অনলাইন ডেস্ক:
এক অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিন কাটছে আমাদের। চৈত্রের খরতাপে পুড়ছে শহর, জনপদ, লোকালয়। আর আমরা পুড়ছি করোনাভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্কে। শহরের ব্যস্ত রাস্তাগুলো একেবারে ফাঁকা। বারান্দার রেলিংয়ে বসছে বুলবুলি, চড়ুই। দুপুরগুলোকে আরও বেশি বিষণ্ন করে তুলছে ঘুঘুর ডাক। দুপুরের নির্জনতা বাড়াচ্ছে ঝিঁঝি পোকা। কী আশ্চর্য! এসবই হচ্ছে আমাদের শহরে।
এই হঠাৎ পাওয়া নিরবচ্ছিন্ন অবসরের দুপুরগুলোতে দুরন্ত শৈশবের স্মৃতি ঘাই মারবেই। অনেক কিছুর সঙ্গে আমাদের শৈশবের চৈত্র-বৈশাখের নির্জন দুপুরগুলোর অনুষঙ্গ ছিল লুডু, দাবা, চোর-ডাকাত-পুলিশ, বাঘবন্দী, ষোলোগুটিসহ আরও কত যে খেলা! বয়স আর ব্যস্ততা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লুডুর গুটিতে জমেছিল ধুলোর আস্তরণ, দাবার বোর্ডের একটা কি দুটো সৈন্য হারিয়েই গেছে কোথায়, কে জানে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলুন। এবার বসে পড়া যাক। আপনারা হৃদয় খুঁড়ে বের করে আনুন হারিয়ে যাওয়া সময়কে। আমি বরং সেই ফাঁকে দুটি কথা বলে ফেলি খেলাগুলো নিয়ে।
লুডো
লুডো খেলতে বসলে পয়েন্ট চুরি হবে না, এমন কোনো কথা নেই। পয়েন্ট চুরি না করলে যেন লুডু খেলার মজাই আসে না। হরেক রকমের লুডু খেলার চল আছে। তার মধ্যে সম্ভবত জনপ্রিয় হচ্ছে সাপলুডু। সাদা রঙের ‘বুড়ো’ গুটির চালে ছক্কা না পুট উঠবে, তা ভেবে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে সবুজ, হলুদ, লাল আর নীল গুটিকে দু–একটি ঘরের হিসাব ওলট–পালট করে এগিয়ে নেওয়ার মজাই আলাদা। আবার হিসাবের ভুলে সাপের মুখে পড়ে একেবারে লেজে নেমে আসার আফসোস, সেটারও কোনো তুলনা হয় না।
আজ থেকে সাত-আট শ বছর বা তারও আগে লুডু খেলার আদি পর্বের শুরু প্রাচীন ভারতে। গবেষকেরা বলে থাকেন, লুডো খেলাটি প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় ইলোরার গুহায়। আজকে আমরা যে খেলাটিকে চিনি সাপলুডু নামে, সেই খেলার প্রাচীন নাম মোক্ষ পতম। এর আরও দুটি নাম পাওয়া যায়—পরম পদ্ম ও জ্ঞান চৌপর। এই নামগুলোর সঙ্গে অধ্যাত্মবাদের যোগাযোগ আছে, সেটা সহজে বোঝা যায়। এই খেলা শুধু বিনোদনের জন্যই খেলা হতো না প্রাচীন ভারতে; বরং আশ্রমবাসীদের নীতিনৈতিকতা শেখানোর জন্যও খেলা হতো।
খেলাটির মূল বিষয় ছিল জাগতিক মোহের গভীর দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ। সে জন্য জানা যায়, খেলোয়াড়েরা এই খেলা শুরু করতেন সহজ-সরলভাবে। তারপর খেলতে খেলতে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উচ্চস্তরে প্রবেশ করে চূড়ান্তভাবে মোক্ষ লাভ করতেন। সবাই যে মোক্ষ লাভ করতেন, তেমনটি নিশ্চয়ই নয়। কারও কারও পতনও হতো। এ জন্যই খেলাটির প্রাচীন নাম মোক্ষপতন। জ্ঞান চৌপর বা জান চৌপর নামকরণের পেছনে রয়েছে জৈন দর্শন। তাদের কাছে এ খেলা হলো ‘গেম অব উইজডম’।
প্রাচীন এই ভারতীয় খেলাকে ‘সাপলুডু’ নামে পরিচিত করানোর পেছনে মূলত ইংল্যান্ডের অবদান রয়েছে। তবে শুট অ্যান্ড ল্যাডার নামে এর যে সংস্করণটি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয়, ১৯৩৪ সালে সেটি বাজারে ছাড়েন মিল্টন ব্র্যাডলি নামের একজন মার্কিন ব্যবসায়ী, যিনি পৃথিবীতে পরিচিত বোর্ড গেম শিল্পের জনক হিসেবে।
দাবা
সৈয়দা জসিমুন্নেসা খাতুনকে কজন চেনেন? একটু হোঁচট খেলেন তো! আচ্ছা বলুন, রানি হামিদকে চেনেন কি না? এবার কিন্তু অনেকেই হাত তুলেছেন। রানি হামিদকে আমরা চিনি দাবা খেলার কারণে। বাংলাদেশের প্রথম নারী গ্র্যান্ডমাস্টার তিনি। দাবা খেলাটাও লুডোর মতোই ভারতীয় খেলা। এর প্রাচীন নাম চতুরঙ্গ। ধারণা করা হয়, উত্তর–পশ্চিম ভারতের কোথাও এ খেলার জন্ম। জন্মস্থানে এর নাম ছিল ছতরঙ। পরবর্তীকালে এই খেলা সিল্ক রোড ধরে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীময় এবং মুসলিম দুনিয়া ছতরঙ শব্দটিকে গ্রহণ করে। কিন্তু উচ্চারণে এটি হয়ে যায় শতরঞ্জ। শতরঞ্জ কি খিলাড়ি নামে সত্যজিৎ রায়ের সেই বিখ্যাত চলচ্চিত্রটির কথা মনে পড়ছে?
