এম আবদুল্লাহ
তিন যুগ আগে সাংবাদিকতাকে যতটা না পেশা হিসেবে নিয়েছিলাম তার চেয়ে ঢের বেশি আসক্তিতে বুঁদ হয়েছিলাম। তেমনি পত্রিকা পড়াও আমার অদম্য নেশা। প্রতিদিন প্রকাশিত পত্রিকা এবং অনলাইন সংবামাধ্যম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে না পড়লে মনটার মধ্যে খচখচ করে। আর সংবাদমাধ্যম বা গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট সংবাদ ও প্রবন্ধ-নিবন্ধেতো চোখ বুলাতেই হবে। এই পড়ার নেশা, তার আবার বিপদও আছে। অনেক লেখা পড়ে আপ্লুত (!) হতে হয়ে। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত গণমাধ্যম পরিস্থিতি নিয়ে একটি নিবন্ধ পড়ে ‘আবেগাক্রান্ত’ হয়ে পড়েছিলাম প্রায়! প্রবন্ধে মহামতি লেখক জানিয়েছেন- দেশের গণমাধ্যমে এখন স্বর্ণযুগ চলছে। সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো সুখ-স্বর্গে আছে।
প্রবন্ধের লেখক তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে জানিয়েছন- “সরকারের গণমাধ্যমবান্ধব নীতির সুবাদে সারাদেশে বিপুলসংখ্যক পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে মিডিয়াভুক্ত পত্রপত্রিকার সংখ্যা ৭০০-র বেশি। এদের মধ্যে দৈনিক পত্রিকা ৫৬০টি, যার মধ্যে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় ২৫৫টি। শেখ হাসিনার সরকার ঘোষিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ দেশে ইলেকট্র্রনিক মিডিয়ার প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। …বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের পাশাপাশি সরকার এ পর্যন্ত ৪৫টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল, ২৭টি এফএম বেতার ও ৩১টি কমিউনিটি বেতারকে লাইসেন্স প্রদান করেছে। এর মধ্যে ৩১টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল, ২২টি এফএম বেতার ও ১৭টি কমিউনিটি বেতারকেন্দ্র বর্তমানে স¤প্রচারে রয়েছে এবং অন্যরা সম্প্রচারের প্রতি নিচ্ছে। এসব পরিসংখ্যান দিয়ে লেখক প্রমান করতে চেয়েছেন দেশে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম এখন অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে। এ দাবি অবশ্য প্রধানমন্ত্রী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী প্রায় করে থাকেন।
আলোচ্য লেখাটি প্রকাশিত হয় গত ১৬ জুন। সে দিনটি ছিল সংবাদপত্রের কালোদিন। ১৯৭৫ সালের এ দিনে ৪টি সরকারি প্রচারপত্র রেখে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। প্রবন্ধটি প্রকাশের দিন কয়েক আগে (৫ জুন) বাংলাদেশের সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন ‘নিউজপেপার ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) একটি গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে। হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত ওই সেমিনারে আলোচক হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে উপ¯ি’ত থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার। নোয়াব সভাপতি ও সমকাল পত্রিকার মালিক একে আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। উপস্থাপিত প্রবন্ধে তিনি জানান- দেশের সংবাদপত্রশিল্প এখন বড় সংকটে। একদিকে রয়েছে আর্থিক সংকট, অন্যদিকে আছে আইনি বাধা। মূল কাঁচামাল নিউজপ্রিন্টের এক টনের দাম ৫৭০ মার্কিন ডলার থেকে ১ হাজার ৫০ ডলার হয়েছে দেড় বছরে। এ কারণে এ শিল্প এখন রুগ্ন শিল্পে পরিণত হয়েছে। প্রচারসংখ্যা ও বিজ্ঞাপন কমে যাওয়ায় কমে গেছে আয়। এর মধ্যে আবার আছে নানা ধরনের করের বোঝা। সংবাদপত্রকে সেবাশিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হলেও শিল্পের সুবিধা পাচ্ছে না এ খাত। তাই এসব সংকট সমাধানে বাজেটে সংবাদপত্রের ওপর বিভিন্ন ধরনের কর প্রত্যাহার বা কমাতে হবে। এ ছাড়া আইনি বেড়াজাল থেকে মুক্তি দিতে হবে সংবাদপত্র তথা সংবাদমাধ্যমকে। সংবাদপত্রের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার নানা তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি সমাধানেও কিছু দাবি তুলে ধরেন প্রবন্ধকার।
