দৈনিক ফেনীর সময়

ইসলামী ব্যাংকে গ্রাহকের আস্থা ও প্রত্যাশা

ইসলামী ব্যাংকে গ্রাহকের আস্থা ও প্রত্যাশা

মো: মাঈন উদ্দীন :

ইসলামী ব্যাংক গুলোর প্রতি গ্রাহকের আস্থা ও বিশ্বাস পূনরায় ফিরে আসতে শুরু করেছে। বিগত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের আমলে দেশের আর্থিক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নামে-বেনামে ঋণ বের করে নেয়া, দুর্নীতি, অর্থপাচার ও অনিয়মের কারণে ব্যাংক খাত ছিল পুরো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বিশেষ করে, শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোসহ অন্তত ১৫টি ব্যাংকের আমানতের ওপর একচ্ছত্র লুটপাটের আধিপত্য ব্যাংক গুলোর কাঠামোর উপর বড় ধরণের আঘাত।

পত্রিকা তথ্য থেকে দেখা যায়, শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা একাই বের করে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার গণআন্দোলন পরবর্তী অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিবারতন্ত্র ও আধিপত্য ভাঙতে ১১ ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়। নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নতুন পর্ষদ। কোনো কোনো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম থাকলেও পর্ষদ থেকে বিদায় হয়েছে। এককথায় গভর্নর নিয়োগের এক মাসে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে ব্যাংক খাতে। দেশের ব্যাংক খাতের লিডিং ব্যাংক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান কারি অন্যতম বৃহৎ ব্যাংক হল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি।আমদানি রপ্তানির বানিজ্য, নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি, পরিবেশ বান্ধব ও টেকসই বিনিয়োগে ইসলামী ব্যাংক জনগণের আস্থা অর্জন করে চলেছে। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক হওয়ায় খেলাপি ঋণের পরিমাণও এ ব্যাংকের তুলনা মূলক কম।এই ব্যাংকের কর্মচারীদের সাথে গ্রাহকের আন্তরিকতা ও আস্থা বিরাট শক্তি।

ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল অ্যাপস চালু ও ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের প্রসার ঘটিয়েও ইসলামী ব্যাংক সেবা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যে অবদান রাখাসহ সামাজিক কর্মকাণ্ডে যেমন গরিব মেধাবীদের বৃত্তি প্রদান, দরিদ্রদের মাঝে বিভিন্ন সময় নানা সাহায্য প্রদান, হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারা প্রবর্তন, ভারসাম্য ও শোষণমুক্ত সমাজ ও সম্পদের সুষম বণ্টনের কাজ করার ক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ইসলামী ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। অন্তর্র্বতী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের বানিজ্য ব্যাংক সহ ইসলামী ব্যাংক গুলো যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ছিল তা জানা যায়। এতোদিন টাকা ছাপিয়ে ,তথ্য বিভ্রাট ও পরিকল্পিত রিপোর্টের মাধ্যমে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে রাখা হয়েছিল । ফলে দেখা দেয় ব্যাংকের তারল্য সংকট। মানুষ ব্যাংকে এসে প্রয়োজনীয় টাকা তুলতে হিমশিম খায়। ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসে কিছুটা ভাটা পড়েছিল।

অথচ বর্তমানে দেশে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মোট আমানত প্রায় চার লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি যা ব্যাংকের মোট আমানতের ২৭ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংকগুলোর মোট বিনিয়োগ প্রায় তিন লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা ব্যাংক খাতে মোট বিনিয়োগের ২৯ শতাংশ। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলো অনেক অবদান রেখে চলেছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে আসা মোট রেমিট্যান্সের ৫২ শতাংশ আসছে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। ছাত্র-জনতার তীব্র গনবিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর অন্তর্বতী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইসলামী ব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে চলেছে। প্রবাসীদের আস্থা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাংকের জন্য, দেশের জন্য যেসব কর্মচারী-কর্মকর্তাও নির্বাহীবৃন্দ কাজ করেও এতোদিন বৈষম্যের স্বীকার হয়েছেন তাদের বিষয়টি কর্তৃপক্ষ নজরে আনলে ব্যাংকের উন্নয়ন আশা করা যায় আরো বৃদ্ধি পাবে।

শোনা যাচ্ছে পুরাতন আমানত কারিগন ও ভাল বিনিয়োগ গ্রাহক ব্যাংকে আশা শুরু করছে। ব্যাংক ফিরে পাচ্ছে তার সোনালী অতীত। ইমপ্লয়িদের মাঝে কর্মচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। আসতে শুরু করেছে রেমিট্যান্স। কমতে শুরু করেছে হুন্ডি।

ব্যাংকার ও পত্রিকার তথ্য সূত্রে জানা যায় পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার আগে দেশের বৃহৎ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের তারল্য সংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল; কিন্তু পুনর্গঠনের পর মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে ব্যাংকটির বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে থাকা কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ইতিবাচক ধারায় পৌঁছেছে। কমছে তারল্য সংকট ও মূলধন ঘাটতিও। গত ১৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৩তম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. আহসান এইচ মনসুর। এরপর এখন পর্যন্ত ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন হয়েছে। এর মধ্যে এস আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। এর বাইরে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে থাকা এক্সিম ব্যাংক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নিয়ন্ত্রণে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। নতুন পর্ষদ আসায় গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাংকের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস পূনরায় আসতে শুরু করেছে।

অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ সম্প্রতি একটি সেমিনারে বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকে ইসলাম থাকতে হবে। তাহলেই ইসলামী ব্যাংক ভালো চলবে। ব্যাংকটি যারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ‘তারা ইসলামের খেদমত করতে চেয়েছিলেন। বিদেশি যেসব বিনিয়োগকারী এসেছিল, তারাও ইসলামের খেদমত করার জন্য এসেছিল। কিন্তু যখন তারা দেখেছে ব্যাংকটি অন্যায়ভাবে দখল হয়েছে, এরপর ব্যাংক থেকে ইসলাম বিদায় নিল, তখন তারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।’ এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, যারা ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিল, তারা কর্মীদের কম বেতন দিতেন, কম খরচ করতেন। এভাবে তারা অনেক সম্পদ জমা করেছিলেন, যাতে ইসলামি অর্থনীতির শক্ত ভিত্তি গড়ে ওঠে।

‘এটিই ইসলামী ব্যাংকের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। লুটেরা গোষ্ঠী যখন দেখল এখানে অনেক সম্পদ জমা আছে, তখন তারা সেটি দখলের পাঁয়তারা শুরু করল। একেএকে সবগুলো ইসলামি ব্যাংক দখল হয়ে গেল। একসময় ইসলামী ব্যাংক অন্য ব্যাংককে ধার দিত।’ বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির যে পাঁচজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিযুক্ত করেছেন তারা বেশ দক্ষতার সাথে এ বৃহৎ ব্যাংকটিকে পরিচালনা করছেন। ব্যাংকারদের ভাষ্যমতে ইতিমধ্যে পুরাতন অনেক আমানতকারী বাংকে তাদের টাকা জমা রাখতে শুরু করেছে। চলে যাওয়া অনেক ভাল ভাল বিনিয়োগ গ্রাহক ও ফিরে আসার চেষ্টা করছে। ইতোপূর্বে এ ব্যাংক বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাংক’ হিসেবে স্বীকৃত ছিল। প্রতি বছর প্রায় ডজন খানেক আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হতো এ ব্যাংক। তাছাড়া বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংক, যা একাধারে বিগত ১২ বছর ধরে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিশ্ববিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘দি ব্যাংকার’ কর্তৃক বিশ্বসেরা ১০০০ ব্যাংকের তালিকায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি র নাম ছিল। এটা বাংলাদেশের জন্য গৌরবের। জাতীয় অর্থনীতিতে এ ব্যাংক বিশাল অবদান রেখে যাচ্ছে।

ব্যাংকটি অধিকাংশ সূচকে অনেক আগেই দেশের সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংককে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত জুন ২০২৪ শেষেও ইসলামী ব্যাংক ১ লক্ষ ৫৯ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকার আমানত নিয়ে শীর্ষে অবস্থান করেছিল। শুধু তাই নয় বৈদেশিক রেমিট্যান্স আহরণেও সবোর্চ্চ অবস্থানে এ প্রতিষ্ঠান। এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি ৩.৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেছে যা বাংলাদেশী টাকায় ৪০ হাজার কোটি টাকার সমান। দেশের মোট রেমিটেন্সের ২৬ শতাংশ এসেছে এ ব্যাংকের মাধ্যমে। এটি এই ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা ও বিশ্বাসের বহি:প্রকাশ। আমদানি রপ্তানির বানিজ্য, নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি, পরিবেশ বান্ধব ও টেকসই বিনিয়োগে ইসলামী ব্যাংক জনগণের আস্থা অর্জন করে চলেছে। বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ এক্সিকিউটিভ, কর্মকর্তাও কর্মচারীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রমোশনের ব্যবস্থা করেছেন। এতে সকলের মাঝে কর্মচাঞ্চল্য ও কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পাবে।

ইসলামী ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ ব্যাংকটির আমানত ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা মজবুত করার জন্য সকলকে তাগাদা দিয়েছেন। তিনি রোডম্যাপ ও দিয়েছেন। রোডম্যাপের প্রথম ধাপে নতুন বোর্ডের যাত্রার তারিখ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হবে ‘বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ’। এ ছাড়া ২০২৬ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায় হবে ‘ঘুরে দাঁড়ানোর’ বছর এবং তৃতীয় পর্যায় হবে ২০২৭ থেকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত ‘এগিয়ে যাওয়ার’ বছর। তবে ইসলামী ব্যাংক যদি সর্বোত্তোম গ্রাহক সেবা দিতে পারে যেমন হাসিমুখে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী স্বল্প সময়ে সেবা প্রদান, গ্রাহক যেন তার নগদ টাকা উত্তোলন ও জমায় প্রশান্তি পায়। এটিএম ও ছিআরএম সমূহ ঠিক ভাবে সচল রাখার চেষ্টা করে তাহলে গ্রাহকের আস্হা আরো বহু গুণে বৃদ্ধি পাবে। ব্যাংক সচল হলে অর্থনীতিও সচল হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। ক্ষমতার প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলেফেঁপে ওঠা অল্প কিছু ব্যক্তির হাতে দেশের অর্থনীতির আর যেন নিয়ন্ত্রণে না যায়। এটাই সকলের প্রত্যাশা।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!