বিশ্ব পরিবার দিবস আজ
মো: এমদাদ উল্যাহ, চৌদ্দগ্রাম :
রিবার একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের আয়না। মিলেমিশে সবাই একত্রে বাস করা হচ্ছে আদর্শ পরিবার। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা ও ভালোবাসার দৃঢ় বন্ধনের মাধ্যমে একজন মানুষ পরিবারের সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগ করে। এক কথায়-সামাজিক জীব মানুষের প্রথম ও প্রধান উপাদান হলো পরিবার। বর্তমান সমাজে পারিবারিক কলহ, অর্থ ও সম্পত্তির ভাগ-ভাটোয়ারার দ্বন্দ্বে ভাঙছে অধিকাংশ পরিবার। আর এ বন্ধন ভাঙছে বলেই মানুষ নানা সমস্যা সম্মুখীন হচ্ছে। পরিবার রক্ষায় অভিভাবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার প্রতি জোর দিয়েছেন সচেতন মহল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দিনদিন মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটছে। পৃথিবী এগিয়ে গেলেও পরিবারিক কলহ এবং সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের কারণে নষ্ট হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। সমাজে নিজ স্বার্থের কারণে অন্যের যে কোনো ধরনের ক্ষতি করতে কেউ কেউ আপন-পর কাউকে পরোয়া করে না। অনেকক্ষেত্রে জীবনযুদ্ধে হেরে গিয়ে বেশির ভাগ স্বামী-স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে গড়ে তোলে একক বা ছোট্ট পরিবার। আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার কারণেও গ্রাম-শহরে একক পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। চলতি শতাব্দীতে সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করা, পারিবারিক বন্ধন দুর্বল, ভবিষ্যৎ সঞ্চয়, চাকরি, ব্যবসাসহ নানা কারণে বাড়ছে একক পরিবারের সংখ্যা। বেশি বয়সে বিয়ে হওয়া, নারীদের বেশি বয়সে মা হওয়া, কোনো কোনো দম্পতির কম সন্তান নিতে পছন্দ প্রভৃতি কারণেও দেশে বাড়ছে একক পরিবারের সংখ্যা। এছাড়াও পরিবারের বাইরে কর্মসংস্থান, গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন-এসব কারণেও দেশে যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। অর্থাৎ জীবন ও জীবিকার তাগিদে দিনদিন ছোট হচ্ছে পরিবারের আকার। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে মূল্যবোধেরও।
জানা গেছে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৫ মে বিশ্ব পরিবার দিবস হিসেবে ঘোষিত হয়। জাতিসংঘ ১৯৯৪ সালকে বিশ্ব পরিবার বর্ষ ঘোষণা করেছিল। ১৯৯৬ সাল থেকেই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ কেমন হওয়া উচিত, পারিবারিক বন্ধন ও পরিবারের গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা এবং বাস্তবিক অর্থে পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য বিশ্বব্যাপী দিবসটি গুরুত্বসহকারে পালিত হয়।
চৌদ্দগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিবার ও সমাজ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী শেখ ফরিদ। তিনি বলেন, গত এক থেকে দেড় যুগে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। সমাজে নেই যৌথ পরিবার প্রথা বা সামাজিক শাসন। এছাড়া প্রবাসী স্বামীরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার কারণে স্ত্রীর ইচ্ছেমতো চলাফেরা। মোবাইল ফোনে প্রবাসীর স্ত্রীদের অপর পুরুষের সাথে পরকীয়াসহ সামাজিক অবক্ষয় বেড়েছে।
দেখা যায়, যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে আসা চাকরিজীবী মা-বাবা তাদের সন্তানদের কাজের লোক কিংবা চাইল্ড কেয়ারে রেখে বড় করছে। এতে কোমলমতি শিশু বাবা-মা এবং অভিভাবকের আদর থেকে বঞ্চিত হ”েছ। অর্থাৎ চাকরির কারণে অনেকে তাদের সন্তান এবং মা-বাবাকেও সময় দিতে পারছে না। এমনকি অনেকেই বৃদ্ধ মা-বাবাকেও পর্যন্ত ‘বৃদ্ধাশ্রম’ সেন্টারে রেখে আসতে বাধ্য হচ্ছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, নগরায়ণ, শিল্পায়ন, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ, শিক্ষার প্রসার, আর্থসামাজিক উন্নতি ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কারণে যৌথ পরিবারের পরিবর্তে একক পরিবারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।
অনেকের ধারনা, সাম্প্রতিককালে নারীরা চাকরি ও ব্যবসায় অংশগ্রহণ বেড়েছে। এছাড়া শ্বশুড়-শ্বাশুড়ির সাথে থাকলে প্রবাসীর স্ত্রী পরকীয়ায় বিঘ্ন ঘটে। ফলে শ্বশুড়-শ্বাশুড়ির সেবা যত্নে তাদের অনীহা লক্ষ্য করা যায়। এক পর্যায়ে, তারা একক পরিবার গঠনে স্বামীকে উৎসাহিত করে। একক পরিবার গঠন করা ইমাম হোসেনসহ অনেকে মনে করেন, যৌথ পরিবার থেকে আলাদা হলেই জীবনব্যবস্থা আরও উন্নত হবে। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। একক পরিবার হচ্ছে বিরক্তিকর পরিবার। এখানে বৃদ্ধদের সাথে শিশুদের কোন মায়া-মমতা নেই। সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় ও যৌথ পরিবার বিলুপ্তির কারণে শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া বড়দের প্রতি সম্মানবোধ ক্রমেই কমছে। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের চিন্তাধারা ও মতামতের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে যৌথ পরিবার বিভক্ত হচ্ছে। ফলে পারিবারিক বন্ধন দিনদিন দুর্বল হয়ে সামাজিক সমস্যা বেড়েই চলছে।
চৌদ্দগ্রাম থানা মসজিদের সাবেক খতিব ও কলামিস্ট সাইয়েদ রাশীদুল হাসান জাহাঙ্গীর বলেন, পরিবার সৃষ্টিকর্তার অন্যতম নিদর্শন। ইসলামে পিতা-মাতা, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততিসহ সবাই মিলে বাস করাকেই বলে পরিবার। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াকে ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না। পরিবারের সন্তানদের দ্বীনি জ্ঞান, আদব কায়দা ও ইসলামী শিষ্টাচার শিক্ষা দিতে হবে। তাহলে পরিবারের সবাই দ্বিনি বিধি-বিধান পালনে অভ্যস্ত হবে। বর্তমানে দ্বীনি শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবারে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। পারিবারিক শান্তি ফিরিয়ে আনতে দ্বীনি শিক্ষার বিকল্প নেই।