শিক্ষার উন্নয়নে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। পরিবারের পর শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের বিকাশ ও মানবিক মূল্যবোধের বিষয়টি গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষকদের। প্রথমেই মনে রাখতে হবে, শিক্ষক একজন মানুষ। তাঁর জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, তবে সেই সীমাবদ্ধ জ্ঞান কিভাবে প্রসারিত করে শিক্ষার্থীদের সমৃদ্ধ করা যেতে পারে সে বিষয়টি তাঁকে ভাবতে হবে। আর জ্ঞানচর্চা অব্যাহত রাখার মাধ্যমেই এটি সম্ভব। আগের দিনের শিক্ষকরা জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে যেভাবে তাঁদের অবদান রেখেছেন সেটি বর্তমানে বিদ্যমান আছে কি না তা ভেবে দেখা দরকার। আবার জ্ঞানের গভীরতা জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমেই গড়ে তোলা সম্ভব। এই গভীরতার বিষয়টি এক দিন বা দুই দিনে গড়ে ওঠে না। এর জন্য দীর্ঘ মেয়াদে নিজেকে জ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখতে হয়। কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের যে পরিবর্তন ও উৎকর্ষ ঘটছে তার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে না পারলে জ্ঞান এগিয়ে যায় কিন্তু মানুষ জ্ঞান অর্জনে পিছিয়ে পড়ে। আর যখন জ্ঞানবিচ্যুতি ও পশ্চাৎপদতা একজন মানুষকে প্রভাবিত করে তখন তার উন্নত ও সর্বজনীন চিন্তাশক্তি লোপ পায়।
অনেক সময় পুঁথিগত বিদ্যার কথা বলা হয়, যা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়। এটি হলো একজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জ্ঞান যদি পাঠ্য বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এই সীমাবদ্ধতা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে এক ধরনের রক্ষণশীলতা তৈরি করে। ফলে পাঠ্য বইয়ের বাইরেও যে জ্ঞানের অনেক অজানা বিষয় ও জগৎ আছে, তা ভাবার মতো মন ও মানসিকতা তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে না। এতে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের বিষয়টি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়। আর জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন করা না গেলে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলা সম্ভব নয়। যদিও ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষিত হয়েছে, কিন্তু জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের মাধ্যমে উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের কিভাবে গড়ে তোলা যায় তার কোনো জাতীয় নীতিমালা এখন পর্যন্ত তৈরি করা সম্ভব হয়নি। কিভাবে আমাদের দেশের মানুষের মানসিকতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন করা যায় তার কোনো ধরনের গবেষণা নেই বললেই চলে। এ জন্য কোনো বিশেষায়িত গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায় কি না তা নিয়ে ভাবতে হবে।
একটি কথা এখানে না বললেই নয়, তা হলো সমাজ গঠনে সমাজ সংস্কারকদের প্রয়োজন যুগে যুগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। কিন্তু স্বার্থহীন উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করার জন্য আগের মতো সমাজ সংস্কারক খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। আগের দিনের সমাজ সংস্কারকদের মতো পুরো সমাজের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে সত্য কথা বলার এবং ন্যায়সংগত পথে সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার সাহস ও দৃঢ়তা বর্তমান সময়ের সমাজ সংস্কারকদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রক্রিয়া প্রকৃত সমাজ সংস্কারকের অভাবে গড়ে উঠছে না। এর প্রধান কারণ হলো, মানুষ এখন সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার চেয়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থকে গুরুত্ব দিচ্ছে, যা একটি অগ্রসরমান সমাজব্যবস্থায় কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
সাম্প্রতিককালে একটি বিষয় লক্ষণীয় তা হলো অনুপ্রাণিত করার মতো ও অনুসরণীয় শিক্ষক বা শিক্ষাবিদের সংখ্যা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে, যা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের অন্তরায়। এর কারণ হলো জ্ঞান আহরণের অনেক বিকল্প বের হলেও শিক্ষকদের মধ্যেও জ্ঞান বিতরণের চেয়ে জ্ঞান বাণিজ্যিকীকরণের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ জ্ঞানকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছে মানুষের মানসিকতাকে সেভাবে সমৃদ্ধ করেনি। বিষয়টি এভাবে বিশ্লেষণ করা যায়, মানুষের যখন কোনো একটি বিষয় জানার প্রয়োজন হচ্ছে, তখন সে গুগল ও ইয়াহুর সাহায্যে সহজে সেটি বের করে সাময়িকভাবে তার প্রয়োজন ও সমস্যার সমাধান করছে। কিন্তু বিষয়টির উৎস, কারণ, বিশ্লেষণ, গভীরতা ও এর বিকল্প পন্থাগুলো যে জানার এবং তা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে, সেটির বোধশক্তি মানুষের মধ্যে ক্রিয়াশীল হচ্ছে না। ফলে সেটি মানুষকে প্রকৃত জ্ঞানী করে তুলছে না; বরং এ ধরনের মানসিকতা তাকে প্রযুক্তিনির্ভর করে তুলছে। এতে মানুষের জ্ঞানের যে ধরনের স্বকীয়তা ও উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তি গড়ে উঠে তাকে প্রকৃত জ্ঞানে সমৃদ্ধ করার কথা ছিল তা হচ্ছে না।