চতুরঙ্গ, শতরঞ্জ, দাবা, চেজ—যে নামেই ডাকি না কেন, খেলাটি নিয়ে বলতে শুরু করলে আলিফ লায়লারকাহিনি হয়ে যাবে। ১২০০ সালের দিকে দক্ষিণ ইউরোপে এ খেলার নিয়মকানুনগুলো পুনর্বিন্যাসের কাজ শুরু হয়। আজকে আমরা দাবা খেলার যে নিয়মকানুন দেখি এবং যেভাবে দাবা খেলি, তার সূচনা হয় ১২৪৫ সালের দিকে। দাবা খেলা মূলত একটি যুদ্ধের আদল। সৈন্যসামন্ত, হাতি, ঘোড়া, মন্ত্রী, রাজা—সবই এখানে উপস্থিত।
চোর–পুলিশ
‘চোর-পুলিশ-বাবু’ লেখাটি আবার এতটা ‘সিরিয়াস’ নয়। এটি নিছকই বিনোদনের খেলা। কয়েক টুকরো কাগজ, একটা গোটা কাগজের পাতা, একটা কলম আর আপনারা চার-পাঁচজন যা–ই হোন, বসে পড়ুন। এমন কোনো নিয়ম নেই। নিয়ম ভুলে গেলে নিজেরাই নিয়ম বানিয়ে নিন। এ জন্য দেখবেন, একেক এলাকায় এমনকি একেক বাড়িতেও এই খেলার একেক নিয়ম। কেউ বাবুকে দেয় ১০, তো কেউ দেয় ১০০০। কেউ পুলিশকে নম্বর দেয় ৫, তো কেউ ৫০০। কিন্তু চোরের নম্বর সবচেয়ে কম।
বাঘবন্দী
শিল্পী কফিল আহমেদের একটি গান আছে, ‘বাঘ বন্দী, সিংহ বন্দী/ বন্দী আমার হিয়া…’। সিংহ বন্দী না হলেও বাঘ বন্দী নামে আমাদের একটি খেলা আছে। এটাও দাবার মতোই বুদ্ধির খেলা এবং বাঘকে বন্দী করার খেলা। দুজন খেলোয়াড়ের মধ্যকার খেলা এটি। রূপক অর্থে বাঘ আর ছাগলের অসম লড়াইয়ের খেলা এটি। যেকোনোভাবেই হোক বাঘকে বন্দী করতে হবে, নইলে ছাগলের প্রাণ সংশয়। যিনি বাঘ হচ্ছেন, তিনি একটি গুটি নিয়ে খেলবেন আর যিনি ছাগল হচ্ছেন, তিনি তিনটি গুটি নিয়ে খেলবেন। লোকক্রীড়া গবেষকেরা এই খেলাকে দুটি ভাগে দেখেছেন। এর এক ভাগে আছে, শিকারজীবী মানুষের ইতিহাস, অন্য ভাগে লুডো কিংবা দাবা খেলার মতোই একটা আধ্যাত্মিক যোগাযোগের বিষয় রয়েছে এই খেলাতেও।
একই রকম আরেকটি খেলা আছে, ষোলোগুটি তার নাম। আমি নিজে চব্বিশ কিংবা বত্রিশ গুটি দিয়ে এই খেলা খেলতে দেখেছি বিভিন্ন গ্রামে। ষোলোগুটি খেলাটি বেশ জটিল। তার চেয়ে জটিল চব্বিশ কিংবা বত্রিশগুটির খেলা। দাবার মতোই বুদ্ধিদীপ্ত চাল আর সুদীর্ঘ পরিকল্পনার দরকার হয় এই খেলাগুলো খেলতে।