আল্লাহ তায়ালা যত সব ইবাদত তাঁর মু’মিন বান্দাদের উপর ফরজ করেছেন, এর পেছনে কোন না কোন উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। এ হিসেবে মুমিনদের উপর রোযা ফরয করার পেছনেও রয়েছে আল্লাহর মহান উদ্দেশ্য।
তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত করা : রোযার প্রধান উদ্দেশ্য মু’মিনদেরকে তাকওয়া তথা আল্লাহ ভীতির গুণে গুণান্বিত করা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, হে ইমানদারগন! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে। যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হও (সূরা আল বাকারা- ১৮৩)। এ আয়াতে রোযা ফরয করার উদ্দেশ্য বলা হয়েছে তাকওয়া অর্জন। তাকওয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ সতর্ক হওয়া, ভয় করা, সংযত হওয়া, বেঁচে থাকা, শক্তি সঞ্চয় করা, দায়িত্বশীল হওয়া, জবাব দিহিতার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কর্তব্য সম্পাদন করা। পরিভাষায় তাকওয়া বলা হয় সতর্ক ও সচেতনতার সাথে পরকালে আল্লাহ তায়ালার নিকট জবাবদিহিতার মনোভাব নিয়ে নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সাথে সকল কাজ সম্পাদন করা এবং তাঁর সন্তুষ্টির পরিপন্থী সকল কাজ বর্জন করা। তাকওয়ার বৈশিষ্ট হলো ছয়টি। যেমন- ১. সত্যের সন্ধান ২. সত্য গ্রহণ ৩. সত্যের উপর অটল থাকা ৪. আল্লাহ ভীতি ৫. দায়িত্বানুভুতি ৬. জবাবদিহিতা ভিত্তিক দায়িত্বশীলতার সাথে কর্তব্য সম্পাদন।
জৈবিক চাহিদা থেকে আত্মাকে মুক্ত রাখা : জৈবিক চাহিদা মানবের সবচেয়ে ক্ষতিকর জিনিস। এর থেকে আত্মাকে মুক্ত রাখা রোযার অন্যতম উদ্দেশ্য। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, সিয়ামের বিশেষ উদ্দেশ্য হ”েছ মানুষকে তার পাশবিক বাসন ও জৈবিক চাহিদা থেকে মুক্ত রাখা, সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জন করে চিরন্তন জীবনের অনন্ত সফলতার শৈল চুড়ায় আরোহন করে। পশুত্ব নিস্তেজ হয়ে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়। সিয়াম দরিদ্র-পীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভুতির উদ্রেক সৃষ্টি করে মানুষের শারীরিক ও আত্মিক শক্তির উন্নতি সাধন করে এবং পাশবিক চাহিদা যা মানুষের স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে তা থেকে মুক্ত করে। অনুরূপ রোযা কলবের ইসলাহ ও চরিত্র সংশোধনের ক্ষেত্রে কার্যকর ভ‚মিকা পালন করে থাকে (যাদুল মা’আদ, ১ম খন্ড পৃ. ১৫২)। শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী (র) হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ গ্রন্থে বলেছেন, রোযার উদ্দেশ্য হলো মানুষ থেকে পশু স্বভাব দূর করা। পশু স্বভাব মানুষের জন্য বিরাট ক্ষতিকর। তাই মহানবী (স) বলেছেন- যে ব্যক্তি অর্থাভাবে বিবাহ করতে অক্ষম সে যেন সিয়াম পালন করে। কারণ, সিয়াম পালনের ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে এবং বিবাহ করার কামনা দূর হবে (মিসকাত বিবাহ পর্ব, পৃ. ২৬৭)।
আত্মিক ও দৈহিক ফায়দা : দৈহিক উৎকর্ষ সাধনে রোযার ভ‚মিকা অন্যতম। সিয়াম সাধনায় যেমন আত্মিক পরি”ছন্নতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে দৈহিক সুস্থতা। অধ্যক্ষ ডাক্তার বি সি গুপ্ত বলেছেন, ইসলাম সিয়াম সাধনার যে বৈজ্ঞানিক নির্দেশ দিয়েছে, তা যে মানুষের দৈহিক ও আত্মিক মঙ্গল সাধনে সক্ষম, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ডাক্তার আর ক্যামবারড বলেছেন, সিয়াম পরিপক্ব শক্তির সহায়ক। ডক্টর এমারসন বলেন, যদি কারো স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য উপবাসের প্রয়োজন হয়, তবে সে যেন ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী রোযা পালন করে। অতএব এ কথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে সিয়াম সাধনায় অর্জিত হয় দৈহিক ও আধ্যাত্মিক উভয় প্রকার ফায়দা।
