মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম :
দ্বীন ইসলাম তথা মহানবী স. প্রদর্শিত দ্বীন সহজ, সাবলীল, মধ্যপন্থী ও উত্তম দ্বীন। মহানবী স. বলেছেন- নিশ্চয় দ্বীন সহজ। দ্বীন নিয়ে যে বাড়াবাড়ি করে, দ্বীন তার উপর জয়ী হয়। সুতরাং তোমরা মধ্য পন্থা অবলম্বন কর, মধ্যপন্থার নিকটে থাক, আশান্বিত থাক, সুসংবাদ দাও এবং সকাল-সন্ধ্যায় ও রাতের কিছু অংশে ইবাদতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর (সহীহ বুখারী-৩৯)। মহানবী স. অন্যত্র বলেছেন- “তোমরা সহজ কর, কঠিন করো না, লোকদের সুসংবাদ দাও, তাদের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি করো না” (সহীহ বুখারী-৬৯, সহীহ মুসলিম-১৭৩৪, আহমদ- ১১৯২৪)।
আল্লামা মোল্লা জিউন রহ. বলেছেন, “হযরত মুহাম্মদ স.-এর শরীয়ত ও ইফরাত বা বাড়াবাড়ি যা হযরত মুসা আ.-এর শরীয়তে ছিল যেমন- কোথায়ও নাপাকি লাগলে নাপাকির স্থান কেটে ফেলা, তাওবা হলো হত্যা, মসজিদ ছাড়া নামায জায়েয না হওয়া, মালে এক-তৃতীয়াংশ যাকাত নির্ধারিত হওয়া, রমজান মাসে রাত্রেও স্ত্রী সম্ভোগ নিষিদ্ধ হওয়া, শনিবারে মৎস শিকার হারাম হওয়া, তাহাজ্জুদ নামায ফরয হওয়া ইত্যাদি এবং ঐ তাফরিত বা শৈথিল্যতা যা হযরত ইসা আ.-এর শরীয়তে ছিল যেমন- মধ্য পান, শুকর ও মৃত প্রাণী গোস্ত ভক্ষণ বৈধ হওয়া। নাপাকি বস্তু সহ নামায পড়া বৈধ হওয়া, হায়েজ অবস্থায় সহবাস বৈধ হওয়া, মুশরিক নারীকে বিবাহ করা বৈধ হওয়া ইত্যাদির মাঝামাঝি। আর তাহলো নাপাকির স্থানকে পানি দ্বারা ধৌত করা, গুনাহ করলে তাওবা করা, মসজিদ ছাড়া অন্য নামায পড়া বৈধ্য হওয়া, মাটি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা, মালের ৪০ ভাগের এক ভাগ যাকাত নির্ধারণ করা, রমযানের রাত্রে স্ত্রী সম্ভোগ বৈধ হওয়া ইত্যাদি (নুরুল আনওয়ার)। হযরত আবদুল্লাহ ইবন ওমর রা. বলেছেন- মহানবী স. বিদায় হজে মিনায় অবস্থান করেন, সেখানে সাহাবীরা তাঁকে নানা ধরনের প্রশ্ন করেন। এক সাহাবী এসে বললেন হে আল্লাহর রাসূল- আমি অজ্ঞতা বসত কোরবানী করার আগে মাথা হলক করেছি। রাসূল স. বলেন- ঠিক আছে এখন কোরবানী করে ফেল, কোন ক্ষতি হবে না। তারপর আরেকজন এসে বললেন- আমি না জেনে কংকর নিক্ষেপের পূর্বে কোরবানী করে ফেলেছি। রাসূল সা. বলেন- ঠিক আছে, এখন কংকর নিক্ষেপ কর, কোন ক্ষতি হবে না। এভাবে রাসূল সা.কে যে সব কাজের কথাই জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, আগে বা পরে করা হয়েছে, তাতে তিনি বলেছেন- এখন করে নাও, কোনো ক্ষতি নেই (ফিকহুস সুন্নাহ, ২য় খন্ড)।
