fenirshomoy logo black

রশিদ আহমদ শাহীন

শরীরের যেমন রোগ আছে, তেমনি আত্মারও রোগ আছে। আত্মা যদি সুস্থ হয়ে যায় তাহলে মানুষের বাহ্যিক আচার ব্যবহারও ভালো হয়ে যাবে। মানুষের ভেতর পাপাত্মা থাকলে তার আচার ব্যবহারেও দেখা দেবে বিভিন্ন অসঙ্গতি। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা হিংসা থেকে দূরে থাকো। হিংসা নেক আমলগুলোকে তেমনি বরবাদ করে দেয়, যেমন আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে ফেলে।’ অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের পূর্ববর্তীদের মাঝে যত মারাত্মক রোগ ছিলো, সেগুলো তোমাদের মাঝে চলে এসেছে। হিংসা এবং রেষারেষি সবকিছুকে মুণ্ডিয়ে ফেলে। মুণ্ডানো দ্বারা উদ্দেশ্য চুল মুণ্ডানো নয় বরং দ্বীনকে মুণ্ডিয়ে দেয়া। (তিরমিজি)

মানুষের স্বভাবজাত হলো ভালোর প্রতি আগ্রহ ও মন্দের প্রতি ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা। কিন্তু মানুষ কখনো উল্টো পথে চলে, মন্দের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, মন্দের পেছনে ছোটে। ভালোর প্রতি অনীহা প্রদর্শন করে, ভালো থেকে দূরে থাকে। কিন্তু এটা মানুষের স্বভাবজাত নয় এবং তার সফলতার পথও নয়। স্বভাববিরুদ্ধ নিজের অকল্যাণের পথ থেকে ফেরাতে আল্লাহ বহুভাবে তাঁর বান্দাদের উৎসাহিত করেছেন। পুরস্কার ও পরিণাম তুলে ধরেছেন।

আখলাকে সায়্যিআর মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষের বিষয়টি মারাত্মক ক্ষতিকর। অন্যের সুখ-সম্পদ নষ্ট হয়ে নিজে এর মালিক হওয়ার কামনা করাকে হিংসা (হাসাদ) বলা হয়। অপরের প্রতি হিংসা করা হারাম।

এ অবস্থার কেন্দ্র যেহেতু নফস ও আত্মা, তাই আল্লাহ তাআলা এ নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলেছেন- ভালো পথে পরিচালিত করতে বলেছেন, মন্দ পথ থেকে ফেরাতে বলেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, অবশ্যই সে সফল হয়েছে, যে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে। আর সে ব্যর্থ হয়েছে, যে তা বিনষ্ট করেছে। -সূরা শামস (৯১: ৯-১০)

যেসকল মন্দ চরিত্র ও স্বভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হল হিংসা। আসুন আমরা আমাদের আত্মাকে হিংসা থেকে পরিশুদ্ধ করি। জেনে নিই এর উৎস, ক্ষতি ও প্রতিকার।হিংসা তৈরি হয় দৃষ্টির অপব্যবহার ও দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা থেকে। একটু ব্যাখ্যা করলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে।

আল্লাহ তাআলা হলেন রাযযাক- মহা রিযিকদাতা। তিনি হাকীমও-প্রাজ্ঞ হেকমতওয়ালা। কাউকে ধনী বানান, কাউকে দরিদ্র। এই শ্রেণিভেদ তাঁর হিকমাহ ও প্রজ্ঞারই অংশ। এরই ওসিলায় সচল থাকে জীবনের চাকা। বান্দার কাজ হল, আল্লাহর বণ্টনের প্রতি রাজি থাকা- শোকর ও সবরের মাধ্যমে। আমরা যেন অকৃতজ্ঞ ও অধৈর্য না হই, তাই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিখিয়েছেন- পার্থিব বিষয়ে যেন নিজের চেয়ে নিচের ব্যক্তির দিকে তাকাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-তোমাদের চেয়ে যে উপরের অবস্থানে আছে তার প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে যে নিচের অবস্থানে আছে তার প্রতি দৃষ্টি দাও। তাহলে তোমাদের প্রতি আল্লাহ্-প্রদত্ত নিআমত ও অনুগ্রহকে তুচ্ছ মনে হবে না। (জামে তিরমিযী, হাদীস-২৫১৩)

