আল্লাহ তা’য়ালা চান মু’মিন যেন পাপ মুক্ত ও পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করে। আর এ পরিচ্ছন্ন অবস্থায়ই যেন তার মৃত্যু হয়। এ জন্যে পাপ ও ঋণ মুক্ত থাকা অপরিহার্য। মৃত ব্যক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট হক ঃ মৃত ব্যক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট হক ৪টি।
১. কাফন-দাফন : একজন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করার পর ওয়ারিশদের প্রথম কর্তব্য হলোÑ তার ত্যাজ্য সম্পদ থেকে মধ্যম মানের ব্যয়ে তার কাফন দাফনের ব্যবস্থা করা।
২. ঋণ পরিশোধ করা : সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো তার ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করা।
৩. অসিয়ত পূরণ করা : সে কোন অসিয়ত করে গিয়ে থাকলে এক তৃতীয়াংশ মাল দিয়ে অসিয়ত পূরণ করা।
৪. বন্টন করা : অবশিষ্ট সম্পদ তার ওয়ারিশদের মধ্যে কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা অনুযায়ী বন্টন করা।
ঋণ পরিশোধ না করার পরিনতি : ঋণের গুনাহ মারাত্মক। তা বান্দার হক তাই ঋণদাতা তাকে ক্ষমা না করলে আল্লাহ তা’য়ালা ক্ষমা করবেন না। হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন- মু’মিনের আত্মা তার ঋণের কারণে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকবে অর্থাৎ জান্নাতে যেতে পারবে না, যতক্ষণ তার ঋণ পরিশোধ করা না হয় (তিরমিযী, হাদীস নং-১০৭৮ মুসনাদ আহমদ, মিশকাত পৃ: ১৬৪)। হযরত মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ (রা) থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, আমরা মসজিদে নববীর সম্মুকে যেখানে জানাযা রাখা হতো, সেখানে বসা ছিলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (স)ও আমাদের মাঝে উপবিষ্ট ছিলেন। আমরা দেখলাম, তিনি আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকালেন, তারপর দৃষ্টি অবনমিত করে কপালে হাত রেখে বললেন, সুবহানাল্লাহ! কী কঠিন বিষয় অবতীর্ণ হলো। বর্ণনা কারী বলেন, আমরা একদিন ও একরাত চুপ থাকলাম। এসময়ের মধ্যে ভাল ছাড়া মন্দ কিছুই দেখলাম না। হাদীস বর্ণনাকারী মুহাম্মদ বলেন, (দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর) আমি রাসূলুল্লাহ (স) এর নিকট আরজ করলাম, কী কঠিন বিষয় অবতীর্ণ হয়েছে? রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, ঋণ সম্পকীয় কঠিন বিধান। সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ। যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর পথে শহীদ হয়, তারপর পুনজীবিত হয়ে আবার আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়, তারপর পুনজীবিত হয়ে আবার আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয় তথা তিনবার শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করে, আর তার যিম্মায় অনাদায়ী ঋণ থেকে যায়, তা’হলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ তার সেই ঋণ পরিশোধ না করা হয় (সুনানে আবু দাউদ, মিশকাত পৃ.১৬৩)।
মহানবী (স) জানাযায় যে প্রশ্ন করতেন : রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, শহীদের সব গুনাহই ক্ষমা করে দেয়া হবে। মাফ হবে না শুধু ঋণ (মুসলিম)। মহানবী (স) কারো মৃত্যুর সংবাদ শুনলে তার জানাযায় উপস্থিত হতেন। তিনি বলেছেনÑ এক মু’মিনের উপর আরেক মু’মিনের হক হলো ছয়টি। তন্মধ্যে একটি হলো- মৃত ব্যক্তির জানাযায় উপ¯ি’ত হওয়া এবং তার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা। মহা নবী (স) জানায় উপস্থিত হয়ে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করতেন এ ব্যক্তির কোন ঋণ আছে কি-না? যদি প্রত্যুওরে বলা হতো আছে, তা’হলে তিনি বলতেন তার ঋণ পরিশোধের সামর্থ আছে কি না? যদি বলা হতো আছে, তা’হলো ওয়ারিশদের বলতেন তা পরিশোধ করে দাও। অত:পর জানাযা পড়াতেন। আর যদি বলা হতো পরিশোধ করার মত সামর্থ তার নেই, তখন তিনি বলতেন, এ ঋণ পরিশোধ করার দায়িত্ব আমার, আমি নবী ও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল হিসেবে তা প্রদান করবো।
অন্যের ঋণের বোঝা হালকা করার ফল : অপর মু’মিন ভাইয়ের ঋণের বোঝা দূর করার ফল হলো ক্ষমা। মহানবী (স) বলেন, এক ব্যক্তি মানুষকে ঋণ দিতো। তারপর তা আদায় করার জন্য লোক পাঠাতো। সে আদায়কারীকে বলে দিত, অভাবী লোকদের ঋণ মাফ করে দিবে। তা’হলে আশা করা যায় আল্লাহ আমাদেরকে মাফ করে দেবেন। এ ব্যক্তি যখন আল্লাহর কাছে গিয়ে পৌছলো, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জানাযার জন্য এক ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ (স) এর নিকট আনা হলো। রাসূলুল্লাহ (স) জিজ্ঞেস করলেন, “এ ব্যক্তির কি কোন ঋণ আছে? জবাবে বলা হলো, হ্যাঁ আছে।” রাসূলুল্লাহ (স) জিজ্ঞেস করলেন, ঋণ শোধ করার মতো সম্পদ কি সে রেখে গেছে? জবাবে বলা হলো, “না রেখে যায়নি।” রাসূলুল্লাহ বললেন, “তোমরা এ ব্যক্তির জানাযা পড়ো, আমি পড়বো না।” এ অবস্থা দেখে হযরত আলী (রা) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এ ব্যক্তির ঋণ আদায়ের ভার নিচ্ছি।” অত:পর রাসূলুল্লাহ (স) তার জানাযা পড়ান। অন্য এক বর্ণনানুযায়ী রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, হে আলী! আল্লাহ তোমাকে আগুন থেকে বাঁচিয়ে রাখুন, সেভাবে তুমি তোমার একজন মুসলিম ভাইকে আগুন থেকে বাঁচালে। যে মুসলিম অপর মুসলিমের ঋণ পরিশোধ করে দেবে, শেষ বিচারের দিন আল্লাহ তাকে মাফ কের দেবেন (শরহে সুন্নাহ)।
ঋণ পরিশোধ করার বাসনা : ঋণ পরিশোধ করার নিয়ত থাকলে আল্লাহ তা’য়ালা সাহায্য করেন। মহানবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি কারো কাজ থেকে ঋণ গ্রহণ করে এবং তা আদায় করার নিয়ত রাখে। আল্লাহ তাঁর পক্ষ থেকে তা পরিশোধ করে দেন অর্থাৎ পরিশোধ করা সহজ করে দেন। আর যে ব্যক্তি ঋণ নিয়ে তা আদায় করার নিয়ত রাখে না। আল্লাহ তা’য়ালা তাকে ধ্বংশ করেন (সহীহ বুখারী)।
ঋণ পরিশোধ করার অনিচ্ছা : ঋণ পরিশোধে উদাসীন হওয়া হারাম। যতদ্রæত পারা যায় ঋণ পরিশোধ করে দেয়া উত্তম। কারণ হায়াতের কোন গ্যারান্টি নেই। মহানবী (স) বলেন- সক্ষম ব্যক্তির ঋণ আদায়ে গড়িমসি করা তার মানহানী ও শাস্তিকে বৈধ করে দেয় (আবু দাউদ)।
শিক্ষা : পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত ঋণের ভয়াবহতা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত, যাতে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে কবরে যেতে না হয়। মৃত্যুর পর ওয়ারিশগন সম্পদ বন্টন করে নিয়ে যাবে। তারা ঋণ পরিশোধ না করলে ঋণের শাস্তি তাকেই পেতে হবে। বিশেষ করে ব্যাংক, ব্যক্তি বা এন.জি.ও ইত্যাদি থেকে সুদে ঋণ গ্রহণ করার ব্যাপারে অবশ্যই আল্লাহকে ভয় করা উচিত। কারণ সুদের নিন্মতম গুনাহ হলো আপন মাকে বিবাহ করা। আর সর্বোচ্চ গুনাহ হলো আল্লাহর সাথে যুদ্ধ ঘোষনা করা।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ।