রশিদ আহমদ শাহীন :
মানুষ সামাজিক জীব। সৃষ্টির সেরা মানবমন্ডলীকে আল্লাহ তা’য়ালা পারিবারিক ও সমাজবদ্ধ ভাবে সৃষ্টি করেছেন। পারিবারিক ও সামাজিক চেতনাবোধ থেকেই মানুষ পরস্পরের সাথে মিলেমিশে বসবাস করতে চায়। এটা মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব।
আত্মীয় বলতে আমরা বুঝি আপন লোকজনকে। এক বংশ ও রক্ত যার শরীরে বহমান তিনিই রক্ত সম্পর্কের আপনজন। কুটুম্বিতার দরুন ও আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আত্মীয়তার সম্পর্ক আবার কাছের ও দূরেবিভাজনে বিভক্ত। সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রেক্ষপট। মোট কথায় আত্মীয়স্বজন বলতে আমরা বুঝি আত্মিক সম্পর্ক, যিনি আমার সুখেসুখি, আমার দুঃখে দুঃখি, তিনিইআমারআত্মীয়। যিনিআমার উন্নতি/অগ্রগতিতে আনন্দিত হবেন, বিপদের সময় পাশে থাকবেন, আমার কল্যাণ কামনা করবেন, পেছনে অযথাবদনামকরবেননা, আমার সাথে মিত্ররূপী শত্রুর মতো আচরণ করবেন না, আমার স্বার্থ ক্ষুন্ন করবেন না, তিনিই আমার আত্মার আত্মীয়, পরম স্বজন।
মহান আল্লাহ তা’য়ালা পারিবারিক বন্ধন সৃষ্টি করে এক অনাবিল শান্তির আয়োজন করে দিয়েছেন। মাতা-পিতা, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, চাচা-ফুফু, নানা-নানী, মামা-খালা, শ^শুর-শাশুরি সবাই আমাদের জন্য মহান রবের পক্ষ থেকে এক অপূর্ব ও অফুরন্ত নেয়ামত। আমরা একে অপরের সান্নিধ্যে উপভোগ করি নিবি প্রশান্তি । তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা যেমন অত্যাবশ্যকীয়, এ সম্পর্ক ছিন্ন করাও কবিরাহ গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারীর জন্য রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে যেমন রয়েছে পুরস্কার তেমনই এ সম্পর্ক ছিন্নকারীর জন্য রয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারী।
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার পরিণতি :
মহান রবের পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য মনোনীত সর্বজনীন ধর্ম ইসলাম আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুন্ন রাখতে সর্বোচ্চ গুরুত্বরোপ করেছে। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর প্রতি কঠিন শাস্তি বা আযাবের কথা ঘোষণা করেছে। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার উল্লেখযোগ্য পরিণতি নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-
১. আল্লাহর লা’নত বা অভিসম্পাত প্রাপ্ত হবে
মহান আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীদের নিন্দা করেছেন এবং তারা মহান রবের লা’নত বা অভিসম্পাতপ্রাপ্ত হবে বলে উল্লেখ করেছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
“যারা আল্লাহর (ইবাদত করার) দেয়ার প্রতিশ্রুতির পর তা লংঘন করে, আর (আত্মীয়তার) সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখার আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে এবং পৃথিবীতে বিচ্ছৃংখলা সৃষ্টি করে, তাদের উপর আল্লাহর লা’নত বা অভিশাপ। আর আখেরাতে তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট আবাস।”
“ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকরবে। আল্লাহ এদেরকে করেছেন অভিশপ্ত, বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন।”
২. নেক আমল সমূহ কবুল হবেনা :
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর নেক আমল মহান আল্লাহ তা’য়ালা কবুল করেন না। আদম সন্তানের আমল সপ্তাহে একদিন আল্লাহ নিকট পেশ করা হয়। আল্লাহতা’য়ালাআত্মীয়তারসম্পর্ক ছিন্নকারীর আমলসমূহ প্রত্যাখান করে। আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনÑ
“আদম সন্তানের আমল (সপ্তাহের) প্রতি বৃহস্পতিবার দিবাগত জুম’আর রাতে আল্লাহর নিকট পেশ করা হয়। কিন্তু আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর কোনো আমল কবুল হয় না।”
৩. জান্নাতে প্রবেশ করবেনা :
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর কঠোর শাস্তি সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসে বর্ণনা এসেছে। তারাজান্নাতেপ্রবেশকরবেনাবলেমহানবী ঘোষণা দিয়েছেন। যুবাইর ইবনে মুতইম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
“আত্মীয়তারসম্পর্ক ছিন্নকারীজান্নাতেপ্রবেশ করবেনা।”
আবু মুসা আশয়ারী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-“তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবেনা, অভ্যস্ত মদ্যপায়ী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ও যাদুতে বিশ^াসী।”
৪. দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে শাস্তিপাবে :
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর শাস্তি শুধু আখিরাতে ইসীমাবদ্ধ নয়, বরং তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে উভয় জগতেই শাস্তি পেতে হবে। এ প্রসংগে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
“দুনিয়াতে যে (দুই) অপরাধের শাস্তি আল্লাহ তা’য়ালা অত্যন্ত দ্রুত কার্যকর করে থাকেন এবং আখেরাতেও এর শাস্তি অব্যাহত থাকবে, সে দু’টি অপরাধ হলো, ইসলামী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাএবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা।”
৫. আল্লাহ তা’য়ালা সম্পর্ক ছিন্ন করবেন :
কেউ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করলে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা’য়ালা ও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন-
“আমি রহমান। আমি আত্মীয়তার জন্য আমার নাম থেকে একটি নাম বাছাই করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে আমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবো। আর যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে আমিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবো।”
আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপর হাদিসে বলেছেন-
“রহম শব্দটি রহমান থেকে গৃহীত। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- যে তোমার সাথে রক্তের সম্পর্ক বজায় রাখবে, আমিতার সাথে সম্পর্ক রাখবো। আর যে তোমারহতেসম্পর্ক ছিন্নকরবে আমি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবো।”
আত্মীয়তার পার্থক্য ও মর্যাদা অনুযায়ী সম্পর্কের মাঝে পার্থক্য হয়ে থাকে, মাতার সম্পর্ক আর মামাতো বোনের সম্পর্ক এক হয় না। তেমনি সহোদর ভাইয়ের সম্পর্ক আর দূরসম্পর্কের ফুফাতো ভাইয়ের সম্পর্ক এক হতে পারেনা। বড়-ছোটর সম্পর্কও এক হয় না। নিকটাত্মীয় ও দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের সম্পর্ক এক নয়। অবস্থা, স্থান ও মর্যাদা অনুযায়ী এ সম্পর্কের পার্থক্য ঘটে থাকে।
সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তিময় পারিবারিক জীবনযাপন এবং নিরাপদ আশ্রয়স্থল প্রাপ্তির মানসে সর্বোপরি মহান রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক যথাযথভাবে অটুট রাখা প্রত্যেক মানুষের নৈতিক মানবিক দায়িত্ব। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে তাদের অধিকার ও হক যথার্থভাবে আদায়ের তাওফীক দিন। আমিন।
লেখক : অধ্যক্ষ, তাযকিয়াতুল উম্মাহ মডেল মাদ্রাসা।