মাওলানা রশিদ আহমদ শাহীন
সালাত/নামাজ ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। সকল ইবাদতের সেরা হলো নামাজ। নামাজ মৌলিক ইবাদত, নামায ফারসি শব্দ, এর কুরআনী নাম হচ্ছে সালাত। সালাত শব্দের অর্থ দোয়া করা, ইস্তেগফার। মুসলিম জাতির জন্য সালাত বা নামাজ আল্লাহ রাব্বুল-আলামীনের পক্ষ থেকে বিশেষ নেয়ামত। কালেমা পাঠের মাধ্যমে একজন মুসলমান ২টি বিষয় স্বীকৃতি দান করে, প্রথমটি হচ্ছে, লা ইলাহ ইল্লাহু অর্থ্যাৎ আল্লাহ ছাড়া কাউকে ইলাহ মানবনা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে মোহাম্মদ (সঃ) আল্লাহর রাসূল ও রাসুলের (সঃ) এর সকল পদ্ধতি যথাযথভাবে পালন করব। পালন করার প্রথম ধাপটি হচ্ছে সালাত/নামাজ। বৃদ্ধ, যুবক, নারী, পুরুষ, পরিব, সুস্থ কিংবা রুগী প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতিটি মুসলমানের জন্য নামাজ ফরজ। নামাজ একজন মুমিন ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্য করে দেয় নামাজ ছেড়ে দেওয়া কুফরী কাজ। নামাজের মাধ্যমে একজন বান্দাহ তার প্রভুর সামনে আত্মসমর্পন করে। দৈনিক ৫ ওয়াক্তে নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ১৭ রাকাত নামাজ আদায় করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অবশ্যই কর্তব্য। নামাজ আল্লাহএবং বান্দার মধ্যে এক সুসম্পর্ক ও মযবুত বন্ধন তৈরী করে। যে মজবুত বন্ধনের কারণে বান্দাহ আল্লাহরপথে সকল প্রতিকুলতার মধ্যেও অবিচল থাকে। আর যখন কোন ব্যক্তি বা গোষ্টি এ নামায পরিত্যাগ করে তখন সে আল্লাহথেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে তারা আল্লাহর ইবাদতের পরিবর্তে নফসের গোলামী শুরু করে দেয়।
কোরআন ও হাদীসের আলোকে নামায : কোরআন মজীদে আল্লাহরাব্বুল আলামীন নামায কায়েম করার জন্য যা নির্দেশ দিয়েছেন। এবং বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) হাদীস শরীফে যে বানী ঘোষনা করেছেন, তা একটু গভীরবাবে চিন্তা করলে সহজে বুঝা যায় নামাজ কায়েম না করে বা নামাজ না পড়ে কোন ব্যাক্তি মুসলমান দাবী করতে পারেনা।
নামায কায়েম করার নির্দেশ : তোমরা নামায কায়েম কর এবং যাকাত দাও। (সূরা আল বাকারা-১১০) মহান আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেন: আমার বান্দাদের মধ্যে যারা মুমিন, তাদেরকে তুমি বল সালাত কায়েম করতে এবং আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি তা হতে গোপন ও প্রকাশ্যে বায় করতে। সেই দিনের পূর্বে যে দিন ক্রয় বিক্রয় বক্তৃত? থাকবেনা। (সূরা ইব্রাহীম- ৩১)
মহান আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেন:সূর্য ঢলে পড়ার পর হতে বাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করবে এবং কায়েম করবে ফজরের সালাত। নিশ্চয় ফজরের সালাত উপ¯ি’তির সময়। (সূরা ইসরা-৭৮)
মহান আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেন: তোমরা সালাত কায়েম করবে ও যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহও তার রাসূলের অনুগত থাকবে। (সূরা আহযাব-৩৩)
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স:) নামায কে ইসলামের মহান স্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে অভিহিত করেছেন। রাসূল (স:) বলেন, পাঁচটি স্তম্ভের উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত। (১) এক কথা স্বাক্ষ্য দেয়া যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্যনেই মুহাম্মদ (স:) আল্লাহতায়ালার রাসূল। (২) নামায কায়েম করা। (বুখারী, মুসলিম) তিনি এ কথা স্পষ্টভাবে বলেছেন যে নামায ‘পরিত্যাগ করলে কুফরীতে লিপ্ত হওয়া অনিবার্য।অনত্র বলেন, একজন ব্যাক্তি এবং কুফর ও শিরকের মধ্যে বিভাজনকারী রেখা হলো নামায় বর্জন। (মুসলিম) আল্লাহ ইবনে শাফীক আল উকায়লী হতেধর্ণিত রাসুল (স:) এর সাহাবী গণ নামায ছাড়া অন্য কোন আমল পরিত্যাগ করাকে কুফর মনে করনে না। (তিরমিযী)
পরিবার-পরিজনের প্রতি নামায : মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে আমাদের কে নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা শুধু নিজেরা নামায আদায় করলে চলবেনা। তোমাদের পরিবার পরিজনের নামাজ আদায় করার ব্যাপারে তোমাদেরকে পালন করতে হবে।
মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা পরিবার-পরিজনকে নামায শিক্ষার নির্দেশ দাও এবং তুমি নিজেও তা দৃঢ়তার সাথে পালন করতে থাক।
(সূরা ত্বোহা ১৩২) বলেন, বালক বালিকা যখন সাত বৎসর উপনীত হয়। তখন তাকে নামাযের আদেশ দাও। এবং যখন সে দশ বছর বয়সে পৌঁছে তখন নামায় না পড়লে তাকে প্রহার কর। (আবু দাউদ) হযরত লোকমান (আঃ) তার সন্তান কে বলেছিলেন হে আমার ছেলে, সালাত কায়েম কর, সৎ কাজের আদেশ দাও, মন্দ কাজ করতে নিষেধ কর এবং তোমার উপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য্যধারন কর। নিশ্চয় দৃঢ় সংকল্প থাকা জরুরী (সূরা লোকমান-১৭)
রাষ্ট্রীয় সরকারের দায়িত্ব নামায প্রতিষ্ঠা করা : একজন মুমিন ব্যাক্তির প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। তেমনিভাবে একজন মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল সমগ্র রাষ্ট্রে নামায কায়েম করা। এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলে- আমরা যদি তাদেরকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করি, তারা অবশ্যই নামায কায়েম করার ব্যবস্থা করবে। (সূরা হজ্ব-৪১)
নামাযের গুরুত্ব : মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে বলেন: তোমাদের নামাযগুলো সংরক্ষণ করা, বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামায, আর আল্লাহ সামনে এমনভাবে দাঁড়াও যেমন অনুগত সেবকরা দাড়ায়। (সূরা বাকারা- ২৩৮)রাসূল (সঃ) বলেন, যে ব্যক্তি নামায নষ্টকারী রূপে আল্লাহর সাথে সাক্ষ্যাৎ করবেন আল্লাহ তাঁর অন্যান্য কাজ গুলোর কোন গুরুত্ব দিবেন না। (তাবরানী) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে কুরতিন (রাঃ) বর্ণনা করনে,
রাসূল (সঃ) বলেছেন, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাযের হিসাব গ্রহণ করা হবে। বান্দাহ যদি এ হিসাব সন্তোষজনক ভাবে দিতে পারে তবে সে অন্যান্য আমলে ও কামিয়াব হয়ে যাবে। (তারগীব ও তাবরানী)একজন মুমিনের ওপর নামায এক অপরিহার্য ফরজ। নামাযই একমাত্র মুসলিম ও অমুসলিমদের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করে।
নামাযের শর্তাবলী : (১) ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণ, (২) পূর্ন বয়স্ক হওয়া, (৩), নামাযের সঠিক সময় হওয়া, (৪) নিয়্যাত করা, (৫) সব ধরনের অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জন করা, (৬) শরীরের নির্দিষ্ট অংশ আবৃত করা, (৭) কিবলামুখি হওয়া।
নামাযের রুকন সমূহ : (ক) সক্ষম ব্যক্তির জন্য ফরয নামাজগুলো দাড়িয়ে পড়া, (খ) তাকবীরে ইহরাম, (গ) সূরা ফাতিহা পড়া, (ঘ) রুকু করা, (ঙ) সিজদা করা, (চ) দুই সিজদার মাঝখানে বসা, (ছ)শেষ বৈঠকে তাশাহুদ পাঠ করা, (জ) সালাম ফিরানো, (ঝ) ধারাবাহিকতা অবলম্বন করা।
নামাযের প্রতিদান : (ক) ইহকালীন কল্যান: নামাযের সঠিক নিয়ম পদ্ধতি গুলো মেনে, যথা সময়ে যদি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া হয়, তাহলে এ নামায মানুষকে লজ্জাজনক ও নিষিদ্ধ কাজ হতে বিরত রাখে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতরাসূল(সঃ) বলেন তোমরা কি মনে কর যদি কারো ঘরের দরজায় কোন পুকুর থাকে এবং তাতে সে প্রত্যেক দিন পাঁচবার করে নিয়মিত গোসল করে তবে কি তার শরীরে কোন ময়লা থাকতে পারে? তোমরা কি বল? ছাহাবাগণ বললেন না, তার দেহে কোন ময়লা থাকতে পারেনা। তখন নবী করীম (সঃ) বলেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের দৃষ্টান্ত ঠিক এরূপ। (বুখারী)
(খ) পরকালীন মুক্তি : একজন মুমিন বান্দার সর্বোচ্চ চাওয়া এবং পাওয়া হল পরকালীন জীবনে সফলতা লাভ করা। পরকালীন জীবনে যদি সফলতা পাওয়া যায়, পরকালের জীবন শুধু শান্তি আর শান্তি। এ ক্ষেত্রে নামায পরকালীন সফলতার মাধ্যম। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- নিজেদের নামাযে ভীতি ও বিনয় অবলম্বনকারী মুমিনরা নিশ্চয় সফলকাম হবে। (সূরা আল মুমিনুন-১)
২)যারা নিজেরা নিজেদের নামায যত্ন সহকারে আদায় করবে তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং সম্মান লাভ করবে। (সূরা আল মারিজ- ৩৪-৩৫)
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স:) বলেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামায আল্লাহতায়ালা ফরয করেছেন, যে লোক তা যথাযথভাবে আদায় করবে এবং এর অধিকার ও মর্যাদার হক আদায় করবে এবং এক বিন্দুও নষ্ট হতে দিবেনা। তারজন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তিনি তাকে বেহেশতে দাখিল করবেন। আর যে লোক তা উক্তভাবে আদায় করবেনা তার জন্য আল্লাহর নিকট কোন প্রতিশ্রুতি নেই। তিনি ইচ্ছা করলে তাকে আজাব দিবেন, আর ইচ্ছা করলে তাকে জান্নাত দিবেন।
নামায না পড়ার শাস্তি : নামায না পড়ার কারনে আল্লাহতায়ালার পক্ষথেকে কঠিনশাস্তির ঘোষনা দেওয়া হয়েছে। হাশরের ময়দানে বে-নামাযীর অপমান করার ঘোষনা দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যেদিন কঠিন সময় আসবে এবং সিজদা করার জন্য ডাকা হবে, সেদিন এসব লোক সিজদা করতে পারবেনা। তাদের দৃষ্টি নত থাকবে। অপমান তাদের উপর ছেয়ে থাকবে। অথচ দুনিয়ায় সুস্থ থাকা অবস্থায় এদেরকে সিজদা করতে বলা হয়েছিল কিন্তু এরা অস্বীকার করেছিল। (সূরা কালাম- ৪২,৪২)
মহান আল্লাহ তায়াল অন্যত্র বলেন : সুতরাং ওয়াইল নামক দোযখের কঠিন শাস্তি সেই নামায আদয়াকারীদেন জন্য যারা তাদের নামায সম্পর্কে উদাসীন। (সূরা মাউন- ৪,৫)
নামায যেভাবে পড়তে হবে : নামায নিজের ইচ্ছামত আদায় করলে হবেনা। রাসূল (স:) বলেন: তোমরা ঠিক সে ভাবেই নামায পড়, যেভাবে তোমরা আমাকে নামায পড়তে দেখেছো। (বুখারী)
জামায়াতে নামায : একাকী নামাজ আদায় করার চেয়ে মসজিদে জামায়াতে নামাজ আদায় করা সবচেয়ে উত্তম। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স:) হতে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) বলেন, কোন ব্যক্তিকে মসজিদে নিয়মিত দেখলে তাকে মুসলমান বলে সাক্ষ্য প্রদান করবে। (তিরমিযী) পরিশেষে বলা যায় যে, নামায হলো তাওহীদের ভিত্তি এবং দ্বীনের বুনিয়াদ। বুনিয়াদ শক্ত হলে ঘর মজবুত হবে। আর বুনিয়া দুর্বল হলে ঘর কমজোরহবে। এটাই স্বাভাবিক। তাই নামাযেরআমল দিয়েই একজনের ভালো মন্দবিচার করা যায়।
লেখক : অধ্যক্ষ, তাযকিয়াতুল উম্মাহ মডেল মাদ্রাসা, ফেনী।