হিংসার ক্ষতি : হিংসা দ্বারা না হিংসুকের রিযিক বাড়ে আর না যার প্রতি হিংসা করা হয় তার রিযিক কমে। অধিকন্তু এতে হিংসুকের জন্য রয়েছে সমূহ ক্ষতি। যেমন: হিংসুকের অন্তর আমরণ অস্থিরতায় ভোগে। কারণ হিংসা আগুন। হিংসুক যখন অন্যের উন্নতি সহ্য করতে পারে না, হিংসার আগুনে নিজেই জ্বলে মরে।রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-হিংসা থেকে সাবধান! কেননা হিংসা নেকীকে এমনভাবে ধ্বংস করে; যেমন আগুন লাকড়ি ধ্বংস করে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস-৪৯০৩)

হিংসা বহু হারাম কাজের দরজা খুলে দেয়ও ঈমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে : অন্তর যখন হিংসায় আক্রান্ত হয়; হাত-পা, মুখ-মাথা ইত্যাদি অঙ্গগুলোও এর থেকে রেহাই পায় না। মাথায় অন্যের ক্ষতিসাধনের চিন্তা, চোখে দোষ খোঁজা, মুখে দোষ চর্চা ও নিন্দা এবং হাত-পা ও মুখ দ্বারা জান, মাল ও ইজ্জত আব্রুতে আঘাত করা যেন হিংসুকের যথারীতি অভ্যাসে পরিণত হয় ।হায়, এক হিংসা কতগুলো হারাম কাজের দরজা খুলে দেয়। হিংসার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল, এটি ঈমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কারণ ঈমানের দাবি হল, আল্লাহ তাআলাকে রব বলে স্বীকার করা এবং তাঁর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকা। হিংসার সারকথা হল, আল্লাহর ফয়সালা ও বণ্টনের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা। বান্দার এ অবস্থা যে তার ঈমানকে মারাত্মকরূপে ক্ষতিগ্রস্ত করে তা বলাই বাহুল্য। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কারো অন্তরে ঈমান ও হিংসা একত্র হতে পারে না। (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস-৪৬০৬)

হিংসা দমনের পদ্ধতি : কারো প্রতি হিংসা অনুভব হওয়া মাত্রই দুটি কথা চিন্তা করা: ক. এই হিংসা দ্বারা না আমার রিযিক বাড়বে আর না যার প্রতি হিংসা করছি তার রিযিক কমবে। উপরন্তু এর কারণে আমার ঈমান আমল ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দুনিয়া ও আখেরাত বরবাদ হবে। তাই আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা এমন জিনিসের বাসনা করো না, যার দ্বারা আল্লাহ তোমাদের একজনকে অন্য জনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। পুরুষদের জন্য রয়েছে তাদের উপার্জনের অংশ আর নারীদের জন্য রয়েছে তাঁদের উপার্জনের অংশ। আর তোমরা আল্লাহর নিকট তাঁর দয়া প্রার্থনা কর। নিশ্চয় নিকট তার প্রশংসা করা, সামনে পড়লে তার তাযীম করা এবং মাঝে মাঝে তার কাছে হাদিয়া পাঠানো। এ এমন এক এলাজ, যা বিশেষ এলাজসমূহের চেয়ে দ্রুত ও সহজলভ্য।

খ. আমার কল্যাণ-অকল্যাণ আমার চেয়ে আমার আল্লাহ্ই ভালো জানেন। সুতরাং আমার নসীবে তিনি যা দিয়েছেন তা-ই আমার জন্য কল্যাণকরা। তাতেই আমার তুষ্ট থাকা উচিত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, হতে পারে, তোমরা একটি জিনিস অপছন্দ কর, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং একটি জিনিস পছন্দ কর; অথচ তা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না। -সূরা বাকারা (২: ২১৬)

এগুলো করতে বেশ কষ্ট হবে। কিন্তু এই কষ্ট তো আমার ঈমান-আমল রক্ষার জন্য, আমার চিরস্থায়ী শান্তির জন্য। এ তো রহমতের বারিধারা বর্ষণের পূর্বে ধুলোবালি ওড়া, ঘন কালো মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ও মেঘগর্জন। আসুন আমরা হিংসা দমন করি। হিংসার আগুন আর আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে রক্ষা করি নিজেকে। শান্তিময় জীবনের অধিকারী হই। প্রতিজ্ঞা করি, আমাকে বাঁচতেই হবে এ মরণব্যাধি থেকে।

লেখক : অধ্যক্ষ, তাযকিয়াতুল উম্মাহ মডেল মাদ্রাসা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!