মো: মাঈন উদ্দীন :
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি বাংলাদেশের একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। এটি ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ইসলামি ব্যাংক। এ ব্যাংকটি অধিকাংশ সূচকে অনেক আগেই দেশের সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংককে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর টেকসই উন্নয়নে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন যাত্রায় ইসলামী ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। এবারও জুন ২০২৪ শেষে ইসলামী ব্যাংক ১ লক্ষ ৫৯ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকার আমানত নিয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে। শুধু তাই নয় বৈদেশিক রেমিট্যান্স আহরণেও সবোর্চ্চ অবস্থানে এ প্রতিষ্ঠান। এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি ৩.৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেছে যা বাংলাদেশী টাকায় ৪০ হাজার কোটি টাকার সমান । দেশের মোট রেমিটেন্সের ২৬ শতাংশ এসেছে এ ব্যাংকের মাধ্যমে। এটি এই ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা ও বিশ্বাসের বহি: প্রকাশ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ইসলামী ব্যাংকের আমানত ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। আমানতকারীদের হিসাব সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৩০ লাখ। ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ এ ব্যাংকের আমানত ছিল ১ লাখ ৪১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ৩০ জুন ২০২৩ এ ছিল ১ কোটি ৪৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের ৩০ জুন যা প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি পায়। ২০২১ সাল শেষে আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান ব্যাবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মনিরুল মওলা একটি দৈনিকে সাক্ষাৎকার বলেছেন ইসলামী ব্যাংকের আমানতের সিংহভাগই ব্যক্তিশ্রেণীর। দেশের সব অঞ্চলের শ্রেণী-পেশার মানুষই আমাদের গ্রাহক। এ গ্রাহকই ইসলামী ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমানতকারীরাই আমাদের শক্তি। যেকোনো পরিস্থিতিতে এসব গ্রাহক ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে বিশেষ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেছিলাম। এর প্রত্যক্ষ ফলও আমরা পেয়েছি। ২০২৩ সালে ইসলামী ব্যাংকের ইতিহাসের সর্বোচ্চসংখ্যক ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে। প্রায় ৮ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইসলামী ব্যাংক পরিবারের সদস্য। সারাদেশে বিস্তৃত রয়েছে ইসলামী ব্যাংকের ৩৯৪ শাখা। এসব শাখার অধীনে পরিচালিত হচ্ছে ২৪৯টি উপশাখা ও ২ হাজার ৭৭১টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট। দেশের এমন কোনো বড় বাজার নেই, যেখানে এখন ইসলামী ব্যাংকের উপস্থিতি পাওয়া যাবে না। মানুষের সীমাহীন ভালোবাসার কারণেই এটি অর্জন সম্ভব হয়েছে।
ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৮৮ লাখ লোকের কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করেছে এই ব্যাংক। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসলামী ব্যাংকের অবদানকে মূল্যায়ন করছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক দ্য এশিয়ান ব্যাংকার্স ম্যাগাজিন ইসলামী ব্যাংককে ‘স্ট্রংগেস্ট ব্যাংক ইন বাংলাদেশ’, অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেছে। এ দেশের ব্যাংকিং ও অর্থনীতির জন্য একটি বড় স্বীকৃতি। এছাড়া বিগত ১০ বছর ধরে বিশ্ব সেরা এক হাজার ব্যাংকের তালিকায় ইসলামী ব্যাংক দেশের শক্তিশালী ব্যাংক হিসেবে অবস্থান করছে। ইসলামী ব্যাংকিং-এর ৪১ বছর পথচলায় দেশের আরো ৯টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকের পথচলাকে সুগম করেছে। কাজেই এই ব্যাংকের প্রতি জনগণের আস্থা এত সহজেই দুর্বল হওয়ার নয়। দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে যে ব্যাংকটির আস্থা ও বিশ^াসের সাথে জনগণের আমানতের হেফাজত করছে তা এত সহজে নষ্ট হওয়ার নয়। এই ব্যাংকের কর্মচারীদের সাথে গ্রাহকের আন্তরিকতা ও আস্থা বিরাট শক্তি। দেশের অর্থনীতিকে যে ব্যাংক নেতৃত্ব দিচ্ছে, সেই ব্যাংক সম্পর্কে নানা গুজবে গ্রাহকরা ভীত নয়। তারা তাদের আমানত এই ব্যাংকেই রেখে যাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ কাঠামো পণ্য বেচাকেনার সাথে সম্পৃক্ত থাকায় এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণও কম। ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল অ্যাপস চালু ও ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের প্রসার ঘটিয়েও ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের সেবা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যে অবদান রাখাসহ সামাজিক কর্মকাণ্ডে যেমন গরিব মেধাবীদের বৃত্তি প্রদান, দরিদ্রদের মাঝে বিভিন্ন সময় নানা সাহায্য প্রদান, হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারা প্রবর্তন, ভারসাম্য ও শোষণমুক্ত সমাজ ও সম্পদের সুষম বণ্টনের কাজ করার ক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ইসলামী ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে।
