জাহাঙ্গীর আলম :
জাতি হিসেবে আমরা খুবই গর্বিত। এর অন্যতম কারণ, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা।আমরা মায়ের ভাষা বাংলাকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসা কতটা গভীর তার প্রমাণ ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষপপরে লেখা রয়েছে। ভাষার প্রেমে মুগ্ধ হয়ে বাংলা মায়ের সাহসী সন্তানেরা জীবন বাজি রাখতে কুণ্ঠিত হয় নি। কে জানতো এই ভালোবাসার পরীক্ষায় আত্মোৎসর্গ করতে হবে? কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। মাতৃভাষার জন্য রাজপথে জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছিল। বুকের তাজা উষ্ণ রক্তের বিনিময়ে শকুনের ছোবল থেকে মুক্ত করতে গহয়েছিল প্রিয় মাতৃভাষাকে। বিশ্বের ইতিহাসে কেবল বাঙ্গালি জাতিকেই ভাষার জন্য অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। বাংলার অকুতোভয় ছাত্রজনতা ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারি। এই দিনটি জাতীয় জীবনে ফিরে ফিরে আসে। বাঙ্গালি জাতির জীবনে দিবসটি অসাধারণ তাৎপর্যময়। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনেরর রয়েছে নানান ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। বলতে হয়,ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামক বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডটি জন্ম লাভ করার পর থেকেই পূর্বপাকিস্তানের ( বর্তমান বাংলাদেশ) বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা নিয়ে টালবাহানা, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। সময়টি ছিল ১৯৪৭ সাল।
পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পাকিস্তান সরকার, প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল লক্ষণীয়। নবগঠিত পাকিস্তান জন্মের ঊষালগ্ন থেকেই পূর্বপাকিস্তানের বিশাল জনগোষ্ঠীর সাথে তারা বৈষম্যমূলক, অনেকটা বিমাতা সুলভ পক্ষপাতিতা শুরু করে। ভ্রাতৃত্ববোধের অযুহাত তুলে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি শুরু থেকে পূর্বপাকিস্তান তথা বাঙ্গালিদের অবদমিত করে রাখার নানান পায়তারা করে আসছিল। তারই ফলশ্রুতিতে একই বছর করাচীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের একটি ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়। এতে প্রচারমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেবলমাত্র উর্দুভাষা ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলাকে তাদের অনুমোদিত বিষয়তালিকা থেকে বাদ দেয় ও সাথে সাথে মুদ্রা এবং ডাকটিকেট থেকেও বাংলা অক্ষর বিলুপ্ত করে। এতে করে পূর্বপাকিস্তানে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রদের একটি বিশাল সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দানের আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্ররা ঢাকায় মিছিল এবং সমাবেশের আয়োজন করে। বিক্ষোভে উত্তাল হতে থাকে বাংলাভাষা বাসী জনগণ। আন্দোলনরত ছাত্রসমাজকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন তৎকালীন বরেণ্য শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ। বাংলাভাষার প্রতি পাকিস্তানের অশ্রদ্ধা ও অবজ্ঞার প্রতিবাদে সে সময় ভাষাবিদ , গবেষক ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, “আমাদের যদি একটি দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ করার প্রয়োজন হয়, তবে আমরা উর্দুর কথা বিবেচনা করতে পারি।”
এর কিছুদিন আগে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর বরেণ্য শিক্ষাবিদ সর্বজন শ্রদ্ধেয় জনাব, আবুল কাসেম ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করলেন তমদ্দুন মজলিস নামক একটি সংগঠন। ১৫ সেপ্টেম্বর তিনিই প্রকাশ করলেন ভাষা আন্দোলনের উপর প্রথম বই ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’ ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ভাষা আন্দোলনে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বহু সংগঠন ও ব্যক্তির অবদান থাকলেও তমদ্দুন মজলিস ও তার প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের তরুণ শিক্ষক আবুল কাসেমের অবদান ছিল অনন্য। তমদ্দুন মজলিস ভাষার দাবিকে আন্দোলনে রূপান্তর করেছিল এই সংগঠনের মাধ্যমে। ১৯৪৮ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি সদস্যদের বাংলায় বক্তৃতা প্রদান এবং সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ইংরেজি ভাষায় দেওয়া বক্তৃতায় বাংলাকে অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে উল্লেখ করে ধীরেন্দ্রনাথ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবি তোলেন। এছাড়াও সরকারি কাগজে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান তিনি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান এ প্রস্তাবটিকে পাকিস্তানে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা বলে উল্লেখ করেন। উর্দুকে লক্ষ কোটি মুসলমানের ভাষা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কেবলমাত্র উর্দুই হতে পারে”।
এই ঘোষণারর পর পূর্বপাকিস্তানেরর জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে বিক্ষোভ দমনের পদক্ষেপ নেয়। কিন্ত ভাষা প্রেমিক ছাত্রজনতা তাতে ভয় পায় নি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- ছাত্রীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। তার মিছিলটি নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অপরাধে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। নিরীহ ছাত্রজনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে সে দিন পাকিস্তানি পুলিশ যে নৃশংস ও বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছিল তা বিশ্বের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে আজও পরিচিত। মিছিলের সম্মুখ ভাগে গুলি চালালে মুহূর্তে লুটিয়ে পড়ে ভাষা সৈনিক- সালাম, জাব্বার, রফিক,বরকত। এছাড়াও অনেক ছাত্র-যুবক আহত হয়। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শিক্ষক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা শোভাযাত্রাসহকারে ১৪৪ ধারাভঙ্গ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অমøান করে রাখার জন্য মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্ররা গড়ে তোলে শহীদ মিনার যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
এ বিজয় বাঙ্গালি জাতির, এ বিজয় বাংলাভাষার, এ বিজয় ছাত্রজনতার। সর্বোপরি, এ বিজয় ছিল ভাষার প্রতি অদম্য ভালোবাসার। সেদিন ভাষাসংগ্রামে বিজয় অর্জনের পর বাঙ্গালি জাতির মনে প্রবল আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয়। কীভাবে প্রতিকূল ও বৈরী পরিবেশে জাতীয় বিজয় ছিনিয়ে আনতে হয় সেই শক্তি ও মনোবল অর্জন করতে থাকে বাঙ্গালি। পাকিস্তান সরকারের চাপিয়ে দেওয়া কোন সিদ্ধান্ত মুখ বুজে সহ্য করে নি এ জাতি। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সালের ছয় দফা,৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখে জাতির সূর্য সন্তানেরা। সর্বশেষ ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনে বাঙ্গালিজাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন মহান স্বাধীনতা। ১৯৫২ সালের সংঘটিত ভাষা আন্দোলনে অভূতপূর্ব বিজয় লাভের মাধ্যমেই জাতির স্বাধীনতা অর্জনের সিংহদ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ইতিহাসের মানচিত্রে স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঙ্গালির আত্মপ্রকাশ। ক্রমেই ভাষাভিত্তিক মূল্যবোধ ও আত্মপরিচয়ে বিশ্বব্যাপী বাঙ্গালি জাতি পরিচিত হয়ে ওঠে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে মাতৃষাকে নিয়ে একটি গভীর হতাশার চিত্র আামাদের জাতীয় জীবনে দৃশ্যমান হয়। যা কোন ভাবে কাম্য হতে পারে না। সময়ের ব্যবধানে আমাদের মাতৃভাষা এখন অনাদরে অবহেলায় কুণ্ঠাসিত হয়ে পড়েছে। বিদেশি সভ্যতা- সংস্কৃতির প্রতি বেপরোয়া গতিতে আকৃষ্ট হয়ে ভুলে যেতে বসেছি নিজের ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে। সর্বত্র মাতৃভাষাকে অবজ্ঞার নীরব মহোৎসব চলছে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আইন -আদালত, ব্যাংক -বীমা, এবং কি মন্ত্রিপরিষদ, সচিবালয়, সরকারের যাবতীয় দপ্তরে বাংলাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শিশু বয়সে পরিবার থেকে বিদেশি ভাষার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে বেড়ে উঠছে আমাদের সন্তানেরা। মা -বাবার কাছে তারা শিখছে বিদেশি ভাষার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়ার ছবক। আমাদের অভিভাবক শ্রেণির মাঝে এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, লেখা পড়া করে একটা চাকুরী পেতে হবে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে হবে। ভালো মানুষ হতে হবে এমন স্বপ্ন আমরা আমাদের সন্তানদের দেখাতে ব্যর্থ হই। কারণ, আমরা শিল্প সাহিত্য নিয়ে খুব বেশি ভাবি না। শিক্ষার নগদ প্রাপ্তির দিকটা এবং বাজার মূল্যকে আমরা বড় করে ভাবতে শিখি এবং শেখাই। এজন্যই আমাদের প্রজন্ম শিক্ষিত হয়েও মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলছে। তাই সেবাব্রত নিয়ে অনেকেই এখন কোন পেশায় নিজেকে বিকশিত করতে পারছেন না। রাষ্ট্রীয় ভাবেও আমাদের বাংলা ভাষা অবহেলার শিকার। দেশীয় সাহিত্য ও সুষ্ঠুধারার সংস্কৃতি সে অর্থে উঠে আসছেনা, এর মূল করণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। ভাষাকে এগিয়ে নিতে হলে শিল্প- সাহিত্যকে রাষ্ট্রীয় ভাবে এগিয়ে আনতে হবে এবং সেগুলোকে রাষ্ট্রের সম্পদ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও আক্ষরিক অর্থে বাংলা বিষয়কে খুব গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হয় না। গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞানের বিষয়গুলো দিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান যাচাই করা হয় এবং এই বিষয় গুলোকে অধিক অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ফলে নিজস্ব ভাষায় ভাষাগত দক্ষতা অর্জন হয় না শিক্ষার্থীদের। মজার ব্যাপার হলো প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষা থেকে শুরু করে পাবলিক পরীক্ষাগুলোর কোথায় বাংলা বিষয়কে সে অর্থে গুরুত্বে সঙ্গে মূল্যায়ন করা হয় না। অথচ বিপরীত দিকের বিষয়গুলোতে তুচ্ছ কারণেও ফেল দেখানো হয়। এতে করে শিক্ষার্থীদের মনে এমন ভাবের উদয় হয় যে,বাংলা কোন বিষয় নয়, পরীক্ষার আগের রাতে একটু পড়ে নিলেই হয়। এমন ধারণা থেকে অনেক শিক্ষার্থী নিজের মাতৃভাষাকে গুরুত্বহীন মনে করে চলছে। প্রকৃত পক্ষে তাদের অধিকাংশই নিজের ভাষাতেই দুর্বল হয়ে গড়ে উঠছে। যে নিজের ভাষায় দুর্বলতা নিয়ে বেড়ে উঠে সে অন্য ভাষা ও অন্যান্য বিষয়ে খুব একটা পারদর্শী হয়ে উঠতে পারে না। প্রচলিত শিক্ষা তথা বাংলা মিডিয়ামকে অবমূল্যায়ন করে ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা পদ্ধতিকে নিজেদের সন্তানের জন্য গ্রহণ করে নিচ্ছে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল মহল, মন্ত্রী, এম. পি, সচিব ও উচ্চাবিলাসী ধনীক শ্রেণী। যত দিন যাচ্ছে এই মানসিকতা মধ্যবিত্ত -নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজেও জেগে উঠছে। এই অতিরঞ্জিত ইংরেজি প্রিয়তা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েই বিকশিত হতে চলছে। ইংরেজি ভাষা আবশ্যই শিখতে হবে, জানতে হবে। তবে তা নিজের মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে অথবা ছোট জ্ঞান করে নয়। দেশের সকল শিক্ষার্থীর মাঝে বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মানসিকতা থাকা দরকার। অপর দিকে ইন্টারন্যাশনাল ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে সহজ ভাবে পাঠদানের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। একই সাথে বাঙ্গালি ছাত্রদের জন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।
এ জাতীয় শিক্ষামাধ্যমগুলো শিক্ষার চেয়ে শিক্ষা বৈষম্যই সৃষ্টি করছে। দেশের সকল শিক্ষার্থীর জন্য প্রচলিত বাংলা মিডিয়ামে শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে তাতে সকলের জন্য সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় ইংরেজি ভাষা শেখার মতো পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে, সরকারি বেসরকারি অফিস- আদালতে, চাকুরীর ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় সর্বোচ্চ ইন্টার্ভিউ পেইজ করার ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা উচিত। অকারণে কথায় কথায় নিজের পাণ্ডিত্য প্রকাশ করতে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার বন্ধ করা দরকার। বাংলা ভাষায় কথা বলার সময় এক শ্রেণির শিক্ষাবিদ কথায় কথায় ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ করিয়ে থাকেন। টিভি- টকশো- প্রচার মাধ্যমে এধরণের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এজাতীয় রঙ-ঢ়ং দেখে দেখে প্রায়োগিক জীবনে মাতৃভাষার ব্যবহার গুরুত্বহীন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে ভুলতে বসেছি। তাই বিজাতীয় সভ্যতার অন্ধ অনুকরণ করতে যেন এক রকম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলছি। এটা বাঙ্গালি জাতি, বাংলাভাষা, সাহিত্য,সংস্কৃতি ও বাঙ্গালি সভ্যতার জন্য মারাত্মক হুমকি। যেকোন জাতির পরিচয় টিকে থাকা না থাকার বিষয়টি নির্ভর করে সে জাতির ভাষার উপর। পৃথিবীতে সে জাতি ততো বেশি উন্নত যে জাতির ভাষা ও সাহিত্য যতো বেশি উন্নত ও সমৃদ্ধ। যে জাতি নিজস্বতাকে হেয় জ্ঞান করে অন্যকে অনুকরণ করে, কালের ব্যবধানে সে জাতি আস্থাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়।
তাই অতি আধুনিকতার খাতায় নাম লিখাতে ব্যস্ত না হয়ে জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্যকে ধারণ করা উচিত। একাজটি সম্মিলিত ভাবে করতে হবে। সবার মাঝে দেশাত্মবোধ জাগাতে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। জাতিগত বিভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্যের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। প্রজন্মের মাঝে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব, চেতনা, তাৎপর্য যথাযথ ভাবে তুলে ধরতে হবে। মাতৃভাষা বাংলাকে ভালোবাসতে শিখতে হবে। জানতে হবে ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস ও গুরুত্ব। মাতৃভাষাকে ভালোবেসে যারা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন তাদের আত্মদানের অমর গাথা প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, কবি ও প্রাবন্ধিক।