আমাদের প্রিয় জন্মভূমি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। যার অবস্থান এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিধিজুড়ে । দীর্ঘ শোষণ আর বঞ্চনার হাত থেকে ১৯৭১ সালে জন্ম নেয় এ দেশ। অবরুদ্ধ বাংলার সব অর্গল খুলে ছিনিয়ে আনা হয় বিজয়। এই বিজয় এসেছে অনেক রক্তের বিনিময়ে। অনেক জীবন ও স্বপ্নের বিনিময়ে। অনেক আশা ও সাধনার উচ্ছ্বাসে। এর ফলে আমরা পেয়েছি লাল-সবুজের একটি পতাকা যে পতাকাটি পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশের পতাকার চেয়ে সুন্দর, যেমন সুন্দর এখানকার চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্য।উন্মুক্ত সুনীল আকাশের মুক্ত বাতাসে সেদিন মুক্তির নিঃশ্বাস নিয়েছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। এ বিজয় আর স্বাধীনতা লাভ একদিনে হয়নি। তার বহু বঙ্কিম ইতিহাস আছে । সমুদ্র সৈকতে বালুকারাশির মধ্যে তিল তিল করে যেমন সঞ্চিত হয় মহামূল্যবান রত্নভান্ডার, সমুদ্রের বেলাভূমিতে সমুদ্রের আকর্ষণে, অসংখ্য স্রোতস্বিনীবাহিত পলি হাজার হাজার বছর সঞ্চিত হয়ে তেমনি সৃষ্টি করে উন্নত জীবনের স্বর্ণদ্বীপ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, স্বর্ণালী দ্বীপ বাংলাদেশের জন্ম এভাবেই হয়েছে।ঐতিহাসিকভাবে এই প্রারম্ভটা অন্তত কয়েক হাজার বছরের, যখন থেকে এই গাঙেয় আববাহিকায় পলল ব-দ্বীপ, ফুল-ফসল, পশুপাখি ও মানববসতি পরিলক্ষিত হয়েছে। ভাঙন ও মিলনের দ্বৈতলীলায় বাংলার মাটি, বাংলার ভূ-সীমা, বাঙালির নৃতত্ত্ব, দেহভঙ্গি,তার সংস্কৃতি ও সর্বোপরি তার ভাষা বিবর্তিত হতে হতে আজ বর্তমান রূপ ধারণ করেছে।
আজ ১৮ ডিসেম্বর, দুই দিন আগে গেল মহান বিজয় দিবস। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে জনগণের স্বাধীন রাষ্টের আকাংখা বাস্তবে রূপ লাভ করেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে। তাই প্রতিবছর এই দিনটিকে জাতি স্মরণ করে গভীর শ্রদ্ধার সাথে। আমাদের বিজয়ের ৫৩ বছর পূর্ণ হবে এই ডিসেম্বরে। জাতির ইতিহাসের পাতায় বিগত ৫৩ বছরে যুক্ত হয়েছে আনন্দ-বেদনা এবং গর্ব ও দীনতার নানা ঘটনা। এমন প্রেক্ষাপটে বিজয়ের দামামা বাজানোর পাশাপাশি আমাদের পালন করতে হবে আত্মসমালোচনার দায়িত্বও। কারণ আত্মসমালোচনা ছাড়া কোনো জাতি তার কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না।
ইতিহাসের পাঠকমাত্রই একথা জানেন যে, এই জনপদের মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা দীর্ঘদিনের একটি লালিত বিষয়। স্বাধীনতার লক্ষ্যে তারা যুদ্ধ করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার এই দীর্ঘ পরিক্রমায় নেতৃত্ব প্রদানের জন্য আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকি নবাব সিরাজউদ্দৌলা, শহীদ তিতুমীর, নবাব সলিমুল্লাহ, শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ জিয়াউর রহমানসহ আরও অনেক মহান নেতাকে। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বিশেষভাবে অবদান রেখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা জানি যে, স্বাধীনতা অর্জনের চাইতেও কঠিন বিষয় হলো স্বাধীনতা রক্ষা এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যসমূহ অর্জন করা। এ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জিত না হলে স্বাধীন রাষ্ট্রও পরিণত হতে পারে ব্যর্থ রাষ্ট্রে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আমরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছি। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সহিষ্ণুতার অভাবে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির ক্ষেত্রে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি। রাজনৈতিক অঙ্গনে এই ব্যর্থতার কারণে আমরা কাংখিত উন্নয়ন, জীবনমান, সুশাসন ও নিরাপত্তা লাভে সমর্থ হইনি। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট আজ দেশে-বিদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। এমন অবস্থায় আমাদের দীর্ঘকালের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার ইতিহাস পুনঃপাঠ প্রয়োজন। আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম তো শুধু ক্ষমতার পালাবদলের জন্য ছিল না। ব্যক্তি বা দলের মহিমা কীর্তনও আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল না। গণতান্ত্রিক চেতনায় এই জনপদের মানুষের সামগ্রিক মুক্তিই ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য। দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটলে এবং সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নতি হলে আমরা উপলব্ধি করবো, স্বাধীনতার লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বিশেষ বিশেষ ঘরানার মানুষদের অতি উন্নতি হলেও আমজনতা এখনো জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এসে গণতন্ত্রের জন্য আমাদের হাহাকার করতে হচ্ছে! রাজনৈতিক অঙ্গনের চালচিত্র ও আচার-আচরণ তেমন সম্মানজনক নয়। প্রতিযোগিতা ও সহনশীলতার বদলে ফ্যাসিবাদী সরাকরের বৈরিতা ও বিদ্বেষের রাজনীতি জাতিকে আতঙ্কজনক এক পরিবেশে বন্দী করে রেখেছিল। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মাত্রা বাড়ছে। এখন জনগণের ক্ষমতা ও অধিকারকে তুচ্ছজ্ঞান করে চাতুর্য ও শঠতার রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। যেনতেনভাবে ক্ষমতায় যাওয়াই যেন এখন রাজনীতির মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। এ কারণেই ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার মত ঘটনাও আমাদের দেশে ঘটতে পেরেছে। ভোট ছাড়াই বিজয় লাভের এমন নিকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের গণতন্ত্রের জন্য এক অশনি সংকেত। এখন আবার বিশেষ ঘরানার লোকজন বলছেন, গণতন্ত্রের আগে উন্নয়ন প্রয়োজন। কিন্তু গণতন্ত্রবিহীন উন্নয়নে কাদের উন্নয়ন হয়, সেই দৃশ্য জনগণ দেখে ফেলেছে। তাই ওই তত্ত্বে জনগণের কোনো আস্থা নেই। জুলাই বিপ্লবের পর জনগণ উন্নয়ন ও গণতন্ত্র এক সাথেই চায়। আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও স্বাধীনতার লক্ষ্যও তাই ছিল।
বিজয়ের ৫৩ বছরে এসে জাতি আর চাতুর্য কিংবা ছলাকলার কোনো তত্ত্ব শুনতে চায় না। জাতি বিশেষ কোনো ঘরানার নয় বরং সবার ন্যায়সঙ্গত উন্নতি চায়। একই সাথে প্রহসনের নির্বাচনের বদলে চায় গণতান্ত্রিক নির্বাচন। এই বার্তা উপলব্ধি করে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্তব্য নির্ধারণে মনোনিবেশ করলে আমাদের বিজয় দিবস পালন সার্থক হবে। আর আমরা শুনতে চাই না- ধরা যাবে না/ ছোঁয়া যাবে না/ বলা যাবে না কথা/ রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এমন স্বাধীনতা।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।