ঐতিহ্য মূলত আঞ্চলিক। আধুনিকতা মূলত সীমানা ডিঙ্গিয়ে যাওয়া। ঐতিহ্য প্রবাহিত হয় উত্তরাধিকারে। আধুনিকতা প্রবাহিত হয় আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবে। এখন এই ঐতিহ্য যেমন আঞ্চলিক, ঠিক তেমনই উত্তরাধিকারও সাম্প্রদায়িক। কথাটা শুনতে প্রথমেই মন সাড়া দেয় না, কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করা সম্ভব। মানুষের ইতিহাস মূলত বিভিন্ন অঞ্চলের ও জনপদের আঞ্চলিক ইতিহাস। সেই জন্যে ইউরোপের ইতিহাস আর ভারতবর্ষের ইতিহাস এক ধরণের নয়। আবার ভারতের ইতিহাস আর বাংলার ইতিহাসের মধ্যেও রয়েছে সাংস্কৃতিক পার্থক্য। তাই এই যে বিভিন্নতা, যা এক একটি জনপদকে কেন্দ্র করে এক একটি অঞ্চলে দিনে দিনে গড়ে ওঠে; যা মানুষের জীবন শৈলী, তার মন মানসিকতা, তার মূল্যবোধের দিগন্তে একটি আঞ্চলিক সংস্কৃতির জন্ম দেয়, সেইটই মূলত কালক্রমে সেই অঞ্চলের ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়ায়।
আবার এই যে দিনে দিনে ঐতিহ্যের নির্মাণ, এইটি সম্ভব হয় উত্তরাধিকার সূত্রে বংশপরম্পরায় বিশেষ একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের দৈননদিন চর্চার গণ্ডীতেই। আর সংস্কৃতি তখনই কোন না কোন উত্তরাধিকারের সামগ্রী হয়ে ওঠে, যখন তা কোনা না কোন সম্প্রদায়ের আপনার হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়, বিশেষ কোন একটি সাংস্কৃতিক জীবনশৈলীকে যাখন বংশপরম্পরায় বহন করতে থাকে, তখনই তাকে আমরা ঐতিহ্য বলে অভিহিত করে থাকি। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, যে উত্তরাধিকারের মাধ্যমে ঐতিহ্যের প্রবাহমানতা বজায় থাকে, সেই উত্তরাধিকার কিন্তু প্রকৃতিগত ভাবেই সাম্প্রদায়িক! তাই ঐতিহ্য যেমন আঞ্চলিক, উত্তরাধিকারও তেমনই সাম্প্রদায়িক। আর এই কারণেই অঞ্চলভেদে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিভিন্নতা আবিশ্ব বৈচিত্রের মধ্যে দিয়েই বিশ্বসংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে থাকে উত্তরাধিকারের মাধম্যেই। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তাই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের মধ্যেই দিয়েই সজীব থাকে। আর এই সজীবতা নির্ভর করে আঞ্চলিকতা ও সাম্প্রদয়িকতার উপরেই। কিন্তু আধুনিকতা বাদ সাধে এই আঞ্চলিকতা ও সাম্প্রদায়িকতার সাথেই। তাই প্রতি যুগেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতার একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিদ্যমান।
আধুনিকতা বরাবরই ঐতিহ্যকে ডিঙ্গিয়ে গিয়ে নতুন নতুন ঘরানা সৃষ্টির বিষয়ে সদা তৎপর থাকে। আর সেই প্রয়াসে সাম্প্রদায়িক উত্তরাধিকারকেই সে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকে। যত বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করে তত বেশি আধুনিক মননশীলতা চর্চার পরিসর গড়ে তুলতে পারে। এই যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতার একটা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করে আধুনিকতার নতুন পথনির্দেশ তৈরীর একাগ্র উদ্যোম;এইটিই হয়তো ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম। বস্তুত আজকে যা আধুনিকতা, কালক্রমে তাই ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়ায়। আবার যুগপরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে নবতর আধুনিকতার সাথে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের সম্মুখীন হয়।