ধৈর্য ও সহানুভূতির শিক্ষা দান : সিয়াম সাধনায় রয়েছে সিয়াম পালনকারীর জন্য ধৈর্য ও সহানুভূতির শিক্ষা। রোযা পালনের ফলে আত্মসংযম ও আত্মত্যাগের মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রোযাদারের দৈহিক, আত্মিক ও মানসিক অবস্থা পরিশুদ্ধ হয়। নিজে জঠরজ্বালা সহ্য করে এবং সমাজের গরিব-দুঃখী, ফকির-মিসকিন, যারা উপবাসে দিন কাটায়, তাদের অবস্থা অনুভব করে। তাই রমজান মাসকে বলা হয় ধৈর্য ও সহমমতার মাস।
রিপুসমূহ দমন করা : সিয়াম সাধনা রিপুগুলো দমন করে এবং আত্মার লালসা দূরীভূত করে মুমিনের দেহ ও মনে পরি”ছন্নতা আনয়ন করে। ফলে সিয়াম সাধনা আত্মশুদ্ধির অন্যতম সুযোগ। সিয়াম রিপুগুলো পুড়ে ছাই করে দিয়ে মুত্তাকি হওয়ার পরম সুযোগ করে দেয়। সিয়াম সাধনা অনর্থক কাজ, মিথ্যা বচন, প্রবঞ্চনা, পরনিন্দা, অশ্লীলতা, অসৎকর্ম, কর্কষ বাক্য ব্যবহার ইত্যাদি থেকে মুক্ত রাখে। মহানবী (সা.) বলেন, পাঁচটি জিনিকে সিয়াম নষ্ট করে দেয়। তা হলো মিথ্যা কথা, পরনিন্দা, কুটনামি, মিথ্যা শপথ ও কামভাবে দৃষ্টিপাত। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা কাজ করা ছাড়তে পারল না, তার পানাহার ত্যাগ তথা রোজা রাখা আল্লাহর কোনোই প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি, হাদিস : ১৭৭০)
আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করা : সিয়াম সাধনা মানুষকে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করে। ইমাম গাজ্জালি (র.) ‘ইয়াহইয়াউল উলুম’ গ্রন্থে বলেছেন, আখলাকে ইলাহির, গুণে মানুষকে গুণান্বিত করে তোলাই সিয়ামের অন্যতম উদ্দেশ্য। আল্লাহ তাআলা পানাহার করেন না। রোজাদার পানাহার বর্জনের ফলে আখলাকে ইলাহির গুণে গুণান্বিত হয়।
ফেরেশতার গুণে গুণান্বিত করা : সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদার ফেরেশতার গুণে গুণান্বিত হয়। ফেরেশতারা যেমন পানাহার করে না, রোজাদারও পানাহার করে না। ফলে পানাহার ও কামাচার বর্জনের দিক দিয়ে ফেরেশতা ও রোজাদার সমগুণে গুণান্বিত হয়। রোজাদারদের মর্যাদা এই যে, তার মুখের গন্ধ আল্লাহ তাআলার কাছে মৃগনাভির সুঘ্রাণের চেয়েও অধিক সুঘ্রাণ (মুসলিম, হাদিস: ১৯৪৫)।
নফসকে বিবেকের শাসন মানতে বাধ্য করা : মানব দেহের মূল অঙ্গ হলো নফস বা আত্মা। এই আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং মন্দ চিন্তা থেকে মুক্ত রাখার একমাত্র পন্থা হলো রোযা রাখা। নফস বা প্রবৃত্তিকে বিবেকের শাসন মানতে অভ্যস্ত করে তোলাই রোযার বিশেষ উদ্দেশ্য। প্রবৃত্তি ও বিবেক এই দুয়ের জয়-পরাজয় নিয়েই মানুষের মধ্যে পশুত্ব ও সততার জয়-পরাজয় সূচিত হয়ে থাকে। আর সিয়াম পালনের মাধ্যমেই ব্যক্তি পশুত্বের ওপর সততা ও অন্যায়ের ওপর ন্যায় বিজয়ী হয়। অন্য কোন ইবাদতের দ্বারা তা সম্ভব নয়।
পাপমুক্ত রাখা : সিয়াম সাধনা নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। হযরত জিবরাঈল (আ) দোয়া করেছেন, আর মহানবী (সা) আমিন বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাস পেল অথচ গুনাহগুলো মাফ করিয়ে নিতে পারল না, সে ধ্বংস হোক (আদারুল মুদরাবাদ, ইমাম বুখারি) এ দোয়া কখনো বিফলে যাবে না। এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তে দোয়া কবুল হয়। বিশেষ করে ইফতারের সময়, শেষ রাতে, কদরের রাতে, জুমার দিনে। এ মাসের দানে ৭০০ গুণ সওয়াব পাওয়া যায়। একটি নফল আদায় করলে ফরজের সমান সওয়াব পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা নিজে সিয়াম পালনকারীর প্রতিদান প্রদান করবেন বলে ঘোষণা করেছেন (মুসলিম, হাদিস : ১৯৪৫)। জান্নাতের একটি দরজার নাম রাইয়ান, যা দিয়ে শুধু রোজাদাররাই প্রবেশ করবেন। এ মাসের প্রথম ১০ দিন রহমতের, মধ্য ১০ দিন মাগফিরাতের এবং শেষ ১০ দিন নাজাতের। অতএব, সব দিক বিবেচনা করলে স্পষ্ট হয় যে, নিজেকে পাপমুক্ত রাখার এবং অধিক পুণ্য লাভের মুখ্য সময় হলো এ মাহে রমজান।
অনুপম ইবাদত : রোযা একটি অনুপম ইবাদত। তা দীর্ঘ সময় ধরে পালন করতে হয়। এ মাসে কুরআন সহ সকল আসমানী গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে, সকল উম্মতের উপর তা ফরজ দিন এবং তা লৌকিকতা মুক্ত ইবাদত।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ।