কিশান মোশাররফ
‘শোক থেকে শক্তির অভ্যুদয়, স্বপ্ন পূরণের দৃঢ় প্রত্যয়’ শিরোনামে ‘ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক মাসব্যাপী চিত্রকর্ম প্রদর্শনী চলছে ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারীতে।
একাডেমির ১ নম্বর গ্যালারীর কাঁচের দরজা ডিঙিয়ে পা পেলতেই থমকে দাঁড়াতে হয়। বিশাল ক্যানভাসে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ছবি। শিল্পীর নিপুন হাতের ছোঁয়ায় রংয়ের পরিমিত ব্যবহার যা কোনোক্রমেই মাত্রা ছাড়িয়া যায়নি, মুখাবয়ব থেকে কালো কোর্ট ক্যানভাসের প্রতি ইঞ্চি জমিনে শৈল্পিক আবহে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিত্বের প্রগাঢ়তা ঋজু নম্রভাবেই ফুটে উঠেছে। ছবির বঙ্গবন্ধুকে এড়িয়ে গ্যালারির অন্য ছবিতে চোখ ফেরানোই দুস্কর। গ্যালারীর ডানদিক হয়ে আমন্ত্রিত সিনিয়র শিল্পীদের ভাবনায় উঠে আসা বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের চিত্রায়ণ চোখে পড়বে। দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধু, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে মানুষের ভালোবাসার বঙ্গবন্ধুকেই খুঁজে পাওয়া যাবে প্রদর্শনীর প্রতিটি ছবিতে। চিত্রশিল্পী হাশেম খান, শিল্পী সৈয়দ আবুল র্বাক্ আলভী, হামিদুজ্জামান খান, মনিরুল ইসলাম, আব্দুস শাকুর শাহ, আব্দুল মান্নান, বীরেন সোম, শহিদ কবীর, মো. ইবরাহিম, অলকেশ ঘোষ, বিপদ ভঞ্জন সেন কর্মকার, মোহাম্মদ ইউনুস, জামাল আহমেদ, রণজিৎ দাস, অশোক কর্মকার, আলপ্তগীন তুষার, ফরিদা জামান, মিমি করিম প্রমুখের চিত্রকর্ম দেখতে দেখতে প্রতিশ্রæতিশীল তরুণ ও নবীন শিল্পীদের ভাবনায় অংকিত ছবি হৃদয়ে বহু আবেগ অনুভূতির উদ্রেক জাগাবে নিঃসন্দেহে।
প্রতিশ্রতিশীল তরুণদের মধ্যে নাহিদা লিরা, জান্নাতুল ফেরদৌস, হাসুরা আক্তার, সুনন্দা রানী বর্মন, দিদারুল হোসেন, সুজন মাহবুব, সৌরভ চৌধুরী, সুমন ওয়াহিদ প্রমুখের চিত্রকর্মও দেখা যাবে প্রদর্শনীতে।
ফরিদা জামানের ছবির ক্যাপশন সিটে লেখা ‘মানুষ চায় কি জীবনে? কেউ চায় অর্থ, কেউ চায় শক্তি, কেউ চায় সম্পদ, কেউ চায় মানুষের ভালোবাসা। আমি চাই মানুষের ভালোবাসা।’ মানুষের ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন। হৃদয় উজাড় করা অকৃত্রিম ভালোবাসার মায়াবী সুতোর বাঁধনে মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন। তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভাবনাও শিল্পীর রং তুলিতে উঠে এসেছে।
নিপীড়িত-নির্যাতিত-মুক্তিকামী-স্বাধীনতাকামী মানুষের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক দৃঢ়চেতা প্রতিবাদী চরিত্রের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাঁর তর্জনী যেন সাত কোটি বাঙালির বিপ্লব, সাম্য, স্বাধীনতা, মুক্তি ও শান্তির মূর্ত প্রতীক। তাইতো শিল্পীর বিমূর্ত ভাবনার বহু রৈখিক ক্যানভাসে তর্জনী উঁচিয়ে ওঠা শাহাদাত আঙ্গুল শুধু হানাদারদের আতংক হয়ে ধরা দেয়নি এখনো দেশমাতৃকায় উন্নয়ন ও মানবতার শত্রুদের জন্য আতংকের প্রতীক হয়ে আছে। ঝুলপড়া পুরনো কোনো ক্যানভাসের সূচী চিত্রায়নে সেই তর্জনী পুরনো নয় ভাবে ভাষায় জীবন্ত। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার, আলবদর, হানাদারদের নৃশংসতায় বুদ্ধিজীবি হত্যার নির্মম চিত্রও উঠে এসেছে শিল্পীর তুলিতে।
১৫ আগষ্টের শোক চিত্রিত হয়েছে বেশ কয়েকটি ছবিতে। বঙ্গবন্ধুকে প্রধান চরিত্র করে সাদা-কালোয় আঁকা পরিবার পরিজনের ছবি দর্শনাথীর মনকেও ভারাক্রান্ত করে তুলবে।
কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে যেমন বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ এই প্রদর্শনী দেখে দর্শক হিমালয়ের মত অটল, অনড়, ভীরুতাহীন দেশ প্রেমিক বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পাবেন।
১ আগষ্ট সোমবার থেকে শুরু হওয়া ‘ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের এই চিত্রকর্ম প্রদর্শনী চলবে ৩১ আগষ্ট বুধবার পর্যন্ত। ঐ দিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন চিত্রশিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: আবুল মনসুর, বিশেষ অতিথি ছিলেন চিত্রশিল্পী হাশেম খান।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে শোকাবহ আগস্টকে কেন্দ্র করে মাসব্যাপী ‘ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক চিত্রকর্ম প্রদর্শনীতে মোট ২০৮টি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে । এর মধ্যে ভাষা আন্দোলনের ওপর ৩৭টি, মুক্তিযুদ্ধের ওপর ৫০টি এবং ‘বঙ্গবন্ধু: স্বাধীনতার মৃত্যুঞ্জয়ী কবি’ আর্টক্যাম্পে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ১২১ জন শিল্পীর আঁকা ১২১ টি চিত্রকর্ম। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সবার জন্য প্রদর্শনী থাকছে উন্মুক্ত। শুক্রবার খোলা থাকবে বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।
শোকাবহ বেদনাদায়ক ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর ৪৭ তম শাহাদাত বার্ষিকী। একজন স্বপ্নবান স্বাধীন রাষ্ট্রের জনক’কে স্বপরিবারে হত্যা করা হলেও নিপীড়িত-নির্যাতিত-মুক্তিকামী-স্বাধীনতাকামী তথা বাঙালী জাতির সুমহান স্বপ্নদ্রষ্টা বীর পুরুষের মৃত্যু হয়না। তিনি মিশে আছেন বাংলার মাঠ, ঘাট সবুজ প্রান্তরে। জেগে আছেন মানুষের ভালোবাসার মনিকোঠায়। এই প্রদর্শনীর আয়োজন বঙ্গবন্ধুকে নতুন প্রজন্মের কাছে মর্যাদা ও বীরত্বের আসনে আসীন করবে।
লেখক : চিত্রশিল্পী, নাট্যকার, কলামিস্ট ও সাংবাদিক।