মো: মাঈন উদ্দীন
সংস্কার, নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা, পতিত স্বৈরাচারের বিচারের ব্যবস্থা ইত্যাদি যাই বলিনা কেন সব কিছুর মূলে রয়েছে অর্থনীতি। অর্থনীতিকে সচল করা, অহেতুক খরচ না করা, দ্রব্য মূল্য মানুষের সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসা, বেকারত্ব দূর করা এবং জীবনযাপনে স্বস্তি ফিরে আসা এগুলোই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। দেশটা সুন্দর ভাবে চলুক, হিংসা ভেদাভেদ না করে একটি গতিশীল অগ্রগামী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাক। দেশ বিরোধী,ষড়যন্ত্র কারী বিগত পেচিষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। সবকিছু সম্ভব হবে তখনই যখন দেশের অর্থনীতি একটি মজবুত কাঠামোর ওপর দাড়াবে। তাই অর্থনীতির পথকে সুগম করতে হবে। এ পথের সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। সমাধানের পথ বের করতে হবে। বাঁধা সমূহ দূর করতে হবে। অবশ্য ইতিমধ্যে দেশের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ধীরে ধীরে গতি ফিরছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর অর্থনীতির কয়েকটি সূচকে ইতিবাচক ধারায় চলে এসেছে। বর্তমানে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। স্বস্তিদায়ক অবস্থায় রয়েছে রপ্তানি আয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতিও ওঠা-নামার এখনো রয়েছে। তবে সামনের দিনে এটা মানুষের সাধ্যের মধ্যে চলে আসবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। খাদের কিনারে থাকা অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে একটু তো সময় লাগবেই। পাশাপাশি অস্থির ডলারের বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনও কমার দিকে। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের নাজুক পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বস্তির দিকে আসছে। তবে নিত্যপণ্যের বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বেসামাল কাঁচাবাজার। দামের চাপে নিম্নআয়ের মানুষ দিশেহারা। পিয়াজ থেকে শুরু করে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, আলু কিনতে ভোক্তাকে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ৬টি অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক কর কমানো সহ বেশ কিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে অন্তর্র্বতী সরকার। তবুও তেমন সুফল আসচেনা। তবে শীত মৌসুম শুরু হওয়া সবজির বাজারে ধীরে ধীরে দাম কমে আসছে।
আশার দিক হলো অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রেমিট্যান্স। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের পর অক্টোবর মাসেও বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছে প্রবাসীরা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৮৯৩ কোটি ৭১ লাখ (৮.৯৪ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি আয়েও সুখব দেখা যাচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই- সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ১ হাজার ১৩৭ কোটি (১১.৩৭ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একইসময়ে এই আয়ের অঙ্ক ছিল ১ হাজার ৮২ কোটি ডলার। এখাতে আমাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। দেশে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রহন যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে মালয়েশিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্যে বেশি বেশি জনশক্তি পাঠিয়ে রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। অন্যদিকে রিজার্ভের কথা বলতে গেলে বলতে হয় এক্ষেত্রেও ধীরে ধীরে সাফলতা দেখা দিবে।
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে (এসিইউ) ১৫০ কোটি ডলার পরিশোধের পর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। আইএমএফ’র বিপিএম-৬ মানদণ্ড অনুযায়ী, রিজার্ভের পরিমাণ এখন ১৮.১৯ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের কারণে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সাময়িকভাবে ২০ বিলিয়ন ডলার স্পর্শ করে দেশের রিজার্ভ। তবে গত ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার বিক্রি করছে না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ছে। সমস্যা হল বাজারে অস্বস্তি। বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু এখনো ৭০-৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আলুর পাশাপাশি বাজারে খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দামও বাড়তি। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৭০ থেকে ১৭২ টাকা ও খোলা পাম তেল ১৬২-১৬৩ টাকায় বিক্রি হয়। এক মাসের ব্যবধানে খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ১৬-১৭ টাকা ও খোলা পাম তেলের দাম ১৩ টাকা বেড়েছে। গত সপ্তাহে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহে কিছুটা সংকট ছিল। মঙ্গলবার ভোজ্য তেল আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর ৫ শতাংশ কমানোর সরকারি সিদ্ধান্তের পর বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। সরকারকে বাজার তদারকি জোরদার করতে হবে। মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহন করতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের অর্থনীতিতে তিন ধরনের ঝুঁকির পাশাপাশি দুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দা এবং দারিদ্র্য ও বৈষম্য–– এই তিন ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকির পাশাপাশি আলোচ্য সময়ে তিন ধরনের সামাজিক ঝুঁকিও রয়েছে। যেগুলো হলো–– বেকারত্ব, জ্বালানি ঘাটতি এবং হৃদরোগ, ক্যানসার ও ডায়াবেটিস রোগের প্রাদুর্ভাব; অর্থাৎ স্বাস্থ্যখাতের দুরবস্থা ও সামাজিক অবক্ষয়। অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি করতে হলে বাংলাদেশে ডুয়িং ব্যবসা করার জন্য সমস্যা সমূহ চিহ্নিত করতে হবে। সমস্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- দুর্নীতি, আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা, বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, উচ্চ করহার ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি।
অর্থনীতিকে টেকসই ও গতিশীল করতে সমস্যা সমূহ পর্যায়ক্রমে দূর করতে হবে। এদিকে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ইস্যুয়ার ও সিনিয়র আনসিকিউরড ঋণমান বি১ থেকে অবনমন করে বি২ তে নামিয়েছে মুডিস রেটিংস। আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী সংস্থাটি বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে তাদের পূর্বাভাসকে এর আগে স্থিতিশীল বলেছিল, যা এখন নেতিবাচকে নামিয়েছে।
মুডিস বলেছে, চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও দুর্বল হয়ে পড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের সরকারকে তার অর্থায়নের ঘাটতি পূরণে স্বল্পমেয়াদী অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর আরও বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে, এতে বাড়ছে তারল্য ঝুঁকি। আবার ব্যাংকখাতে ঋণ সম্পদের উচ্চ ঝুঁকি এবং এখাতে মূলধন ও তারল্য দুই’ই কম থাকায় সরকারের ওপর এ খাতকে জরুরি অবস্থায় সহায়তা প্রদান বা আকস্মিক দায়বদ্ধতার ঝুঁকিও বাড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক মুডিস’র সাম্প্রতিক রেটিংয়ে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি বলে দাবি করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, পরিবর্তন সম্পর্কে মুডিস যে রেটিং করেছে তা গাড়ি সামনে চলার সময় ‘রিয়ারভিউ মিরর দিয়ে দেখার’ শামিল। অর্থনীতি বিশ্লেষক ও বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার পর্যালোচনা থেকে বলা যায় বাংলাদেশের অর্থনীতির চল্রা পথে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা বা সমস্যা সমূহ দূর করে অর্থনীতির গতি পথকে মসৃন করতে করতে হবে। কাঙ্খিত সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী সহ সকল বিপ্লবী ছাত্র জনতার প্রত্যাশা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। গড়ে উঠবে অর্থনীতির মজবুতভিত।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার।