোকাবিলা না করা হয়। বন্যায় গ্রামীণ অর্থনীতি যে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তা পূনরুদ্ধারে জন্য যদি সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া না হয় তাহলে দরিদ্র ও বেকারত্বের হার আরো বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান। যা কারোই কাম্য নয়। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি উন্নয়নে জন্য, গ্রামীণ অর্থনীতিকে টেকসই করার জন্য এবং সাম্প্রতিক বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে গ্রামীন জনগোষ্ঠীকে সাবলম্বী করতে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক, মাছ চাষী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ক্ষুদ্রঋণের সুদ মওকুফ বা সুদের হার কমানোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো চিহ্নিত করে যতদ্রুত সম্ভব স্থায়ী পুনর্বাসন যাতে শুরু করা যায় সে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক, এনজিও, দাতা সংস্থার সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে স্বচ্ছতার সাথে দূর্গতদের পাশে এগিয়ে আসলে বৈষম্যহীন সমাজ, সুখী সমাজ ও সুষম অর্থনীতি উপহার দেয়া সম্ভব।
লেখক : ব্যাংকার।