সাইফুল আলম :
“এ বিশ্ব এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের আছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার”
বিপ্লবী কিশোর কবি সুকান্ত ভট্রাচার্য তার বিখ্যাত কবিতা ‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থে’ এ অঙ্গিকার ব্যক্ত করেন। আজ থেকে প্রায় আশি বছর পূর্বে কবি সুকান্তের এ অঙ্গীকার শিশুদের প্রতি সব মানুষের অঙ্গীকার হওয়া উচিত। প্রতিটি শিশুই নিষ্পাপ হয়ে জন্মগ্রহণ করে। শিশুরা ফুলের মতই পবিত্র। শিশুদের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ার উদ্রেগ হয় না এমন মানুষ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কবি গোলাম মোস্তফা বলেছেন “ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে”। তাছাড়া কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ভিক্টর হুগো, ওয়ার্ডওয়ার্থ, টেনিসন সহ অনেক গুণীজন শৈশবের কাতর ছিলেন।
শিশুদের জন্য আমরা এ ধরণীকে কতটা নিরাপদ করতে পেরেছি? আমাদের দেশে প্রতি বছর যে পরিমান শিশু ধর্ষণের শিকার হয় সে পরিসংখ্যান দেখলে বিষ্ময়ে হতবাক হতে হয়। এমনকি এক বছরের শিশুরাও ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পায় না। কেবল ধর্ষণ করেই শেষ নয়, এসব হতভাগ্য শিশুদের অনেকেই ধর্ষণ পরবর্তী নির্মম হত্যার শিকার হয়েছে। শিশুখাদ্যে ভেজাল মিশ্রনের বিষয়টিতো এদেশে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রম রোধে আমরা আজো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারিনি। বাধ্যতামূলক শিশুশিক্ষা বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও নানান প্রতিকূলতায় তা আজও শতভাগ সফল হয়নি। শিশুদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চয়তার বিষয়টি এখনো সুদূর পরাহত। শিশুদের সুস্থ বিনোদনে খেলার মাঠের অপ্রতুলতা সম্পর্কে সবাই অবগত। এতসব নেতিবাচক পরিবেশের মাঝে বেড়ে উঠছে বেশিরভাগ শিশু।
সন্তানের সাথে মা-বাবার সম্পর্ক অথবা একের প্রতি অন্যের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে ধর্মগ্রন্থগুলোতেও বিশদ বর্ণনা রয়েছে। সেসব নিয়ে আলোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। পৃথিবীতে মানব ইতিহাসের শুরু থেকে এ যাবত একটি কথা সর্বজনগ্রাহ্য যে, মায়ের কোল শিশুদের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। প্রকৃতিগতভাবেই দুনিয়ার সব বিবাহিত দম্পত্তির একটি আকুল প্রত্যাশা থাকে তা হলো সন্তান জন্মদান। সন্তান গর্ভে ধারণ থেকে শুরু করে প্রসব করা মায়ের জন্য খুবই কষ্টকর একটি বিষয়। একটি মানুষের ভেতর আরেকটি মানুষ! অবশেষে অনেক ক্লেশ সয়ে মা সন্তান প্রসব করেন। আরাধ্য ধনের মুখটি দেখে মা মুহর্তে তার সব কষ্ট ভুলে যান। বাবাও খুশিতে হন আটখান। এভাবে মা-বাবা তাদের দাম্পত্য জীবনের পূর্ণতা অনুভব করেন। যারা নি:সন্তান তারা অনুভব করেন এটি কতটা পীড়াদায়ক।
পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক মানুষ আছেন যারা তাদের স্বপ্ন সম্পূর্নরুপে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন। অপূর্ণতার হাহাকার প্রতিনিয়ত মানুষকে খুবলে খায়, যা তাকে মরণ অবধি কষ্ট দেয়। মা-বাবা তাদের অপূর্ণ আশা বা আকাংখা তাদের সন্তানের মাধ্যমে পরিপূর্ণ চেষ্টা করেন। সন্তানের চোখে মা-বাবা তাদের অনাগত পৃথিবী দেখেন। নিজে না খাইয়ে সন্তানদের খাওয়ান। সন্তানের মুখে হাসি দেখার জন্য মা-বাবা তাদের সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে থাকেন। নাড়ী ছেড়া শিশুটি মা-বাবার নিরাপদ আশয়ে দিন দিন বেড়ে উঠে। সন্তানের মুখে প্রথম বুলি ফোটা, প্রথম বিদ্যালয়ে যাওয়া, শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবন-এভাবেই মা-বাবার চোখের সামনে সেদিনের সে ছোট্র শিশু পরিণত হয় মহীরুহে। এ সব দেখেই মা-বাবার তৃপ্তি। সন্তান নিয়ে সব মা-বাবার অভিজ্ঞতা, নিজেকে উৎসর্গ করা সব পর্বগুলো মোটামুটি একই।
আমাদের দেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ইস্যু সর্বস্তরের মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে তা হলো- মা-বাবা কর্তৃক শিশু সন্তান হত্যা। প্রায়শ:ই মিডিয়ায় দেখতে পাই, এমন নিকৃষ্টতম হত্যার শিকার হচ্ছে অনেক শিশু খোদ তাদের মা-বাবার হাতে। রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে সেখানে আশ্রিত হয়ে পড়ে অসহায়, কখনোও জুলুমের শিকার অথবা বিনা অপরাধে নৃশংস হত্যার শিকার। প্রশ্ন হলো যেখানে সন্তান জন্মদান প্রতিটি মা-বাবার আরাধ্য বিষয়, সেক্ষেত্রে কিভাবে এমন ন্যাক্কারজনক কাজটি করা সম্ভব হয়? পৃথিবীতে কোন মা তার সন্তানের ভাগ অন্য কাউকে দিতে চান না। সন্তানের ন্যুনতম ক্ষতি কোন পিতা-মাতা সহ্য করেন না। আমি এমনটি অনেক দেখেছি, মা পাগল কিন্তু তার সন্তানকে আগলে রাখে পরম মমতায়। কেউ তার কাছ থেকে সন্তান ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে সে প্রাণপনে বাধা দেয়। কারণ সে জানে এটি তার নাড়ি ছেড়া ধন।
মা-বাবার হাতে কি পরিমাণ সন্তান হত্যার শিকার হয়েছে তা উল্লেখ করতে গেলে লেখার কলেবর অনেক বেড়ে যাবে। এখানে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করে ঘটনার ভয়াবহতার কিছুটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছি।
নিজের ওড়না দিয়ে ১২ বছরের মেয়ে ও ৬ বছরের ছেলেকে হত্যা করেছে মা। সূত্র: ০৪ মার্চ ২০১৬, দৈনিক সমকাল।
প্রেমিককে সঙ্গী করে মা গলাকেটে হত্যা করেছে তার নিজের সন্তান। আমার সংবাদ, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৮
কুমিল্লার মুরাদনগরে বাবা ও মা কর্তৃক দুই সন্তানকে পানিতে চুবিয়ে হত্যা। ২৪ মে ২০২০
স্কুল ছাত্র পারভেজ হত্যায় মা ও তার প্রেমিক গ্রেপ্তার। ১৫ অক্টোবর ২০২০ আরটিভি।
পরকীয়ায় প্রকাশ্য শিশুসহ ৩ প্রাণ নিলো এএসআই। ১৩ জুন ২০২১, আরটিভি।
স্বামীর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের (শ্যালিকার সাথে) জের ধরে মা-বাবা-বোনকে হত্যা করেছে মেহজাবিন। ঘটনার স্থান: কদমতলী, ঢাকা। সূত্র: ১৯ জুন ২০২১
রাজধানীর আদাবরে চাঞ্চল্যকর হত্যার শিকার শিশু সামিউল ও পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত তার মা। ১৩ জুন, ২০২১ আরটিভি।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে মা-বাবা কর্তৃক সন্তানকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হয়। সূত্র: নোয়াখালী সমাচার ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২।
পরকীয়ার পথের কাঁটা সরাতেই দুই শিশুসন্তানকে হত্যা করেন মা। সময় টিভি, ১৭ মার্চ ২০২৩
নাটোরে পরকীয়ার জেরে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ। প্রথমআলো ২২ জুন ২০২৩
পরকীয়ার কারণে দুই সন্তানকে বিষ দিয়ে হত্যার কথা আদালতে স্বীকার করলেন মা। ১৭ মার্চ ২০২২, চ্যানেল ২৪বিডি।