বর্তমানে দেশে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মোট আমানত প্রায় চার লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি যা ব্যাংকের মোট আমানতের ২৭ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংকগুলোর মোট বিনিয়োগ প্রায় তিন লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা ব্যাংক খাতে মোট বিনিয়োগের ২৯ শতাংশ। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলো অনেক অবদান রেখে চলেছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে আসা মোট রেমিট্যান্সের ৫২ শতাংশ আসছে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমানত, মুনাফায় ও অপারেটিং বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। দেশের মোট বিনিয়োগের প্রায় ১২ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ ইসলামী ব্যাংকের। বৈদেশিক মুদ্রার শীর্ষে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। সারা বিশ^ থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা আসে তার ২৯ শতাংশ আসে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। পল্লী উন্নয়নেও ইসলামী ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। দেশের কৃষি শিল্প কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন, বীজ, সার সরবরাহ, গার্মেন্ট খাতে ইসলামী ব্যাংক অনন্য অবদান রেখে চলেছে। কৃষি আমাদের জীবনে সাথে মিশে আছে। শিল্পের অনেক কাঁচা মাল কৃষি থেকে আসে। আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় অনেক পণ্য কৃষি থেকে আসে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ইসলামী ব্যাংক ৬৬১কোটি টাকা দরিদ্র কৃষকের মাঝে বিতরণ করে। কৃষি খাতের উন্নয়নে বিশেষায়িত ব্যাংক বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ১ হাজার ৫২৭কোটি টাকা ঋন বিতরন করে। ইসলামী ব্যাংক কৃষি খাতে বিনিয়োগে দ্বিতীয় অবস্থানে।
কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, গ্রামের দরিদ্র শ্রেণীর মাঝে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ বিতরণে ও নানা আর্থিক সাহায্যে ইসলামী ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকের প্রবৃদ্ধি ও উন্নতির অন্যতম কারণ হলো, মানুষের আস্থা ও ব্যাংককর্মীদের এক ঘনিষ্ঠ কর্মতৎপরতা। ইসলামী ব্যাংক দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে প্রবাসী আয়ে শীর্ষস্থানে রয়েছে। ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে নিজস্ব আমদানি ব্যয় পরিশোধের পর এ পর্যন্ত সরকারি রিজার্ভে ১২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি যোগ করে অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রেখেছে। সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ ও প্রবাসী সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় দেশী-বিদেশী নানা পুরস্কার ও স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। বিশ্বের ৬৪টি দেশের ৫৯৪টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে ইসলামী ব্যাংকের। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত আয়কে বৈধ পথে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে আনার জন্য ২১ দেশের ১৫৫টি ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ হাউজের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের চুক্তি রয়েছে, যার মাধ্যমে ২০০-এর অধিক দেশ থেকে রেমিট্যান্স বেনিফিশিয়ারির হিসাবে অর্থ জমা হয়।
দেশপ্রেমিক কৃষক ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের প্রিয় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংকে তারা আমানত রেখে এতদিন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিল। ভবিষ্যতেও এই ব্যাংকের আমানত নিরাপদে থাকবে এ প্রত্যাশা সব গ্রাহকের। কিছু দিন পরপরই ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে নানা ধরনের নেতিবাচক কথা শুনা যায়। অর্থনীতিকে টেকসই করতে হলে এখাতের স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। উৎপাদন মুখী খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নজর দারিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো কঠোর হওয়া উচিত। ইসলামী ব্যাংকের উন্নতি ও সফলতা দেশের আর্থিক খাতের ঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে। দেশ সমৃদ্ধি লাভ করবে।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক।