বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত, নবীদের সর্দার, আল্লাহর বন্ধু, মানব জাতীর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হযরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন সর্বপ্রকার মানবিক গুণে গুণান্বিত এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। ধৈর্য্যশীলতা, দয়াদ্রচিত্ততা, সংবেদনশীলতা, পরহিত ব্রততা, ক্ষমাশীলতা ইত্যাদি যাবতীয় মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটেছিল তাঁর মধ্যে পরিপূর্ণভাবে। মানব জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বহুবিধগুণে গুনান্বিত ব্যক্তিগণের মধ্যেও কোনো না কোনো দোষ ত্রæটি পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু মুহাম্মদ (স) ছিলেন সকল প্রকার মানবিক গুণে গুনান্বিত এমন ব্যক্তিত্ব, যে ক্ষেত্রে কস্মিনকালেও কোন ব্যাপার সামান্যতম ত্রæটি বিচ্ছুতিও পরিলক্ষিত হয়নি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় ব্যাপার ছিল এই যে, শত্রæদের শত্রæতা এবং দুষ্ট লোকদের দুষ্টুমির মাত্রা যতই বৃদ্ধি পেত মুহাম্মদ (স)’র সহনশক্তি ও ধৈর্য্যশীলতার মাত্রা ততোধিক বৃদ্ধি পেত।
হযরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন সমগ্র মানব জাতির মধ্যে দানশীলতা ও দয়ারক্ষেত্রে তুলনাহীন। তিনি অভাব অনটন এবং দারিদ্রতা বিমুক্ত মন নিয়েই সবসময় দান করতেন। দান খয়রাতের ব্যাপারে অভাব অনটন দারিদ্রতা সম্পর্কে তাঁর মনে কখনোই কোন আশঙ্কার উদয় হতো না। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন- মুহাম্মদ (স) ছিলেন সবচেয়ে দানশীলতার মূর্ত প্রতীক। দানশীলতার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সাগরের ন্যায় উদার-উন্মুক্ত। হযরত যাবের রা. বলেছেন- এমনটি কখনো হয়নি যে, মুহাম্মদ (স)’র নিকট কিছু চাওয়া হয়েছে কিন্তু তিনি প্রার্থনাকারীকে প্রার্থিত বস্তু দান করেন নি কিংবা নাই কথাটি বলেছেন (বুখারী)।
হযরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন সবচেয়ে বিনয়ী। তাঁর আচার আচরণে অহংকার কিংবা আত্মম্ভরীতার কোনই ঠাই ছিলনা। শাসক বা স¤্রাটগণ যেভাবে দাস-দাসী বা সেবকদের সঙ্গে আচরণ করে থাকেন তিনি তাঁর সাহাবা কিংবা সেবকদের সঙ্গে কখনোই সেরূপ আচরণ করতেন না। তিনি তাঁর সম্মানার্থে সাহাবাগণকে দন্ডায়মান থাকতে নিষেধ করতেন। তিনি অসহায়দেরকে দেখাশুনা করতেন। পরমুখাপেক্ষীদের সাথে উঠা-বসা করতেন এবং দাসদের দাওয়াত কবুল করতেন। তাঁর এবং তাঁর অনুসারীদের মধ্যে কোন তফাৎ থাকতো না। তিনি খুবই সাদাসিদেভাবে সাহাবীদের সাথে উঠা-বসা করতেন। হযরত আয়েশা রা. বলেছেন- মুহাম্মদ সা. নিজেই নিজের জুতা সেলাই করতেন। নিজেই নিজের কাপড়-চোপড় সেলাই করতেন। একজন সাধারণ মানুষের ন্যায় সংসারের যাবতীয় কাজ-কর্ম নিজেই সম্পন্ন করতেন। নিজ হাতে দুধ দোহন করতেন এবং কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করতেন (মিশকাত)।