আমরা সাধারণত নিজ সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করার সময় এত কিছু খেয়াল করি না। খেয়াল করি না, ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করাও আসলে সাম্প্রদায়িকতা। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যা আমাদেরকে বিশিষ্টতা দেয়, আমাদেরকে অন্যান্য সম্প্রদায়ের থেকে ভিন্নতর পরিচয়ে চিহ্নিত করে, তা আমাদেরই সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি। এই যে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আসলেই সাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যই এই কথাটি আমরা অধিকাংশ মানুষই খেয়াল করি না কখনো। আর এই সাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য যখনই নতুন প্রজন্মের হাত ধরে আধুনিকতার সাথে সম্মুখ দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়, তখনই আমরা সচকিত হই। ঐতিহ্যপন্থীরা গেল গেল রবে আধুনিকতার মুণ্ডুপাত করতে থাকি। আধুনিক প্রজন্মের ভবিষ্যত চিন্তা করে হাহাকার করে উঠি। আর আধুনিকতায় মোহগ্রস্ত নবপ্রজন্ম বিপুল উদ্যোমে তার সাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য থেকে ক্রমাগত দূরতর অবস্থানে স্থিতু হতে উদ্যোগী হয়। এই ভাবেই প্রতি যুগে পুরাতন প্রজন্মের সাথে নতুন প্রজন্মের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয়ে চলে। আর এইভাবেই সাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য, যাকে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বলে গর্ব করতে ভালোবাসি, তা কালের উজানে ধীরে ধীরে নবতর রূপ গ্রহণ করে। এই ভাবেই প্রবাহিত হয় সভ্যতার ইতিহাস।
ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের আগে, এক এক অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর অন্য অঞ্চলের প্রভাব এসে পড়ত যৎসামান্যই। আসলেও সেই প্রভাবের গণ্ডীও সীমাবদ্ধ থাকত মূলত পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মধ্যেই। কিন্তু তার মধ্যেও ব্যতিক্রম যে ছিল না তাও নয়। আদি ভারতবর্ষে আর্যদের পদার্পণে ভারতীয় ঐতিহ্য নতুন এক সংস্কৃতির জন্ম দিল, যাকে আমরা আর্যসংস্কৃতি বা বর্তমান কালের পরিভাষায় হিন্দুত্ব বলতেই মূলত পছন্দ করি। অনেক যাকে আবার সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতি বলে থাকেন। অনেক সময়েই আমরা কিন্তু খেয়াল রাখি না এই সনাতন ভারতীয় আর্যসংস্কৃতি আসলেই আদি ভারতীয় সংস্কৃতি নয়। আবার পরবর্তী কালে ভারতবর্ষে মোঘল পাঠানদের হাত ধরে বৈদেশিক ইসলামী সংস্কৃতির প্রবেশে ভারতীয় সংস্কৃতি কালক্রমে আরও এক নতুন রূপ গ্রহণ করল। এইভাবেই বৈদেশিক শক্তির কাছে পদানত হয়ে, আঞ্চলিক সাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও ধরণ বদলাতে থাকে। ঠিক যেমন প্রায় আড়াইশো বছর বৃটিশের পদানত থেকে বঙ্গসংস্কৃতির মধ্যে ঘটে গিয়েছে ব্যাপক ওলোট পালোট। একসময় কালাপানি পেরলে গোবর খেয়ে শুদ্ধ হতে হতো। তবেই রক্ষা হতো সামাজিক সম্মান। আজকে আবার বিদেশ পাড়ি না দিলেই বরং জাতে ওঠা যায় না। কিন্তু ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমান্বতি এক অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর অন্যান্য অঞ্চলের প্রভাবকে সুদূরপ্রসারী গুরত্বপূর্ণ করে তুলল। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ক্রমাগত অপরাপর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রভাবে আবর্তীত হতে থাকল যুগে যুগে। আর এইটি বেশি হল বৈদেশিক শক্তির শাসনাধীন উপনিবেশগুলিতে। ঠিক এই কারণে ইংল্যাণ্ডের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর বঙ্গসংস্কৃতির কোন প্রভাব পড়েনি, অথচ আজকের বঙ্গসংস্কৃতি বৃটিশ সংস্কৃতির প্রভাবে বিপুল ভাবে বদলে গিয়েছে বিগত আড়াইশো বছরের সময় সীমায়। কয়েক শতাব্দী আগে, পরাধীন ভারতে, সদ্য আগত বৃটিশ সংস্কৃতির প্রভাবে তৎকালীন বঙ্গসংস্কৃতির সাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যকে নিরন্তর প্রশ্নবিদ্ধ করতে শুরু করে আধুনিকপন্থীরা। আর ঐতিহ্যপন্থীরা আধুনিকপন্থীদের ম্লেচ্ছ বলে অভিহিত করে সমাজ রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার নিরন্তর উন্নতি, বৃটিশ শাসনের অমোঘ পরিণামে ইংল্যণ্ড সহ ইউরোপীয় সংস্কৃতির বিপুল প্রভাব আধুনিকপন্থীদের পায়ের তলার জমিকে শক্ত করতে থাকে কালক্রমে। আর সেই সূত্রেই ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই রূপবদল ঘটতে থাকে বঙ্গসংস্কৃতির আদলে। কিন্তু এই পরিবর্তন বা পরিবর্ধন কখনোই সর্বাত্মক বা সার্বিক হয় না কোথাও। তার কারণ নিহিত থাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাম্প্রদায়িক প্রকৃতিতেই।