সংবাদপত্রের ওপর আরোপিত করপোরেট কর এখন ৩০ শতাংশ। সংবাদপত্রের মতো রুগ্ন শিল্পের ওপর কর যদি আরোপ করতেই হয় তাহলে সেটি ১০ শতাংশ হতে পারে। অন্যদিকে নিউজপ্রিন্টে সব মিলিয়ে কর দিতে হয় প্রায় ২৭ শতাংশ। তাই আমদানি শুল্ককে শূন্য করা উচিত। আবার সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর উৎসে কর (টিডিএস) ৪ শতাংশ। উৎসস্থলে কাঁচামালের ওপরও ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) দিতে হয়। অথচ অধিকাংশ সংবাদপত্রের মোট আয়ের ৯ শতাংশ লভ্যাংশই থাকে না। বাজেটে এসব সমস্যা সমাধানে সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানান মালিকরা।
ওই গোলটেলিল আলোচনায় বক্তব্যে আমি বলেছিলাম- আপনাদের এসব আলোচনা ও দাবি অরণ্যে রোদন। প্রতি বছরই বাজেটের আগে আপনারা এসব দাবি তুলেন, আর সরকার তা উলঙ্গভাবে প্রত্যাখ্যান করে। যে দেশে প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকার বাজেট হয়, যে দেশে সংবাদপত্রের ১০০ কোটি টাকা বকেয়া বিজ্ঞাপন বিলের জন্যে মন্ত্রী, পাতিমন্ত্রী আর সচিবালয়ের কর্তাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হয় সম্পাদকদের। এর চেয়ে দু:খজনক আর লজ্জার কী হতে পারে! আমার এ কথাগুলো অনেকে সমর্থন করেন। আর বাস্তবে হয়েছেও তাই। ঘোষিত বাজেটে নোয়াবের একটি প্রস্তাবও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। নেবেইবা কেন? কথিত রুগ্ন শিল্পের অনেক মালিকতো সেবাদাসের ভূমিকায় থেকে তার সংবাপত্রকে সরকারের প্রচারপত্র এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে ‘মানপত্রে’ রূপান্তর করেছেন।
আর্থিক এসব সংকট-সমস্যার পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং প্রস্তাবিত ডাটা সুরক্ষা আইন, ওটিটি প্রবিধানমালা এবং নীতিমালা ও গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইনসহ অনেকগুলো নিবর্তনমূলক আইন গণমাধ্যমের জন্য বড় ধরনের হুমকি বলেও গোলটেবিল আলোচনায় উঠে আসে।
নোয়াবের এই গোলটেবিল আলোচনার আগে ২৪ মে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এক সেমিনারের আয়োজন করে। ‘বিশ^ মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত ওই সেমিনারেও আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ চার প্রভাবশালী কূটনীতিক বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থ’তি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে কড়া বার্তা দেন। ওই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল। তাঁর উপস্থাপনায়ও দেশের সংবাদমাধ্যমের দুর্দশার চিত্র উপেক্ষা করতে পারেননি। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের এখনকার সাংবাদিকতা হচ্ছে- ‘কুমিরভর্তি পুকুরে সাঁতার কাটা’র মতো।
এদিকে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত ২৬ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৮৯০টি মামলা হয়। প্রথম ১৫ মাসে গড়ে ৬০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পরবর্তী ৯ মাসে গড়ে ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। আর একক গোষ্ঠী বা স¤প্রদায় হিসেবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই বেশি মামলা হয়েছে। জরিপে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। আর মামলা যারা করেছেন, অর্থাৎ বাদীরা প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন কোনো সংগঠনের নেতাকর্মী অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য।