হযরত মুহাম্মদ ছিলেন সবচেয়ে লজ্জাশীল এবং অবনত দৃষ্টি সম্পন্ন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেছেন- রাসূলুল্লাহ পর্দানশীল কুমারীর চেয়েও অধিক মাত্রায় লজ্জাশীল ছিলেন। তিনি যখন কোন কিছু অপছন্দ করতেন তাঁর মুখ মন্ডলেই তার প্রকাশ পেয়ে যেতো (বুখারী)। তিনি সবসময় দৃষ্টি নিচের দিকে রাখতেন। আকাশের দিকে দৃষ্টি রাখার চেয়ে মাটির দিকে দৃষ্টি রাখাটাই তিনি বেশি পছন্দ করতেন। সাধারণত দৃষ্টি নি¤œ মুখী রেখেই তিনি কোন কিছু দেখতেন। লজ্জাপ্রবণতা তাঁর মধ্যে এতো বেশি ছিল যে, কোন অপছন্দনীয় কথা তিনি কাউকেও মুখোমুখি বলতেন না।
হযরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন- সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট ন্যায় বিচারক, সর্বাধিক পবিত্র, সর্বাধিক সত্যাবাদী এবং সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আমানতদার। তাঁর এসব গুণাবলীর কথা বন্ধুগণতো বটেই শত্রæরাও একবাক্যে স্বীকার করতো। নবুয়্যতের আগে জাহেলিয়াতের যুগে তাঁকে আল-আমীন তথা বিশ্বাসী উপাধিতে ভ‚ষিত করা হয়েছিল। সে সময়ে যেকোনো বিরোধের ন্যায় সঙ্গত মিমাংসার উদ্দেশ্যে লোকেরা তাঁর নিকট আগমণ করতো। হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত- একবার রাসূলুল্লাহ’র নিকট আবু জেহেল এসে বললো আমরা আপনাকে মিথ্যুক বলছি না তবে আপনি যা এনেছেন তাকে মিথ্যা বলছি (মিশকাত)। তিনি ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। তাঁর হাতেই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান মদিনার সনদ প্রণিত হয়েছিল। তাঁর শাসনামল ছিলো বিশ্বের সবচেয়ে উত্তম স্বর্ণযুগ।
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ ছিলেন অত্যাধিক প্রতিজ্ঞা পরায়ন। তিনি সকলের সঙ্গে অত্যন্ত উঁচু মানের সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। দয়াশীলতা, স্নেহশীলতা এবং দানশীলতায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তিনি সর্বোত্তম শিষ্টাচারী এবং তাঁর আচার-আচরণ সবচেয়ে উদার সবচেয়ে প্রশস্ত। কোনো প্রকার সংকীর্ণতা কিংবা অশালীনতা থেকে তাঁর স্থান ছিল পূর্ব থেকে পশ্চিমের দূরত্ব। মুশরিকদের দ্বারা অবর্ণনীয় দুঃখ-যন্ত্রনা সত্বেও কাউকেও তিনি কোন দিন অভিশাপ দেন নি। কিংবা অন্যায় আচরনের পরিবর্তে অন্যায় আচরন করেন নি। বরং প্রতিদানে তিনি দিয়েছেন ক্ষমা ও মার্জনা।
হযরত মুহাম্মদ (স) অনাথ ও অসহায়দের ভালোবাসতেন। তাদের সাথে চলাফেরা করতেন। তাদের সবসময় সহযোগিতা করতেন। তিনি পানাহারের ব্যাপারে আপন দাস-দাসীর সাথে কখনোই অহংকার করতেন না। নিজের সেবকদের প্রতি অনুগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি তাদের কাজ কর্মে সাহায্য করতেন। সেবকদের কাজ-কর্মে ভুল ত্রæটি হলে তিনি অসন্তুষ্ট হতেন না বা তাদেরকে ধমকও দিতেন না, বরং ক্ষমা করে দিতেন।
