দৈনিক ফেনীর সময়

ওজুহাতী দানবের আস্ফালন থামাবে কে?

ওজুহাতী দানবের আস্ফালন থামাবে কে?

মোটিভেশনাল ট্রেনিং সেশনে ট্রেনার বললেন, বলুনতো আমাদের কয়টা হাত? সবাই খানিকটা হকচকিয়ে গিয়ে আনমনে নিজ নিজ শরীরের দিকে কিঞ্চিৎ চোখ বুলিয়ে কাচুমাচু করে প্রকাশ করতে চাইলো, দু’টো হাতইতো দেখতে পাচ্ছি স্যার। ট্রেনার শরীরের অংগভংগি সমেত রস ছাড়তে ছাড়তে বললেন, আমাদের তিন’টা হাত। ডান হাত, বাম হাত এবং ওজুহাত। এই তৃতীয় নম্বর অদৃশ্য হাতটি হলো চলাকলা, চৌর্যবৃত্তি তথা দুষ্কর্ম্মের নাড়িভুড়ি। সত্যি তাই, এই অজুহাত নামক সর্ব কৌশলী হাতের চল-চাতুরী মন্ত্রজালে আমরা আটকে আছি। মাকড়সার জালের ন্যায় আষ্টেপৃষ্টে এমন ভাবে আঁটকে আছি একগিট খুলেতো তিনগিটে আবার আঁটকে পড়ি।

ওজুহাত কোভিড নাইন্টিন : করোনা কালের প্রথম ধাপ। সারা বিশ্বে ভয়, মৃত্যু, আতংক, অস্থিরতা। টেলিভিশনের স্ক্রলে নিবিড় চোখ। চীনে একদিনে কয়েক’শ মানুষের মৃত্যু। ইউরোপে করোনার থাবা। ইতালিতে শুধু লাশ আর লাশ। বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত। ইতালি প্রবাসী এক বিমান যাত্রীর শরীরে করোনা রোগ শনাক্ত। সরকারী স্বাস্থ্য বিভাগের বরাত দিয়ে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বললেন, ভয়ের কোনো কারন নাই। শেখ হাসিনার সরকার শক্ত হাতে করোনা দমন করবে।

টিভির স্ক্রলে দুঃসংবাদ। ঢাকা-চট্টগ্রামে করোনার বিস্তার। লকডাউন বাংলাদেশ। ঔষধ এবং জরুরী খাবারের দোকান ছাড়া সব বন্ধ। বন্ধ বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চ, ইস্টিমার, বন্ধ বিমান, বন্ধ অফিস, আদালত, কলকারখানা, বন্ধ দিন কামলা শ্রমজীবী মানুষের কাজ।

নগরে, শহরে, গ্রামে দরিদ্র মানুষের অভাব যন্ত্রনার সংবাদ লকডাউনের ছিদ্র গলিয়ে ভেসে আসছে খবরের কাগজে। ক্ষুধা লকডাউন বোঝেনা। পাড়া-প্রতিবেশী যারযার সামর্থ্যানুযায়ী চাল, ডাল, আলু, তেল, মুড়ি, লবন ইত্যাদি প্যাকেট সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এসেছে সরকারী সহায়তা। ঘরে বাইরে মানুষের মুখে মুখে মাস্ক। ঔষধের দোকান থেকে মুদির দোকান। অবশেষে ফুটপাত ও পথশিশুদের হাতে হাতে বিকিকিনির নয়া উপকরণ, মাস্ক। জীবন বাঁচাতে ঘন ঘন হাত ধোয়ার চর্চ্চা। দূরত্ব বজায় রেখে করো ভাব ভালোবাসা।

টিভির স্ক্রলে দুঃসংবাদ। সিলেটে করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা অপ্রতুলতায় তীব্র শ্বাস যন্ত্রনায় ১ম চিকিৎসকের মৃত্যু। দিনদিন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। করোনাক্রান্ত রোগীর সাথে পরিবারের নিকটজন, ডাক্তার, নার্সদের মানবিক, অতিমানবিক এবং অমনবিক আচরণের নানান রকম সংবাদ করোনা যোদ্ধা সাংবাদিকদের কল্যাণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সব ধরনের মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। লাশের পাশে নাই স্ত্রী, সন্তান আবার লাশ আগলে অজোরে বিলাপ করে চলেছে স্ত্রী, সন্তান। এমন অগণিত সংবাদ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। প্রকৃত অর্থে মানুষ মৃত্যুকে ভয়ানক রকমের ভয় করেছে। ভয়ে আতংকে জড়োসড়ো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে কিছু মানুষ রূপী পশু করোনাকে পুঁজি করে সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে অর্থ উপার্জনের নেশায় মত্ত থেকেছে। ডা. সাবরিনা, আরিফুল, সাহেদদের কথা জাতি এখনো ভূলে যায়নি।

করোনার ১ম ধাপে প্রায় সব শ্রেণীর মানুষের উপার্জনে স্থবিরতা নেমে এলেও মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের ব্যবসা বাণিজ্য কাজ কারবারে নেমে আসে দীর্ঘ স্থবিরতা। প্রাইভেট ফার্ম, এনজিও, স্কুল, কলেজ, হোটেল, মোটেল, গার্মেন্টসসহ বিবিধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে লাখ লাখ মানুষ কর্ম হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে। অসংখ্য প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। করোনার প্রথম ধকল যেতে না যেতেই দ্বিতীয় প্রকোপ। আবারও লকডাউন, কোয়ারান্টাইন। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে ইউক্রেন -রাশিয়ার যুদ্ধ। দ্রব্যমূল্যের ক্রমঃ উর্ধগতি। সরবরাহ সংকট, আমদানি অপ্রতুলতা ইত্যাদি ওজুহাতে জিনিসপত্রের দাম বেশখানিকটা বাড়ে কিছুটা কমে। এভাবেই চলছিল। জীবন যাপনে কষ্টের ভোজা ঘাঁড়ে ঝুলিয়ে মানুষ কায়ক্লেশে দিন অতিবাহিত করছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে নেমে আসে এক আততায়ী খড়গ।

ওজুহাতের দানব যখন সরকারের ঘাড়েঃ নাট্যাংশের এই সিকুয়ালটি সব থেকে নির্মম। রক্ষক এখানে ভক্ষকের ভূমিকায়। অর্থাৎ এই কষ্টকর মানিয়ে চলা জীবনযাপনের মাঝে গত ৫ আগষ্ট ২০২২ রাতের অন্ধকারে জনগণের ঘাড়ের উপর নেমে এলো তেল নামক তৈলাক্ত যন্ত্রনার খড়গ। সরকার সব ধরণের জ্বালানি তেলের মূল্য প্রায় ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। সরকারের ওজুহাত বিশ্ব বাজারের সাথে জালানী তেলের মূল্য সমন্বয় করা। মূল্য বৃদ্ধির ফলে ভারতে তেল পাচার বন্ধ হবে। কি হাস্যকর খোঁড়া যুক্তি। একই সময়ে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমেছে। ভারতেও তেলের দাম কমানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে পূর্ব কোনো ঘোষনা ছাড়া, সংসদে প্রশ্ন উত্তর, সামাজিক প্রতিনিধি পর্যায়ে আলোচনা ছাড়া স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার ন্যায় জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা ৮-১০ ঘন্টার ব্যবধানে সাধারণ মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলতে শুরু করে। অর্থাৎ বিষ প্রয়োগের ৮-১০ ঘন্টার মধ্যে শুরু হয় বিষের জ্বালা।

ওজুহাতের পাগলা ঘোড়ার দীর্ঘ লম্পঃ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রথম খড়গ নেমে আসে পরিবহন খাত থেকে। ট্যাংকিতে নতুন তেল ভরতে গিয়েই বাঁধে খটকা, খটকার ধাক্কায় চাপা পড়তে শুরু করে যাত্রী সাধারণ। পূর্বের ভাড়ার সাথে ৪০-৪৫ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করে বাস মালিকরা। ভাড়া বৃদ্ধি পায় ট্রাক, লরি, ট্রান্সপোর্টসহ সব ধরনের পরিবহনে। পরিবহনের বাড়তি ভাড়ার হিসাবের চাইতে বহুগুণে মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে পণ্যের। ৫-৮ টন পণ্য পরিবহনে বাড়তি ৩-৫ হাজার টাকা খরচ হলেও ঐ পরিমান মালে হিসেব করলে দেখা যাবে আগের তুলনায় বাড়তি মূল্য ক্ষেত্র বিশেষ কয়েক লাখ টাকাও হতে পারে। জীবন রক্ষাকারী ঔষধ, আমদানি ও দেশে উৎপাদিত ইলেক্ট্রিক, ইলেকট্রনিকস সামগ্রী এবং এর যন্ত্রপাতি, রড, সিমেন্ট, রং, বার্ণিশ, ক্যামিকেল, কাগজ, প্রসাধনী, প্রযুক্তি পণ্য, মুদি-মনোহারী, মাছ, মাংস, এমন কোনো জিনিস নাই যে পণ্যের মূল্য বাড়েনি। কিন্তু অভাক করার বিষয় হলো অশিক্ষিত, শিক্ষিত, উচ্চ শিক্ষিত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে মূল্যবৃদ্ধিতে নীতি-নৈতিকতার কোনো বালাই রইলো না।

ঢাকাটাইমস’এ প্রকাশিত ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখের সংবাদ শিরোনাম ছিলো, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি: ইউনিলিভার, সিটি গ্রæপসহ ৪৪ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা। সংবাদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় প্রকাশ পায়-

নিজেদের উৎপাদিত ও সরবরাহ করা পণ্যে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি করে প্রতিযোগিতা কমিশনের মামলার মুখে পড়ল বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার ও দেশের শীর্ষ স্থানীয় কয়েকটিসহ ৪৪ প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিটি গ্রæপ, রশিদ অ্যাগ্রো ফুড প্রোডাক্টস, বেলকন গ্রæপ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড, কাজী ফার্মস।

চাল, ডাল ও আটার মতো নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, কৃত্রিম সংকট এবং ভোক্তাদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরির অভিযোগে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার মামলা করেছে প্রতিযোগিতা কমিশন।

মামলার সুরাহা হতে হতে মানুষের যা হবার তা মরার উপর খড়ার ঘা শুকাবে বলে মনে হচ্ছেনা। রাক্ষুসে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উপর সরকার নমনীয় না হলেও দৃষ্টান্তমূলক জোরালো ক্ষমতা প্রয়োগের নজীরও ক্ষীণ বলেই প্রতীয়মান হয়।

মানুষের নূন্যতম পুষ্টি চাহিদা পূরণের অংশ ডিমের মূল্যও আকাশ ছোঁয়া। কোনো রকম বেঁচে থাকার চেষ্টায় সাধারণ জনগণ কাটছাট করে খাবারের চাহিদা পূরণ করছে। নিত্য যাদের ঔষধ সেবন আবশ্যক, সেখানেও কাটছাট। ঔষধের বাধ্যতামূলক কোর্স পূর্ণ করছেননা অধিকাংশ রোগী। সাধারণের কষ্টের জীবনের কথা বহুজাতিক, কর্পোরেট কিংবা স্থানীয় প্রতিষ্ঠান কেউ ভাবছেনা। সবার শুধু উচ্চমূল্য ভাগিয়ে নেয়ার নেশা। ভোট ভোটারের কথা খুব বেশী ভাবতে হয়না বলে সরকারী রাজনীতিকদেরও উদাসীনতা প্রশ্নবিদ্ধ। সামগ্রিক আলোচনা শেষে প্রশ্ন থেকেই যায় নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ওজুহাতী দানবের আস্ফালন থামাবে কে?

লেখক : চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!