আইনটির বেশির ভাগ ধারা জামিন অযোগ্য। এ কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কারাগাওে থেকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি নিরপরাধ। এ পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, খুব কম ক্ষেত্রেই বিচার হয়েছে। বিচার করা এ আইনের প্রধান উদ্দেশ্য নয়; উদ্দেশ্য হলো ভয় পাইয়ে দেওয়া। অর্থাৎ এই আইনের মাধ্যমে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে।
আর বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় ১০ ধাপ যে পিছিয়েছে, সেটা এখন বাসি খবর। যেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে সাংবাদিকদের হাত-পা বেঁধে ফেলা হচ্ছে, সেখানে সূচকে বড় পতন স্বাভাবিক। যে দেশের সংবাদমাধ্যমে ব্যঙ্গ কার্টুন ছাপা যায় না, হাস্যকৌতুকমূলক কোনো লেখা প্রকাশ করা যায় না, সেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকবে কীভাবে? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি করাই হয়েছিল বিরুদ্ধমত স্তব্ধ করে দিতে। আর আইনটি প্রয়োগে পুলিশকে যথেচ্ছ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আইনের অধীনে দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত কোনো কাজের ফলে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সে জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মচারী বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না (নবম অধ্যায়ের ৫৭ নং ধারা)।’ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষতো খুব সরল। কোনো জটিলতা তাদের স্পর্শ করে না। এই সরল মানুষের সরল বিশ্বাসকে সরলভাবে ব্যবহার করছে ক্ষমতার বলয়ে থাকা দাপুটেরা। সরল বিশ্বাসে হলমার্ক চার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক জালিয়াতি করে উল্লসিত, পি কে হালদার প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা পাচার করে বন্ধু দেশে মাস্তি করে, সরল বিশ্বাসে একটা বালিশ নয় হাজার টাকায়, একটা পর্দা সাঁইত্রিশ হাজার টাকায়, একটা কাঠের চেয়ার এক লাখ পঁচাত্তর হাজার টাকায়, একটা কলাগাছ ছয় লাখ টাকায়, একটা নারিকেল গাছ বাষট্টি লাখ টাকায় কেনা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সরল বিশ্বাসে পুকুর কাটা, খিচুড়ি রান্না শিখতে বিদেশে চলে যাওয়া যাচ্ছে। সরল বিশ্বাসে মেগা প্রকল্প ১০ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু ৩১ হাজার কোটি টাকায়, ১১০০ কোটি টাকার পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর ৩৩০০ কোটি টাকায়, ২১০০ কোটি টাকার ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্প ৩৮০০ কোটি টাকায় নির্মাণ প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি আমরা। সরল বিশ^াসেই সুইস ব্যাংকে লুটের টাকা জমায় আমরা রেকর্ড গড়ছি। এভাবে সরল বিশ্বাসের ফিরিস্তি দিনে দিনে লম্বাই হচ্ছে।
ব্যক্তিকে হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে ব্যাংক, একজনের কারাভোগ অন্যজনকে দিয়ে দিচ্ছে, গায়েবি মামলায় জেলের ঘানি টানছে নিরপরাধ মানুষ, খুনের সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে বিদেশ থেকে ডেকে এনে ক্ষমা করে বিদেশে দলের দায়িত্ব দিচ্ছে, আবার খুনের মামলার আসামী চার্টার্ড ফ্লাইটে বিশ^ভ্রমণ করছে- এসবই সরল বিশ্বাসে চলছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সরল বিশ্বাসে চলমান আছে এবং আগামীতে এমনভাবেই চলমান থাকবে তা আশা করাই যায়। এসবের বিরুদ্ধে লিখলে তা ‘সরল বিশ্বাসেই প্রতি অবিচার (!) করা হবে। ফল হিসেবে খেতে হবে জেলের ভাত। জীবন কাটবে দৌদ্দ শিকের ভেতর।