ফিকাহবিদদের মতে, সাতটি ক্ষেত্রে শরিয়তের বিধান সহজ করা হয়েছে। যেমন- ১. সফর: সফর দুই প্রকার। দীর্ঘ সফর ও সংক্ষিপ্ত সফর। দীর্ঘ সফর হলো তিন দিন ও তিন রাতের পথ বা ৪৮ মাইল দূরের পথ। কেউ যদি এ পরিমাণ দূরে যাওয়ার নিয়তে বাড়ি থেকে বের হয়, তবে সে মুসাফির হবে। তার জন্য শরিয়ত কতিপয় বিধান শিথিল করেছে। যেমন-কসর তথা চার রাকাত ফরজের ক্ষেত্রে দুই রাকাত পড়া, রমজান মাসের রোজা ভঙ্গ করা, এক দিন এক রাতের বেশি সময় ধরে মোজা মাসেহ করা, কোরবানি রহিত হওয়া ইত্যাদি। সংক্ষিপ্ত সফর তথা ৪৮ মাইলের কাছাকাছি পথ সফর করা। এ অবস্থায় জুমা, ঈদের নামাজ, জামাতে নামাজ পড়া ইত্যাদি বর্জন করা জায়েজ। অনুরূপ জন্তুর পৃষ্ঠে নফল নামাজ পড়া, পানি না পাওয়া গেলে তায়াম্মুম করা ইত্যাদি জায়েজ।
অসুস্থতা : অসুস্থতার ফলে জীবনের প্রতি আশঙ্কা বোধ হলে অথবা কোনো অঙ্গ ক্ষতি হওয়ার বা অসুস্থতা বৃদ্ধি পাওয়ার কিংবা বিলম্বে সুস্থ হওয়ার ভয় হলে তখন তায়াম্মুম করা বৈধ। অনুরূপ অসুস্থতার কারণে জামাত বর্জন করা জায়েজ। অতি বৃদ্ধের জন্য রোজার পরিবর্তে ফিদিয়া প্রদান করা জায়েজ। অসুস্থ ব্যক্তির জন্য জিহারের (স্ত্রীর শরীরের কোনো অঙ্গকে-যাদের সঙ্গে বিবাহ হারাম তাদের অঙ্গের সঙ্গে তুলনা করার) কাফফারায় রোজার পরিবর্তে খাদ্য খাওয়ানো জায়েজ। তদ্রƒপ অসুস্থ ব্যক্তির জন্য রমজানের রোজা ভঙ্গ করা, ইতিকাফ ভঙ্গ করা, হজে ও কংকর নিক্ষেপে প্রতিনিধি নিয়োগ করা বৈধ। অসুস্থ ব্যক্তির জন্য ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজও ফিদিয়া প্রদান করার শর্তে করা বৈধ। প্রাণ বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী হারাম খাদ্য খাওয়াও বৈধ। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ডাক্তারের রোগীর গুপ্তাঙ্গের দিকে তাকানোও বৈধ।
বাধ্য হওয়া : কেউ যদি বাহ্য মুখে কুফরি বাক্য উচ্চারণ করে, কিন্তু অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস থাকে, তাহলে কুফরি বাক্য উচ্চারণের কারণে সে কাফির হবে না।
ভুলে যাওয়া : কেউ যদি রোজা রেখে ভুলক্রমে পানাহার করে, তবে তার রোজা ভঙ্গ হবে না।
অজ্ঞতা : আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, যারা জানে আর যারা জানে না উভয় কি সমান? (সুরা: জুমার, আয়াত : ৮) যে ব্যক্তি অজ্ঞ তথা যার দ্বীন ও শরিয়তের ব্যাপারে জ্ঞান নেই, তার জন্য শরিয়তের অনেক বিধি-বিধান শিথিল করা হয়েছে।
অক্ষমতা ও কষ্টকর অবস্থা : অক্ষম ও কষ্টকর অবস্থায় শরিয়তের বিধান শিথিল করা হয়েছে। যেমন-অপবিত্র জামা নিয়ে নামাজ আদায় করা। যদি পবিত্র জামা না থাকে এবং জামার এক-চতুর্থাংশের কম নাপাকি থাকে অথবা এক দিরহাম পরিমাণ নাজাসাতে গলিজা (পেশাব, পায়খানা ইত্যাদি) থাকে, তবে উক্ত জামা নিয়ে নামাজ পড়া জায়েজ। ডাঁশের রক্ত, ছারপোকা ও মশা-মাছির রক্ত পবিত্র। ফলে তা নিয়ে নামাজ পড়া বৈধ, যদিও রক্ত বেশি হয়। পশমের মাথা পরিমাণ পেশাব কাপড়ে ছিটকে পড়লে উক্ত পেশাব নিয়ে নামাজ পড়া বৈধ। রাজপথের মাটি পবিত্র। অনুরূপ যে