পরকীয়ার জেরে সন্তানকে হত্যার অভিযোগ, মা গ্রেফতার। ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২২, দৈনিক ইত্তেফাক,
পরকীয়া প্রেমিকের সঙ্গে মাকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলায় সন্তানকে হত্যা। ০২ জুন ২০২২, বিডি২৪লাইভ.কম
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে শিশু সন্তানকে শ^াসরোধ করে হত্যা। নেপথ্যের কারণ: পারিবারিক দ¦ন্ধ। সূত্র: দি ডেইলি স্টার বাংলা ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২।
“অভাবের তাড়নায় সন্তানকে হত্যার পর বাবার আত্নহত্যার চেষ্টা” – ২১ জানুয়ারী ২০২৩, দৈনিক জনকন্ঠ ।
“নীলফামারিতে শিশু সন্তান হত্যার অভিযোগে বাবা গ্রেপ্তার” ১৩ মে ২০২৩-দৈনিক যায়যায়দিন
উপরোক্ত ঘটনাগুেেলা যে কারো মনে অস্থিরতার উগ্রেক করে। তাহলে মা-বাবা কৃর্তক সন্তান হত্যার নেপথ্যে কারণ কী? মা-বাবার সাথে সন্তানের নির্ভেজাল সম্পর্কের চিরচেনা রুপ যেন রহস্যের ঘেরাটোপে আটকে যায়। এতে করে একের প্রতি অন্যের আস্থার সংকট তৈরী হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে ঘটনার নেপথ্যের কারণ উদঘাটন করতে হবে। দু একটি হত্যাকান্ড যদিও মা/বাবার মানসিক বিকারগ্রস্থতার কারণে ঘটে তবে তাও নির্ণয় করতে হবে। আমেরিকা-ইউরোপে এমন ঘটনা ঘটার সাথে সাথে সাইকোলজিস্টরা কারণ নির্ণয়ে নেমে পড়েন। পৃষ্টার পর পৃষ্টা আর্টিকেল লিখে কর্তৃপক্ষকে জমা দেন। এটি সর্বসাধারণের সতর্কতার কাজে ব্যবহৃত হয়। এ যাবত উদঘাটিত কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে শিথিল পারিবারিক বন্ধন। একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি। কারণ, যৌথ পরিবারে শিশুরা একত্রে বেড়ে উঠে, ফলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে। মানুষ এখন অতিমাত্রায় আত্নকেন্দ্রিক, শুধু টাকা কামানোই যেন মানুষের নেশা এবং পেশা। এতে পিতা-মাতা সন্তানদের সময় দিতে পারেন না। আকাশ সংস্কৃতির অপব্যবহার আমাদের চারিত্রিক অধ:পতন ডেকে আনছে। টিভি বা মোবাইলে আজে-বাজে ছবি দেখে তা নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করার হীন চেষ্টা করছে স্বামী-স্ত্রী আর এটি করছে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে। আর এতে পরকীয়ার বিষাক্ত ছোবলে অকাল প্রয়াণ ঘটছে সাজানো সংসারের। মা-বাবা কর্তৃক সন্তান হত্যার নেপথ্যের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো পরকীয়া। আবার অনেক সময় দেখা যায়, মাদকাসক্ত সন্তানের প্রতিনিয়ত অত্যাচারে মা-বাবা তাকে হত্যা করছে। নেশার টাকা না পেয়ে মা-বাবাকে মারধর যেন ঐ সব সন্তানের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আর এতে রুষ্ট হচ্ছেন বাবা-মা। নিজেকে বাঁচাতে হত্যা করছে সন্তানকে।
মা-বাবা ও সন্তান একে অন্যের প্রতি আরো বেশী দায়িত্বশীল থেকে জীবন নির্বাহ করতে হবে। যার যার ধর্মীয় বিধি বিধানগুলো মেনে চললে মানুষ নিজেকে সর্বাবস্থায় সংযত রাখতে পারে। ভালো মানুষের আজ বড়ই অভাব পরিলক্ষিত হয়। সর্বোপরি আমাদেরকে মানবীয় গুণাবলীর চর্চা করতে হবে। ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আর এভাবেই মানবিক পৃথিবী গড়ে উঠুক। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্রের অমর কথা হোক প্রত্যেক মা-বাবার প্রত্যাশা “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।