সাংবাদিকের কাজ সংবাদ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সে সংবাদে যাদের আঁতে ঘা লাগে তারাই সাংবাদিক নির্যাতন করে। তবে সাংবাদিক নির্যাতনের তালিকায় সাধারণত আমজনতা থাকে না। খুঁটির জোর থাকলেই সাংবাদিক হয়রানি ও নির্যাতন করা যায়। এই খুঁটি হতে পারে রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক ক্ষমতা, হতে পারে রাজনৈতিক প্রভাব, লোকবলের দাপট ইত্যাদি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মীদের দ্বারা সাংবাদিক নির্যাতন যেন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রতি মাসে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন গড়ে ১৫ জনের অধিক সংবাদকর্মী। রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক খুঁটির জোরই সবচেয় বড় জোর। এছাড়া রাজনৈতিক ঘটনা অথবা কর্মসূচির জেরে অথবা জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও সাংবাদিক নির্যাতন হয়।
রাজধানীর বাইরে সাংবাদিকতার অবস্থা আরও নাজুক। রাজনৈতিক কারণে স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। বিভাগীয়, জেলা বা উপজেলা শহরের সাংবাদিকদেও স্থানীয় সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ‘ম্যানেজ’ করেই চলতে হয়, যেটা ঢাকার একজন সাংবাদিককে করতে হয় না। মফস্বল সাংবাদিকদের স্থানীয় প্রভাবশালী মহল, সন্ত্রাসী ও বড়ভাইদের সমীহ করে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হয়। জান বাঁচিয়ে মা-বোন-স্ত্রী সংসার নিয়ে এলাকায় থাকতে হলে চারদিকে চোখ কান খোলা রেখে সাংবাদিকতা করতে হয়। জান-মান বাঁচিয়ে তবেই জবানের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হয় সাংবাদিকদের। তা না হলে বুড়িচংয়ের সাংবাদকি মহিউদ্দিন সরকার নাঈম কিংবা কোম্পানীগঞ্জের সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কিরের মতো ভাগ্য বরণ করতে হয়।
অনেকে জান বাঁচিয়ে সাংবাদিকতা করতে পারলেও গুম অথবা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার, নিপীড়নের শিকার হওয়ার ভয় তাদের তাড়া করে। নিখোঁজ হওয়ার পর ভাগ্য ভালো হলে বাপ-মার কোলে ফিরে আসা যাবে। না হলে সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্নের মতোই হারিয়ে যাবে অজানা কোথাও। এ ভয়ও তো আছে। যাদের ভাগ্য ভালো তারা হয়তো ঢাকার সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের মতো ৫৪ দিনের মাথায় বাড়ি ফিরে আসতে পারেন। হামলা-মামলা-হয়রানি আগে ছিল খুচরা হিসেবে আর এখন হচ্ছে পাইকারি হারে। তবুও কোন লেখক কলমবাজি করে যদি প্রমান করতে চান যে, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকেরা এখন সোনালী দিনে সুখের নহরে ভাসছে তাতে কী ই-বা করার আছে।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশের সব অগ্রগতিতে এবং সব ক্ষেত্রে সাংবাদিক সমাজ বিশেষ ও বড় ভূমিকা পালন করেছেন। আর সব সময়ই এ দেশের মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের যা কিছু ভালো ও সাফল্য তার সবকিছুই দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে গণমাধ্যম। একই সঙ্গে সমাজের, রাষ্ট্রের ও সরকারের কিছু কিছু ভুলক্রতি সম্পর্কেও মতামত, বক্তব্য বা সংবাদ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরেই দেশের সংবাদমাধ্যমের সংকটটি অনেক কঠিন ও গভীর হয়েছে। স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে না পারায় এক যুগ ধরেই পাঠক, প্রচারসংখ্যা ও বিজ্ঞাপন কমছে। করোনা এসে এটিকে আরও ত্বরান্বিত এবং গভীর করে তোলে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ সংবাদমাধ্যমের সর্বস্তরের কর্মীদের ঐকতান। রুখে দাঁড়াতে হবে সব ধরনের কালাকানুন ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ চোখ রাঙানির বিরুদ্ধে।
লেখক : সভাপতি : বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)।