দৈনিক ফেনীর সময়

আমিনুলের নির্যাতনের কাহিনী শুনলে এখনো শিউরে ওঠে ফেনীর মানুষ

নিজস্ব প্রতিনিধি :

আলোচিত-সমালোচিত পুলিশ কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম। চাকুরীর সুবাদে আওয়ামীলীগ সরকারের মেয়াদকালে সাড়ে ১৫ বছরের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন ফেনী জেলায়। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছাড়াও ক্ষমতার অপব্যাবহারে অসংখ্য সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হয়েছেন। তার হাত থেকে রেহাই পায়নি আওয়ামীলীগের বহু নেতাকর্মীও। এতদিন ভয়ে কেউ মুখ না খুললেও সরকার পতনের পর তার নির্যাতনের কাহিনী মানুষের মুখে মুখে।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের ২২ এপ্রিল ফেনী মডেল থানায় ওসি হিসেবে যোগদান করেন আমিনুল ইসলাম। ওই বছরের ৩০ নভেম্বর শহরের শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়কের গাজী হোটেল থেকে নিরস্ত্র অবস্থায় তৎকালীন জেলা যুবদল সভাপতি (বর্তমানে জেলা বিএনপির যুগ্ম-আহবায়ক) গাজী হাবিব উল্যাহ মানিককে গ্রেফতার করে অস্ত্র দিয়ে চালান দেন আমিনুল। সেই ঘটনার পর আওয়ামীলীগ নেতাদের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন তিনি। বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের দমনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন পুলিশের বিতর্কিত কর্মকর্তা আমিনুল। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনের সময় বিতর্কিত ভূমিকার জন্য তাৎক্ষনিক বদলী হন ওসি মো: আমিনুল ইসলাম। বদলীর আদেশ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে ২২ জুন ফেনী থেকে সিআইডিতে বদলী হন। পরবর্তীতে বান্দরবান ট্রেনিং সেন্টার সহ কয়েকটি থানায় কর্মরত থেকে ২০১২ সালের ২১ মে ছাগলনাইয়া থানায় যোগদান করেন। সেখানেও চলে তার নানা অপকর্ম। এরপর তদবীর করে ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর পুনরায় ফেনী মডেল থানায় যোগদান করেন। কয়েকমাসের মাথায় ২০১৪ সালের ১ মার্চ তাকে ফেনী থেকে প্রত্যাহার করা হয়। কিছুদিন হাইওয়ে পুলিশে চাকুরীর পর ২০১৫ সালের ১৪ মে পুনরায় ফেনী জেলা পুলিশের সহকারি পুলিশ সুপার (ডিএসবি) হিসেবে পদায়ন হন আমিনুল। এর আগে ফেনীতে ডিএসবিতে সহকারি পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কোন কর্মকর্তা ছিলো না। প্রথম অবস্থায় পুলিশ সুপার মো: রেজাউল হক (বর্তমানে ডিআইজি) এর সময়কালে তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে নানা দ্বিধাদ্বন্ধ লাগিয়ে রাখতেন। এসপিকে চাপে রাখতে সরকারি দল থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা আদায় করতো। পরে রেজাউল হকের বদলীর পর তিনি মূলত পুরো জেলা পুলিশকে নিয়ন্ত্রন করতেন। তার নির্দেশনায় চলতো তৎকালীন বিতর্কিত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকার। যার ফলে পুলিশ কর্মকর্তারাও তার ভয়ে তটস্থ থাকতেন। তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পৌর যুবলীগের যুগ্ম-সম্পাদক সাইফুল ইসলাম পিটু সহ ছাত্রলীগ-যুবলীগের কতিপয় নেতারা বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে গিয়ে নিরীহ মানুষদের হয়রানী ও চাঁদা আদায় করতেন।

একটি সূত্র জানায়, সহকারি পুলিশ সুপার (ডিএসবি) থাকাকালে জেলা যুবদল সভাপতি জাকির হোসেন জসিমকে ধরে নিয়ে যায় আমিনুল। তখন ৩ লাখ টাকা চাঁদা দিয়ে মুক্তি পান তিনি। ধলিয়ার যুবদল নেতা নুর নবী ও জেলা যুবদল সদস্য হারিছকে বিনা মামলায় আটক করে গ্রেফতার দেখানো হয়। এমনকি তারা শারিরীক নির্যাতনের শিকার হয়ে দু’জনই পরে মৃত্যুবরণ করেন। জেলা বিএনপির আহবায়ক শেখ ফরিদ বাহারকে গ্রেফতার করতে ফেনী থানার তৎকালীন ওসি রাশেদ খান চৌধুরীকে বারবার চাপ দেয় আমিনুল। তার আদেশ না মানায় ওসি রাশেদ খান ছুটিতে গেলে নিজে থানায় এসে অন্য কর্মকর্তাদের পাঠিয়ে নিরস্ত্র বাহারকে ধরে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয় আমিনুল। ওসি থাকাকালে শহরের পাঠানবাড়ি রোডে জামায়াত কর্মী মিশু খানকে ধরতে তার বাসায় অভিযানে যান আমিনুল। বৃদ্ধ বাবাকে লাঞ্ছিত করে সেইসময় এলোপাতাড়ি কুপিয়ে বাসার আসবাবপত্র তছনছ করা হয়। খাটের নিচে লাল কাপড়ে মোড়ানো থাকা মিশুর মায়ের সাড়ে ৬ ভরি স্বর্ণ নিয়ে যান আমিনুল। বাধা দিতে চাইলে মিশুর ছোট ভাই মহিম খানকে আটক করে অন্য মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হয়। তখন ১৮ দিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্ত হয় মহিম।

পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, ৮৭-৮৮ সালে পুলিশে যোগ দেওয়া কর্মকর্তাদের অনেকে চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছেন। আমিনুল চলতি বছরের জুলাইয়ের শুরু থেকে অবসরজনিত ছুটিতে রয়েছেন। সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীর আর্শীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় অপকর্ম করেও দিব্যি চাকুরী করেছেন। বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারনে ফেনী থেকে বদলী হলেও নিজাম হাজারীর তদবীরে ঘুরে-ফিরে আমিনুল ফেনীতে পদায়ন হতেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সহকারি পুলিশ সুপার (ডিএসবি) থাকাকালে তার অফিস কক্ষকে টর্চার সেলে পরিণত করেছিলেন। বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ধরে এনে দিনের পর দিন আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করতেন। শহরের ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে ধরে এনে বিএনপি-জামায়াতের মামলায় জড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করতেন। রাজনৈতিক মামলায় জড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে জেলা শহরের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি মোটা অংকের চাঁদা আদায় করেছেন। শহরের একাধিক প্রতিষ্ঠান প্রধান বিষয়টি এ প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!