গবেষণার মাধ্যমে কোনো একটি বিষয়ের যে ক্রমাগত পরিবর্তন ঘটছে, সেই পরিবর্তনের প্রবণতা ও ধারা অনেক শিক্ষকের মধ্যে আজ খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। যদিও বলা হয়, গবেষণার বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যই শুধু প্রযোজ্য, কিন্তু আজকের যুগে সেটি আর সত্য হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না। এখন এটি বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকদের জন্যও প্রযোজ্য।
সম্প্রতি আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো দেশগুলোতে শিক্ষকদের নেতৃত্বের গুণাবলি বিবেচনায় আনা হচ্ছে। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বিষয় অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এখনকার আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শুধু ডিগ্রি অর্জনের সার্টিফিকেটের চেয়ে একজন মানুষের মানবীয় গুণাবলি, আচার-আচরণ, দেশের প্রতি তার আনুগত্য, নীতি-নৈতিকতা, জীবনাচরণ, সামাজিক দায়বদ্ধতা, কর্মক্ষেত্রে তার সাফল্য ইত্যাদি বিষয়কে গুরুত্ব প্রদান করে। আর এ ধরনের আচরণগুলো একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষকের ইতিবাচক ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে গ্রহণ করবে। এটাকে অনুসরণ করা বলা হলেও কোনোভাবেই অনুকরণের পর্যায়ে আনা উচিত নয়। এতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যক্তিসত্তা নষ্ট হয়, যা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের পক্ষে মোটেও অনুকূল নয়। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, জ্ঞানভিত্তিক সমাজের বদলে শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষমতাভিত্তিক সমাজের বিরূপ প্রভাব দেখা দিচ্ছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষালয়ের মধ্যে যখন জ্ঞানচর্চার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ না হয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিষয়টি প্রাধান্য পায়, তখন শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।
আশার কথা হচ্ছে, সরকার জ্ঞানভিত্তিক সমাজকাঠামো গড়ে তোলার জন্য জাতীয় শুদ্ধাচার নীতিমালা, যৌন নিপীড়ন বিরোধী কমিটি গঠনের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনকে কলুষমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। মাদক ও জঙ্গিবাদ শিক্ষালয়ে প্রবেশ করছে, যা শিক্ষার্থীদের জীবন যেমন বিপন্ন করছে, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকেও ভারসাম্যহীন করে তুলছে। ফলে এখানে শিক্ষকদের দায়বদ্ধতার বিষয়টি চলে আসে। একজন শিক্ষক যদি রক্ষণশীল ও জঙ্গি মনোভাবাপন্ন হন তাহলে তাঁর দ্বারা অনেক শিক্ষার্থী বিপথে যেতে পারে। এজন্য উন্নত মানসিকতা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির প্রকৃত জ্ঞানপিপাসুদের শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত করা গেলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। তা না হলে শিক্ষা তার প্রকৃত গতিপথ হারিয়ে সমাজকে বিবেকশূন্য করে ফেলবে, যা একটি জাতির অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে পারে।
শিক্ষার গুণগত মান যত শক্তিশালী হবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজের ভিত্তি তত দৃঢ় হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপে আইকিউএসসি গঠিত হয়েছে, যা শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে কাজ করেছে। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, যে পরিকল্পনা নিয়ে শিক্ষার গুণগত মান বজায় রেখে ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আনার প্রচেষ্টা চলছে তা বজায় রাখা যাবে কি না। এজন্য দায়বদ্ধতা, নজরদারি ও জবাবদিহির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নৈতিকতা। এই নৈতিকতা শুধু শিক্ষকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বঙ্গবন্ধু ছাত্রজীবনে নীতি ও আদর্শের রাজনীতি করে গেছেন, মহাত্যাগের মাধ্যমে মহা-অর্জন সম্ভব—এটি ছিল তাঁর রাজনীতির মূল ভিত্তি। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রে এখন নীতির বিষয়টি কাজ না করে এটিকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হচ্ছে, যা জ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদী আধুনিক সমাজে মোটেও কাম্য নয়। এ পি জে আব্দুল কালাম বলেছেন, ‘যদি কোনো দেশ দুর্নীতিমুক্ত হয় এবং সবার মধ্যে সুন্দর মনমানসিকতা গড়ে ওঠে, আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি, সেখানকার সামাজিক জীবনে তিন রকম মানুষ থাকবেন, যাঁরা পরিবর্তন আনতে পারেন। তাঁরা হলেন পিতা, মাতা ও শিক্ষক।’ আর এটি সম্ভব শুধু জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের মাধ্যমে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে, জ্ঞানভিত্তিক আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। আর যদি এটি সম্ভব হয় তাহলে সব অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা ও মনোবল রাখে বাংলাদেশ।
লেখক : ব্যাংকার, কবি ও প্রাবন্ধিক।