নাজাসাতের প্রভাব দূর করা কষ্টকর, তা নিয়ে নামাজ পড়া বৈধ। পাত্র ছাড়া অন্যত্র বিড়ালের পেশাব পতিত হলে তা জমহুরের মতে পবিত্র। চড়ুই পাখি ও কবুতরের বিষ্ঠা পবিত্র, যদিও বেশি হয়। হারাম পাখির বিষ্ঠাও এক বর্ণনা মতে পবিত্র। দেহ থেকে নির্গত রক্ত গড়িয়ে না পড়লে পবিত্র। শিশুর লালা, গোবরের মাটি, অপবিত্র বস্তুর ধোঁয়া ইত্যাদি পবিত্র। গোবর, ময়লার ছাই, বাদুড়ের পেশাব ও বিষ্ঠা পবিত্র। তা গায়ে বা জামায় লাগলে অপবিত্র হবে না।
স্বাস্থ্যগত ত্রুটি : কারো স্বাস্থ্যগত ত্রুটি থাকলে তার ওপর শরিয়তের বিধান আরোপিত হয় না। যেমন-নাবালেগ, মাতাল প্রমুখের ওপর শরিয়তের বিধান আরোপিত হয় না। মহানবী (সা.) বলেছেন, তিন ব্যক্তি দায়মুক্ত, তাদের কোনো কোনো পাপ লেখা হয় না। ক. ঘুমন্ত ব্যক্তি-জাগ্রত হওয়ার আগ পর্যন্ত, খ. মাতাল-সুস্থ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ও গ. শিশু-প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত। (তিরমিজি, হাদিস : ১৩৪৩) এদের কথা ও কাজের কোনো মূল্য নেই। অপ্রাপ্ত বয়স্কের কথার মূল্য নেই। কিন্তু কাজের মূল্য আছে। তারা কোনো অপরাধ করলে শাস্তি প্রয়োগ করা যাবে। (ইমাম কারখি)। আর নারীদের ওপর এমন অনেক বিধান আরোপিত হয় না, যা পুরুষদের ওপর আরোপিত হয়। যেমন-জামাতে নামাজ পড়া, জুমা, জিহাদ, জিজিয়া ইত্যাদি পুরুষের ওপর আবশ্যক; নারীদের জন্য জরুরি নয়। আবার কখনো কখনো ওজরের কারণে ইবাদত বাতিল হয়ে যায়। যেমন-হায়েজ ও নেফাস অবস্থায় নামাজ মাফ। অনুরূপ নামাজ সময়ের আগে ও পরে পড়া জায়েজ। যেমন-আরাফায় জোহর ও আসরের নামাজ জোহরের সময় পড়া এবং মুজাদালিফায় মাগরিব ও এশার নামাজ এশার সময় পড়া। অনুরূপ বর্ষপূর্তির আগে জাকাত দেওয়া, রমজানে সদকায়ে ফিতর আদায় ইত্যাদি করা বৈধ।
হযরত ওমর রা. মহানবী সা. এর নিকট কুরআন শিক্ষা করেন- অতপর আরেক মসজিদের ইমামের ভিন্ন স্বরে কিরআত শুনে ইমামকে মহানবী সা.-এর দরবারে হাজীর করেন- মহানবী সা. উভয়ের কিরআত শুনে বললেন- উভয়ই সহিহ, কুরআন সাত পদ্ধতিতে অবতীর্ণ হয়েছে। উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে ওলামায়ে কিরামের কর্তব্য হলো মাজহাবী মতভেদ সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করে মুসলমানদের মাঝে ফাটল সৃষ্টি না করা। এতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হচ্ছে। মহানবী সা. বলেছেন- যারা আমাদের জবেহকৃত প্রাণীর গোস্ত ভক্ষণ করে এবং আমাদের কিবলাকে কিবলা মানে তাদের সাথে আমাদের কোন বিরোধ নেই। সুতরাং সকলকে মতানৈক্য ও মতভেদের উর্ধ্বে থেকে ইকামতে দ্বীনের কাজে সহযোগিতা করা আবশ্যক। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে এ কাজের জন্য কবুল করুন, আমীন।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ।