জাহাঙ্গীর আলম :
শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার ও বেসরকারি শিক্ষাকে জাতীয়করণের আওতায় নিয়ে আসা জাতীয়স্বার্থে অনিবার্য প্রয়োজন। মানবজীবন উন্নয়নের জন্য শিক্ষা অপরিহার্য। শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে মানুষ যেমন নিজেকে জানতে পারে তেমনি ব্যক্তি জীবনে কাঙ্খিত গুণাবলীর সমন্বয় সাধন করে সামগ্রিক মানবীয় মূল্যবোধে উজ্জীবিত হতে পারে। শিক্ষা মানুষকে অন্ধকার জগত থেকে আলোর পথে নিয়ে আসতে সাহায্য করে। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। কথাটি শুনতে অতি পুরনো মনে হলেও এটি সস্তা বা গুরুত্বহীন নয়। এই কথার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে কোন জাতি আর অবহেলিত থাকতে পারে না। মেরুদন্ড দেহের পেছনে থেকে মানুষকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে, হাঁটতেও শেখায়, শির উঁচু করে ধরে রাখে।
তেমনি অর্জিত শিক্ষাও জাতীয় জীবনে মেরুদণ্ডের ভূমিকা পালন করে থাকে। শিক্ষা জাতির শিরদাঁড়া সোজা রাখে,অন্যায় অবিচার রুখে দিতে শেখায়, নতজানু ও দাসত্বের শৃঙ্খলিত গোলামী থেকে মুক্ত করে। জাতির অন্তর্নিহিত শক্তিকে বিকশিত করে। শিক্ষা মানুষকে পশুত্ব থেকে বের করে মনুষ্যত্বলোকে পৌঁছিয়ে দেয়। যে জাতির শিক্ষাব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত, সু-পরিকল্পিত ও বিশ্বমানের সে জাতি ততোই উন্নত,সতেজ এবং সে জাতি উর্বর ও শক্তিমান জাতিসত্তার অধিকারী। শিক্ষার মাধ্যমে জাতি সংকীর্ণতা ও ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। তখনই জাতি বিভেদ মুক্ত হয়ে কাধে কাধ মিলিয়ে উন্নতির চরম শেখরে আরোহণ করে। শিক্ষা জাতিকে সভ্য করে, করে ঐক্যবদ্ধ। এখন ভেবে দেখার বিষয়, জাতি হিসেবে আমরা এই গুণাবলীগুলো কতটা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি ? যদি অর্জন করতে না পেরে থাকি তবে কেন পারিনি? স্বাধীন সত্ত্বার অধিকারী বাঙ্গালী জাতির বয়স প্রায় অর্ধ শতাব্দীতে উপনীত। দেখতে দেখতে জাতির জীবনের যৌবন থেকে অনেক গুলো বছর হারিয়ে গেল। সুদীর্ঘ এই সময়ে আমরা আমাদের শিক্ষানীতিকে কতটা সুদৃঢ় করে ঢেলে সাজাতে পেরেছি? প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজে বের করলেই জাতিগত ভাবে আমাদের পিছিয়ে পড়া ও চেতনাগত অনৈক্যের মূলকারণ জানা যাবে। শিক্ষা মানবজীবনের উন্নয়নের চাবিকাঠি। মনোজগতের প্রবেশ দ্বারের মূল ফটক ভেদ করতে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
কিন্তু আমরা জাতিগত ভাবে শিক্ষা নামক সোনার কাঠির পরশ লাভ করতে পারছিনা। তার অন্যতম কারণ ‘বহুবিভক্ত শিক্ষানীতি’। আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা জাতির চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারনা, ভাব-কল্পনাকে সমান্তরাল সূত্রে গাঁথতে পারে না। বহু বিভক্ত শিক্ষার চৌপথে বিদ্যার্জন করতে গিয়ে শৈশব থেকে বিভক্ত হয়ে পড়ে জাতির মেধা, মননশীলতা। অসম ও বিভাজনের এই শিক্ষা অর্জন করে বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের মনোজগতে ব্যাপক পার্থক্য নিয়ে আসে। তার ওপর রয়েছে অনিয়ন্ত্রিত পাঠ্যপুস্তক চাপিয়ে দেওয়ার বোঝা এবং যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা অপরিকল্পিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত কারিকুলামের বাইরে নিজস্ব মনগড়া পাঠ্যবই ও পাঠ্যক্রম শিশুমনে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাবলয় তৈরি করে। অতিরিক্ত পাঠ্যবইয়ের বোঝার চাপে শিশু বয়সেই শিশুর কোমল মন-মস্তিষ্কে শিক্ষাভীতি তৈরি হয়। শিশুদের শিশুসুলভ সরলতার সুযোগ নিয়ে, তাদের সক্ষমতা-সীমাবদ্ধতার বিষয়টি বিবেচনায় না এনে এক প্রকার বল প্রয়োগ করে তোতো পাখির মতো বিদ্যা গেলানো হয়। শিশুদের কোমল মস্তিষ্কে এটি অনেকটা শিলাবৃষ্টির মতো আঘাত হানে। তাই শিক্ষার মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাচারিতা চলতে দেওয়া যায় না। জাতি গড়ার মহান ব্রত নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে হয়। যুগে যুগে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার করণে এবং জাতির চালিকাশক্তি শিক্ষাকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব দেওয়ায় সারা দেশে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করার রমরমা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে দেশে শিক্ষা বৈষম্য তৈরি হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কাঙ্খিত মানের শিক্ষা অর্জন করতে পারছে না।
শিক্ষা গবেষকগণ বলেছেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষা মানবদেহের পদযুগল। মাধ্যমিক শিক্ষা মানবদেহের মেরুদন্ড। উচ্চশিক্ষা মানব দেহের মস্তিষ্ক।’ প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিটি শিশুর জ্ঞানার্জনের মৌলিক ফাউন্ডেশন। এর ভিত্তি যত মজবুত হয় ছাত্রজীবনের পরবর্তী ধাপগুলো অতিক্রম করা ততোই সহজ হয়। তখন একজন শিক্ষার্থী প্রকৃত শিক্ষা ও যথার্থ জ্ঞান লাভের সুযোগ পায়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু সমস্যা রয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে এই অবস্থা চলে আসছে। সময়ের সাথে সাথে এগুলো এখন নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। অথচ এই সমস্যাগুলো গোটা জাতিকে বিভক্ত করে রেখেছে। সে বিষয়ে আমাদের রাষ্ট্রীয়নীতি নির্ধারকগণের খুব আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় না। ক্ষমতার পালাবদলে শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে ঠিকই, কিন্তু কাঙ্খিত ও লক্ষণীয় পরিবর্তন আসে না আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়। সব শাসকই পুরনো নিয়মে চলে আসা শিক্ষার উপর নতুন করে নানা রঙের প্রলেপ লাগাতে ব্যস্ত থাকেন। আর ক্ষণে ক্ষণে পাঠ্যপুস্তক ও পরীক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকেন। যার কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবার মাঝে এক ধরণের অস্বস্তি কাজ করে। অথচ শিক্ষা জাতি গড়ার হাতিয়ার। শিক্ষার মাধ্যমে জাতির জাত মানুষ হয়। শিক্ষা মানুষের মাঝে মনুষ্যত্ববোধ জাগিয়ে তোলে। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ অজানাকে জানতে পারে।শিক্ষা যে কোন জাতিকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করে। প্রকৃত শিক্ষা জাতির হৃদয়ে দেশ প্রেম জাগিয়ে তোলে। অপরাধ, অনিয়ম ও দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থেকে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা জাতির মেধা ও মননশীলতায় স্থায়ী ভাবে ব্যবধান সৃষ্টি করে আসছে। দেশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাগুলোতে প্রণীত পৃথক পৃথক পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে অর্জিত শিক্ষা ও জ্ঞানগত দিক থেকে বহু পার্থক্য আছে। সাম্প্রতিক সময়ে যদিও (স্কুল, কলেজ, মাদরাসায়) পাঠ্যবিষয়ে কিছুটা সমন্বয় সাধন করা হয়েছে তবে তা যথেষ্ট নয়।দক্ষতাসম্পন্ন সুনাগরিক তৈরী করতে না পারলে রাষ্ট্র অকেজো হয়ে যায়।এক সময় জাতি মুখ থুবড়ে পড়ে।জাতির প্রতিটি নাগরিক জাতীয়সম্পদ। এই জাতীয় সম্পদকে জীবনমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষা প্রদান করে সু-দক্ষ জনশক্েিত পরিণত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই দায়িত্ববোধ থেকে রাষ্ট্রের উচিত পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের একক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। এটি সময়ের বাস্তবতা।
লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার মতো দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা শিক্ষাব্যবস্থায় লাগাম দিতে হবে। জাতির স্বার্থে একাজটি অতীব প্রয়োজন। জাতির মাঝে জাতীয় চেতনাবোধ জাগাতে শিক্ষাব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। রাষ্ট্রকর্তৃক নির্ধারণকৃত শ্রেণি-উপযোগী পাঠ্যক্রম অনুসারে পাঠদান সারা দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অপরিহার্য করতে হবে। এর বাইরে অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা শিক্ষার্থীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা সমূলে নিধন করতে হবে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর বসবাস ও সহবস্থান। এর মধ্যে প্রায় নব্বই শতাংশ পবিত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বী তথা মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে। তাই পাঠ্যসূচিতে সকল ধর্মের যথাযথ ধর্মীয়শিক্ষা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বাধ্যতামলক করা উচিত। সে লক্ষ্যে স্ব -স্ব ধর্মীয় শিক্ষক প্রতিটিস্তরে (শতভাগ) নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ ধর্মীয় শিক্ষা মানবীয় নীতি-নৈতিকতার সূতিকাগার। ধর্মীয় অনুশাসন যে কোন মানব সমাজের জন্য বাধ্যতামূলক। ধর্মীয় অনুশাসন মানবজাতিকে শৃঙ্খলিত রাখে,পশুভিত্তি থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে, সকল প্রকার অপরাধ থেকে দূরে থাকার প্রেরণা দেয় এবং জীবনটাকে পূত -পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে। ফলে রাষ্ট্রে অপরাধ প্রবণতা অনেকাংশে কমে যায়। কোন ধর্মে অন্যায়, অপরাধমূলক কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। মানব জাতিকে সঠিক দিকদর্শন দেওয়ার নিরীখেই ধর্মের আগমন।নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষা মানুষের জীবনে কোন পরিবর্তন সাধন করতে পারে না। নৈতিক শিক্ষা পরিপন্থী ব্যক্তি উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারলেও, সু-শিক্ষিত হতে পারে না। নব্বইভাগ মুসলিম যে দেশের নাগরিক, সে রাষ্ট্রকে তাদের নৈতিক – মূল্যবোধ বিকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত। এ বিষয়ে আন্তরিক হলে দেশে সু-নাগরিক ফয়দা হবে, প্রকৃত দেশপ্রেমিক তৈরি হবে,রাষ্ট্রের অনেকাংশে অপরাধ কমে আসবে।তখন দেশ আর দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হবে না। কারণ তখন দেশে যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।শিক্ষাগত ঐক্যের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতির মেধা,মননশীলতা ও চেতনার সম্মিলন ঘটাতে হবে। একক জাতীয় আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জাতির মাঝে অন্তত জাতীয় স্বার্থে কোন বিরোধ বা পার্থক্য থাকবে না। তখন ধর্মীয় বা অন্য কোন উপায়ে কেউ কাউকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে, বিভ্রান্ত করে , জঙ্গিবাদের মতো ভয়াবহ আত্মঘাতী পথে পরিচালিত করা সহজ হবে না। অবশ্যই শিক্ষার ফল হাতে- নাতে পাওয়া যায় না, এর জন্য কিছু সময় অপেক্ষায় থাকতে হয়। বাঙ্গালির জাতীয় জীবনে এখনো বহু সমস্যা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে আছে।এর থেকে উত্তোরণের একমাত্র পথ হলো শিক্ষা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম প্রধান অন্তরায় বৈষম্যমূলক শিক্ষা, এবং শিক্ষার বিভিন্ন মাধ্যম। শিক্ষা অর্জনের মাধ্যম পুরো জাতির জন্য একই রকম হলে অর্জিত জ্ঞানের সামঞ্জস্য থাকে।ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাজনীতিতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। অন্যথায় জাতীয় জীবনের সবক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা ও মনস্তাত্বিক বিরোধ লেগে থাকে। আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি জুড়ে রয়েছে অনাকাঙ্খিত বহুমুখিতা- (১) ইংলিশ মিডিয়াম (২) বাংলা মিডিয়াম (৩) মাদরাসা মিডিয়াম- (সরকারি, কাওমি, হাফেজি, নূরানি ও এতিমখানা)। বিভিন্ন মাধ্যমে অধ্যয়ন শেষে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনে এসে জ্ঞান,দক্ষতা অভিজ্ঞতার আলোকে সমানুপাতে এগিয়ে যেতে পারে না। কারণ সব ক্ষেত্রে শিক্ষার মান ও পাঠ্যক্রম এক নয়। ফলে জ্ঞানগত বৈষম্যের শিকার হয়ে বেড়ে উঠছে আমাদের জাতিসত্তা। বিশেষ করে মাদরাসায় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা এ জাতীয় অধিক বৈষম্যের শিকার। কাওমী, নূরানি, হাফেজি, এতিমখানায় অধ্যয়নরত কতভাগ শিক্ষার্থী নিজের ভবিষ্যতকে গড়ে নিয়ে আপন পায়ে দাঁড়িয়ে দেশগড়ায় আত্মনিয়োগ করতে পারছে? বরং হাত পাতানো শিক্ষায় বড় হয়ে এদের ভেতর-বাহির ভিক্ষুকের ছদ্মাবরণে আবৃত হয়ে যায়। বাকি জীবনটা সমাজের কাছে হাত পেতে কাটানোর জন্য নিজেদেরকে ছাত্রজীবন থেকেই যেন তারা তৈরি করে নেয়। অথচ তাদের মাঝেও বিপুল সম্ভাবনাময় সুপ্ত প্রতিভা লুকিয়ে রয়েছে। এসব বঞ্চিত প্রতিভা বিকশিত হওয়ার একটু সুযোগ পেলে দেশের উন্নয়নে তারাও অংশ গ্রহণ করতে পারবে। তাদের মধ্য থেকেও জন্মাতে পারে -বড় বড় শিক্ষাবিদ, পন্ডিত, শিল্পী, সাহিত্যিক,জর্জ, ব্যারিস্টার, দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী। কোন মানব শিশুর প্রতিভা বিকাশের পথ চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার অধিকার কারো নেই। অথচ আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের উদাসীনতা ও অবহেলার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী কোমলমতি শিশুদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। একই কারণে ধর্মীয়গোড়ামী, ধর্মান্ধতাসহ নানাবিধ অপরাধ সৃষ্টির পথ অবারিত হচ্ছে। জাতির স্বার্থে এখনই এদের লাগাম টেনে ধরা প্রয়োজন। জাতির প্রতিটি শিশু জাতীয় সম্পদ। আগামীর জাতি ও রাষ্ট্রের পরিচালক। প্রতিটি শিশুকে দক্ষ করে গড়ে তোলা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মাঝিবিহীন তরণী’র মতো এদের ছেড়ে দেওয়ার কারণে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অন্ধকার অপেক্ষা করছে।
অন্যদিকে সরকার নিয়ন্ত্রিত মাদরাসাগুলোর ক্ষেত্রেও শিক্ষার বেহাল দশা। কোন রকম দায়সারা গোচের অবস্থায় থেকে চলছে শিক্ষাক্রম। আধুনিক শিক্ষার সমান সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় বাস্তব জীবনে এসে নানান বৈষম্যের শিকার হয় এ সব শিক্ষার্থীরা। যে শিক্ষা জাতীয় জীবনে অসমতা সৃষ্টি করে সে ধরণের শিক্ষা আমাদের প্রয়োজন নেই।দেশের জেনারেল শিক্ষাব্যবস্থায় পরিচালিত স্কুল, কলেজগুলোতে একই সাথে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগে পাঠদান চালু থাকলেও সমানুপাতে মাদরাসাগুলোতে এই শিক্ষাক্রম প্রচলিত নেই। এ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তারা জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারে না। উন্নত, সমান্তরাল ও সময়োপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে সারাদেশে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে এগিয়ে আনতে হবে। বঞ্চিত সকল শিশুদের জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিত করে উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন করতে হবে। এগুলো সুস্পষ্ট বৈষম্য। এই বৈষম্য জাতির মাঝে চলতে দেওয়া যায় না। বৈষম্যমুক্ত জাতি গড়তে হলে সবার আগে সাম্যেরভিত্তিতে শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজাতে হবে।
তাহলে আমরা একটি বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়তে পারবো। দক্ষ ও সু-নাগরিক গড়তে প্রয়োজনে (ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিয়ে) একমুখী শিক্ষা চালু করা যায় কি না তাও ভেবে দেখতে হবে। একই কারণে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। শিক্ষার মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রাইভেট বা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় রাখা উচিত নয়। বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ শুধু শিক্ষকের স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে নয়,জাতির স্ট্রং ও অক্ষত মেরুদন্ড গড়ার স্বার্থে প্রয়োজন। শিক্ষার সমমান রক্ষার্থে সারা দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণের বিকল্প নেই। জাতীয়করণ করা হলে সারা দেশে শিক্ষকদের বদলী সিস্টেম চালু হবে। পিছিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো এর ফলে ভালো শিক্ষক পাবে। জাতীয়ভাবে প্রশিক্ষণের আওতায় এনে শিক্ষকদের সহজে আরো দক্ষ করে গড়ে তোলা যাবে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যয় কমে আসবে। হাতেগোনা কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিজ নিজ সন্তানদের ভর্তি করাতে অভিভাবকদের যে অসম প্রতিযোগিতা চলছে, প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টারের পেছনে ঘুরে যে পরিমান অর্থ অপচয় হচ্ছে তা অনেকাংশে বন্ধ হবে। জাতি বৈষম্য মুক্ত শিক্ষার ফল ভোগ করার সুজোগ পাবে। মেধাবীরা পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেঁচে নেবে। এর ফল জাতি সানন্দ চিত্তে স্থায়ী ভাবে আস্বাদন করতে পারবে। সুতরাং দেশ-জাতির কল্যাণে শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার ও বেসরকারি শিক্ষা জাতীয়করণ অনিবার্য প্রয়োজন।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, কবি ও প্রাবন্ধিক।