বিরত্ব ও সাহসিকতার দিক দিয়ে মুহাম্মদ (স)’র স্থান ছিলো সবার উপর। তিনি ছিলেন সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ট বীর পুরুষ। অত্যন্ত সংকটময় মুহূর্তেও মহানবী (স) দৃঢ় ও অটল থেকে অগ্রসর হতেন। কঠিন রণাঙ্গনেও রাসূলে আকরাম (স) সাহস হারা হননি বা পিছু হটেন নি। হযরত আলী রা. বলেছেন- সম্মুখ সমরে যখন বিভীষিকাময় অবস্থার সৃষ্টি হতো তখন আমরা রাসূল (স)’র আড়ালে আশ্রয় গ্রহণ করতাম। কোনো শত্রæই হযরত মুহাম্মদ (স)’র নিকটবর্তী হওয়ার সাহস পেত না।
হযরত মুহাম্মদ (স) উঠতে-বসতে সবসময় আল্লাহর নাম স্বরণ করতেন। নিজের জন্য কখনোই তিনি স্থান নির্দিষ্ট করে রাখতেন না। কোনো সভা-সমাবেশে গিয়ে তিনি যেখানে স্থান পেতেন সেখানেই তিনি বসে যেতেন। সঙ্গী সাথীদের তিনি ন্যায্য অধিকার প্রদান করতেন। কোনো প্রয়োজনে তাঁর নিকট কেউ কিছু চাইলেই তখনই তিনি তাকে তা দিতেন, কিংবা ভালো কথা বলে বিদায় দিতেন। কোনো খাদ্য দ্রব্যকে তিনি কখনোই খারাপ বলতেন না। ব্যক্তিগত কোনো ব্যাপারে তিনি কখনো ক্রোধান্বিত হতেন না; প্রতিশোধও গ্রহণ করতেন না। কোনো বিষয়ে যখন রাগান্বিত হতেন তখন তাঁর চেহারা মোবারক পরিবর্তিত হয়ে যেত। যখন সন্তুষ্ট হতেন তখন দৃষ্টি নিম্নমুখী হয়ে যেত। হাসির ক্ষেত্রে তিনি মুসকি হাসি দিতেন। অনর্থক কথা বার্তার ক্ষেত্রে তিনি মুখ বন্ধ রাখতেন। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে তিনি সবসময় সম্পর্ক বজায় রাখতেন। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের সম্মনিত ব্যক্তিদের তিনি সম্মান করতেন। বন্ধু বৎসল রাসূল (স) নিজ সঙ্গী সাথীদের খবরাখবর রাখতেন। ভালো জিনিসের প্রসংশা, ভালো কাজের সুফল এবং খারাপ জিনিসের মন্দ প্রভাব ও খারাপ কাজের কুফল সম্পর্কে বলতেন। কোনো ব্যাপারে তিনি বাড়াবাড়ি করতেন না। সব ব্যাপারে তিনি মধ্য পন্থা অবলম্বন করতেন। তিনি ছিলেন সকলের জন্যই পিতৃ সমতুল্য এবং সর্বাধিক মর্যাদা সম্পন্ন। তিনি কখনো উচ্চ স্বরে কথা বলতেন না। অন্যের মর্যাদাহানিকর কোনো কথা বার্তা তিনি বলতেন না। তিনি ছোটদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়াদ্র ছিলেন। গরীব দুঃখীদের সাহায্য করতেন। তাঁর মুখমন্ডলে সবসময় প্রফুল্লতা বিরাজ করতো।
সারকথা হলো মুহাম্মদ (স) ছিলেন অতুলনীয়, অনুপম ব্যক্তিত্ব। সর্বকাল উপযোগী এক পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর সুমহান চরিত্র সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেছেন, “অবশ্যই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।”
লেখক : অধ্যক্ষ, জামেয়া শরাফতিয়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, মুছাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, নোয়াখালী।