মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন :
দাগনভূঞা উপজেলার ইয়াকুবপুর ইউনিয়নের চন্ডিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষেই পিয়নের যৌন হয়রানীর শিকার হয়ে স্কুলে যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছে কয়েকজন ছাত্রী। পিয়ন হুমায়ুন কবীর এর হরহামেশা এমন ঘটনার প্রতিকার চেয়ে প্রধান শিক্ষককে জানানো হলেও তিনি কোন ব্যবস্থা নেননি। এ ঘটনায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল রোববার দৈনিক ফেনীর সময় এর প্রথম পাতায় “চন্ডিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: পিয়নের যৌন হেনস্তার শিকার ৫ শিশুর স্কুলে যাতায়াত বন্ধ” শিরোনামে সংবাদটি দেখে শিউরে উঠলাম।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও একাধিক অভিভাবক এর উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদটিতে উল্লেখ করা হয়, বেশ কিছুদিন ধরে হুমায়ুন কবীর শ্রেণিকক্ষে গিয়ে পঞ্চম ও চতুর্থ শ্রেণির কয়েকজন ছাত্রীকে শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেয়া সহ নানাভাবে যৌন হয়রানী করে। একইভাবে প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেন ছাত্রীদের দিয়ে শরীর ম্যাসেজ করিয়ে নেয়। এসব বিষয়ে প্রধান শিক্ষককে একাধিক অভিভাবক জানালেও তিনি কর্ণপাত করেননি। একপর্যায়ে অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের স্কুলে যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছেন।
একই প্রতিবেদনে ভুক্তভোগী একাধিক ছাত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে আরও উল্লেখ রয়েছে, পিয়ন হুমায়ুন কবীর শিক্ষক না হয়েও ক্লাস রুমে গিয়ে ছাত্রীদের শরীরের বিভিন্ন স্থনে হাত দেন। এ ব্যাপারে মারধরের ভয় দেখিয়ে শিক্ষক-অভিভাবকদের না জানাতে শাসিয়ে দেন।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে উত্তম কুমার নামে এক অভিভাবক এর বক্তব্য, “পিয়ন হুমায়ুনের কর্মকান্ডে অভিভাবকরা ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠছেন। তার স্ত্রী বিষয়টি প্রধান শিক্ষককে অবহিত করলেও কোন ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে পরিবার শংকার মধ্যে থাকেন। শুধু তাই নয়, স্কুল সংলগ্ন বাড়ির খামারে গরু-ছাগল ও মুরগির খামারে ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যস্ত রাখেন প্রধান শিক্ষক। এ ব্যাপারে তিনি জেলা প্রশাসক ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।”
শহীদুল ইসলাম পলাশ নামে আরেক অভিভাবক এর বক্তব্য, “অনেক মেয়েরা লজ্জায় বলতে পারেনা। তার মেয়ে স্কুলে যেতে না চাইলে বিষয়টি প্রকাশ হয়। এভাবে একে একে একাধিক অভিভাবক মুখ খুলতে শুরু করেছেন। এ ব্যাপারে প্রতিকার পেতে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।”
অভিভাবক হান্নান ভুট্টু বলেন, ‘ঘটনা শোনার পর তার মেয়ে সহ ৪-৫ জন ছাত্রী গত ৭-৮ দিন ধরে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদা আক্তার তানিয়া অভিযোগের তদন্ত করতে প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা সুজন কান্তি শর্মার সঙ্গেও কথা বলেন ফেনীর সময় এর প্রতিবেদক। সুজন কান্তি শর্মা বলেন, “ঘটনার তদন্তে সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় এলাকাবাসী, ভুক্তভোগী ছাত্রী, তাদের অভিভাবক ও অভিযুক্ত পিয়নের বক্তব্য নেয়া হয়েছে। প্রধান শিক্ষককে কর্মস্থলে না পাওয়ায় তাকে রবিবার সকালের মধ্যে হাজির হতে জানানো হয়েছে। দ্রুতসময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।”
সংবাদে উল্লেখ করা হয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেন এর বক্তব্যও। তার ভাষ্য, ‘হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধে আগেও যৌন নিপীড়নের অভিযোগের তদন্ত চলমান রয়েছে।’ অবশ্য গরু-ছাগলের খামারে নিয়ে তিনি যে ছাত্র-ছাত্রীদের কাজ করান এ বিষয়টি অস্বীকার করেন।
অভিযোগ অস্বীকার করেন অভিযুক্ত পিয়ন হুমায়ুন কবীরও। তার ভাষ্য, “পরিকল্পিতভাবে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। অতীতেও নানাভাবে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে।”
এদিকে ফেনী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন আহমেদ বিষয়টি জানার পর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে খোঁজখবর নিতে নির্দেশ দিয়েছেন বলেও ওই প্রতিবেদনের শেষাংশে উল্লেখ রয়েছে।
জগন্য এই ঘটনাটি কেবল চন্ডিপুরেই নয়, যেকোন অভিভাবক বা সচেতন মানুষ মাত্রই উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। যেন- রক্ষক যেখানে ভক্ষক। খোদ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুরা অনিরাপদ হলে তারা যাবে কোথায়! এর আগেও অত্র উপজেলায় নেয়াজপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিয়ন আনোয়ার হোসেন স্বপন এর নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে এক শিক্ষার্থী প্রাণ হারায়। এক বছর আগের এই পৈশাচিক ঘটনা পুরো দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিলো। অবশ্য স্বপনকে পুলিশ দ্রুত গ্রেফতার করে। এমনকি আদালতেও সে মেয়েটিকে যৌণ নিপীড়নের পর হত্যার দায় স্বীকার করে। আশা করছি এই ঘটনায় অভিযুক্ত স্বপন এর দৃষ্টান্ত মূলক সাজা হবে।
এর আগে একই উপজেলার মমারিজপুর মরহুম শামসুল হক মিয়া হাফেজীয়া মাদরাসায় এক শিশু শিক্ষার্থীকে যৌণ পীড়নের পর হত্যা করেন খোদ প্রতিষ্ঠান প্রধান। শুধু তাই নয় ঘটনার পর বেরিয়ে আসে আরও ভয়ানক তথ্য। প্রতিষ্ঠানটির আবসিক এ থাকা বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ওই শিক্ষকের যৌণ হেনস্তার শিকার হন। ওই ঘটনাতেও অভিযুক্ত শিক্ষক তাৎক্ষনিক গ্রেফতার হয়ে আদালতে নিজের দায় স্বীকার করেন। এর আগে পরে জেলাজুড়ে আরও অসংখ্য শিশু পীড়নের ঘটনা অনেকেরই জানা আছে।
শুরু করছিলাম চন্ডিপুর স্কুলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘটনাটি দিয়ে। এখানে পিয়ন হুমায়ুন কবীর এর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে, একইভাবে প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেন এর বিরুদ্ধেও অভিযোগ কম নেই। শিশু শিক্ষার্থীদের গরু-ছাগলের খামারে নিয়ে কাজ করানো বা তাদের দিয়ে শরীর মেসেজ করা- শিক্ষকতার নামে এ কেমন অসভ্যতা ! তাছাড়া পিয়ন হুমায়ুন কবির এর অভিযোগ সমুহ জেনেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়াও তাকে প্রশ্রয় দেয়া এমনকি স্বীয় অপরাধে সমর্থন দেয়ার সামিল। পাঁচ জন শিশু স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেও তিনি কোন পদক্ষেপ নেননি। অভিভাবকদের দেয়া বক্তব্য থেকে আশংকার বিষয় হচ্ছে শুধু ওই পাঁচ জনই নয় আরও অসংখ্য শিশু নিপীড়নের শিকার হতে পারে। আশা করছি তদন্তে প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসবে। ঘটনাটি জানার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দ্রুত তদন্তের ব্যবস্থা নেয়ায় এবং জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারও বিষয়টি আমলে নেয়ায় অভিভাবক ও স্থানীয়রা আশাবাদী হয়েছেন। আমরা আশা করবো এই জগন্য ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত করে প্রকৃত দোষীকে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেয়া হবে।