যে কোন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রাণভোমরা ও রক্ষাকবচ, দুইটিই হল তার সাম্প্রদায়িক প্রকৃতির অন্তর্নিহিত শক্তিতেই। এই শক্তি যেখানে যখন যত বেশি প্রবল থাকবে, সেখানে তখন সেই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তত বেশি আপন স্বাতন্ত্রে সমুজ্জ্বল থাকবে। ইউরোপের অধিকাংশ জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই এই সত্যটি ধরা পড়ে। আমাদের বঙ্গসংস্কৃতির ঐতিহাসিক বিবর্তনে আবার একদিকে যেমন ক্রমাগত বৈদেশিক সংস্কৃতির বিপুল প্রভাব পড়েছে, ঠিক তেমনই আঞ্চলিক সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্রমাগত সেই প্রভাবের সাথে যুদ্ধ করে চলেছে নিরন্তর। এই দ্বান্দ্বিক পরিমণ্ডলেই গড়ে উঠেছে আজকের বঙ্গসংস্কৃতির ভুবন। যেখানে ক্রমাগত গ্রহণ বর্জনের পালা চলেছে। আর সেই পালায় নিরন্তর পরীক্ষা দিয়ে চলে সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির অভ্যন্তরীণ শক্তি। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এইভাবেই একদিকে যেমন নিজেকে রক্ষা করতে প্রয়াসী হয়, ঠিক তেমনই কালের নিয়মে তার উপর আধুনিকতার প্রভাব পড়তে থাকে নিরন্তর।
এখন প্রশ্ন হল ব্যক্তি মানুষ, বিশেষত আধুনিক যুগের মানুষ তার ব্যক্তি জীবনের পরতে পরতে কিভাবে এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও আধুনিকতার পারস্পরিক সংঘাতের দ্বান্দ্বিক পরিমণ্ডলে সামঞ্জস্য আনতে পারে! বস্তুত সেটি নির্ভর করে প্রতিটি মানুষের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাদীক্ষা ও মননের উপরেই। কিভাবে সে তার সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর সাথে তার পরিপার্শ্বের আধুনিক যুগ প্রবাহের প্রভাবের সমন্বয় সাধন করবে, সেটি নিতান্তই তার নিজস্ব বিষয়। কিন্তু এইখানে সামাজিক শিক্ষার ও পারিবারিক সংস্কৃতির একটি বড় ভুমিকা আছে। বিশেষত শৈশব থেকে যে সামাজিক ও পারিবারিক পরিবেশে আমরা বেড়ে উঠি, তার প্রভাব অপরিসীম। আমাদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে এর ভুমিকা কোনভাবেই অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সাধারণত দেখা যায়, সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামী যে পরিবারে বা যে সমাজে যত বেশি, সেই পরিবার বা সমাজে ব্যক্তি মানুষ তত বেশি তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। আবার উল্টোটা হলে নিজ সংস্কৃতির আবহমান ঐতিহ্য সম্বন্ধে উদাসীনতা ব্যক্তি মানুষকে তার শিকড় থেকে সহজেই বিচ্ছিন্ন করে তুলতেও পারে। কিন্তু ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয় আনতে গেলে প্রয়োজন প্রকৃত শিক্ষার সর্বাত্মক ও সার্বিক বিকাশে। ইউরোপের উন্নত দেশগুলিতে যার নিদর্শন দেখা যায়। এবং একথাও সমান সত্য যে, আশৈশব বেড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে পরিপার্শ্বের আধুনিকতার নিরন্তর টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়েই আমাদের নিজ নিজ ব্যক্তিত্বের প্রকৃত স্ফূরণ ঘটে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সমাজের সর্বত্র ব্যপক শিক্ষা বিস্তারের। যে সমজে শিক্ষা বিস্তার যত ব্যাপক, সেই সমাজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয় সাধনে তত বেশি সফল!
ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী ফল আবিশ্ব প্রায় সকল দেশেই এই সমন্বয় সাধনের কাজকে তরান্বিত করেছে। আর সেই নিদর্শন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি বিংশ শতক অব্দি সময়সীমায়। কিন্তু একবিংশ শতকের একে বারে গোড়ায় ইন্টারনেট প্রযুক্তির হাত ধরে আবিশ্ব যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের ফলে আঞ্চলিক সংস্কৃতির উপর আধুনিকতার প্রভাব প্রায় সর্বাত্মক হয়ে উঠেছে। ফলে আপনাপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব অদূর ভবিষ্যতে কতটুকু ধরে রাখা সম্ভব হবে সে কথা প্রশ্নের সম্মূখীন আজ। হাতের মুঠোয় ইনটানেটে গোটা বিশ্বই আজ সকলের নাগালের মধ্যে চলে আসেছে দ্রুত। তার ফলে বিশেষত ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস বহনকারী অঞ্চলগুলির আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আজও যতটুকু অবশিষ্ট আছে, তাও কতটুকু বজায় থাকবে,সে কথাও বলা মুশকিল খুব। আবার একথাও ঠিক, ইনটারনেট পূর্ববর্তী সময়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধ্যানধারণা এই ইনটারনেট শতকের শেষ দিকে কতখানি বজায় থাকবে, বা কতখানি পরিবর্তিত হবে সে কথা কেউই জোর দিয়ে বলতে পারে না! আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যা মূলত আমাদেরই সাম্প্রদায়িক পরিচয় বহনকারী, যেখানে আমাদের অস্তিত্বের আসল শিকড়: সেই পরিচয়ের কতটুকু এই ইনটারনেট শতকে অবশিষ্ট থাকা উচিত, সে কথাও আজ ভাবনার পরিসরে উঁকি দিচ্ছে বৈ কি। একদিকে যেমন নিজ নিজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শিকড় ছাড়া মানুষের আত্মপরিচয় গড়ে ওঠে না, আবার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতার সঠিক সমন্বয় সাধন ছাড়াও ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ সম্ভবপর নয়! কিন্তু ইনটারনেট বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কতটুকু বজায় থাকে, সেটাও যেমন একটা বড় প্রশ্ন। ঠিক তেমনই এটাও ভেবে দেখার বিষয়, ইন্টারনেট বিপ্লব আবিশ্ব মানুষের সমাজকে একটি বৃহত্তম ও সাধারণ বিশ্ব সংস্কৃতিতে যদি বেঁধেও ফেলতে পারে, তাতেই বা ক্ষতি কি? বরং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে মানুষে মানুষে বর্তমান নানান প্রকার ভেদাভেদ দূর করে ইনটারনেট বিপ্লব যদি, সারা বিশ্বের মানুষকে একটি সাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে নিয়ে আসতে পারে,তবে তো বিশ্বভ্রাতৃত্বের অধরা স্বপ্নটিও পূরণ হতে পারে! আর সেক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও আধুনিকতার শাশ্বত দ্বন্দ্বটিও সমন্বয়ের মিলন ক্ষেত্রে বিলীন হতে পারে।
অনেকেই হয়তো, হয়তো কেন নিশ্চিত ভাবেই বলে উঠবেন, তা যদি সত্যি হয় তবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্নতা মানুষকে যতই আধুনিক করে তুলুক না কেন, তার ব্যক্তিত্বকে কখনোই সম্পূর্ণ করে তুলতে পারবে না। এমনটাও বলবেন নিশ্চয়ই অনেকেই যে, মানুষের সভ্যতা তার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নান্দনিক বৈচিত্র হারিয়ে সুরবিহীন নিস্প্রাণ সংলাপে পরিণত হবে। বৈচিত্রের মধ্যে যে ঐক্য তাই তো সভ্যতা সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে তোলে। কিন্তু বৈচিত্রহীন বিশ্ব বেসুর বাঁশরীর মতোই অসহ্য লাগবে। তখন কবির কথায় “বিণাহীন সভায় যন্ত্রীর আঙুল নাচবে, বাজবে না সুর” এবং সময়ই বলবে ভবিষ্যতের মানুষ তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের সাথে আধুনিকতার সমন্বয় সাধন করবে ঠিক কোন পথে! ততদিন আমাদেরকে আমাদের নিজ নিজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতার সঠিক সমন্বয়ের প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে নিরন্তর। তবেই আমরা পৌঁছাতে পারব আপনাপন ব্যক্তিত্বের কাঙ্খিত পূর্ণতায়।
লেখক : ব্যাংকার, কবি ও প্রাবন্ধিক।