দৈনিক ফেনীর সময়

ড. ইউনূস বিতর্কিত না উপেক্ষিত

উপ-সম্পাদকীয়

নাজমুল হক:

২০০৬ সালে ১৩ অক্টোবর নোবেল কমিটি ড. মোহাম্মদ ইউনুস ও গ্রামীণ ব্যাংক কে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে তখন বাংগালীদের মনে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। বাংলাদেশের নাগরিকরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মতো আনন্দ উৎসব পালন করে। ১৯১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম বাঙালি হিসাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। দ্বিতীয় বাংগালী হিসেবে ১৯৯৮ সালে অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এরপর ৩য় বাংগালী হিসেবে ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। নোবেল কমিটি তাকে ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবার ও সমাজে দারিদ্র্য দূরীকরণ ভুমিকা রাখার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করেন। ড. ইউনূস এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের পুরস্কার প্রাপ্তি বাংলাদেশের উন্নয়ন সংস্থাসমুহের উদ্যোক্তা ও লিডারদের প্রেরণা যুগিয়েছে। ২০০৬ সালের ১০ ডিসেম্বর নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে অসলোতে তার সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহিতা ও নারী উদ্যোক্তা তাসলিমা বেগম উপস্থিত ছিলেন। ড. ইউনুস ক্ষুদ্র ঋণ ও দারিদ্র্য দূরীকরণ বিষয়ে বিশ্ববাসীকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রায় ৩.৫ কোটি পরিবার উন্নয়ন সংস্থার ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রোগ্রামের উপকারভোগী এবং সারাদেশে প্রায় লক্ষ লক্ষ নারী ও পুরুষ উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে।

দারিদ্র্য বিমোচনের উপায় হিসেবে ড. ইউনুস বক্তৃতায় বলেন যে, দারিদ্র্যকে একসময় মিউজিয়ামে খুঁজে পাওয়া যাবে। সেভাবেই উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে কাজ করতে হবে। তার বক্তব্যে বিশ্বের উদ্যোক্তা ও উন্নয়ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা স্বপ্ন দেখেছে। উন্নয়ন সংস্থা সমুহের সফলতা অর্জনের চিত্র পত্রপত্রিকায় প্রতিদিন সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতদেশে জোবরা গ্রামের নাম নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির কারণে বিশ্ববাসী চিনতে পেরেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যেতো না, ক্ষুদ্র ঋণ এর ব্যবহার করে আয় রোজকার করে হত দরিদ্র মানুষ তাদের জীবন জীবিকার উন্নয়ন ঘটিয়েছে। শিক্ষা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও উদোক্তা তৈরি, কৃষি উৎপাদন বাড়ানো, গ্রামের বাড়িতে সোলার হোম সিষ্টেম ইত্যাদিতে উন্নয়ন সংস্থা সমুহের ক্ষুদ্র ঋণ বিশেষ ভুমিকা রেখেছে। বানিজ্যিক ব্যাংক সমুহ জামানত বিহিন ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করে না, তাই দরিদ্র ৩ কোটি ৫০ লক্ষ পরিবার বানিজ্যিক ব্যাংক থেকে কোন ধরনের ঋণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারে না। গ্রামের মানুষকে স্বাভলম্ভী করার জন্য উন্নয়ন সংস্থা সমুহ প্রায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সমুহের ঋণ সুবিধা না থাকলে গ্রামের দরিদ্র মানুষের জীবন জীবিকার উন্নয়ন হতো না। দেশে হাহাকার লেগে যেতো।

১৯৮৩ সালে ড. ইউনূস এরশাদ সরকারের শাসনকালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন এবং শত শত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা দারিদ্র্য বিমোচনে ভুমিকা রাখছে। গ্রামীণ ব্যাংকের এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোর বিভিন্ন উন্নয়ন মডেল দেশে-বিদেশে প্রশংসনীয় ভুমিকা রাখছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের উদ্ভাবিত উন্নয়ন মডেল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি মানুষের জীবন জীবিকার উন্নয়ন ঘটিয়েছে। বাংলাদেশকে বিশ্ববাসী চিনতে পেরেছে ড. ইউনুস এর দেশ হিসেবে। ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে রাজনৈতিক দলের লিডার এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও জনপ্রতিনিধিদের পক্ষে বিপক্ষে ভালো মন্দ সমালোচনা থাকলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের, ধনীদের এবং বানিজ্যিক ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ সেক্টরে খুব বেশি অবদান নেই। বানিজ্যিক ব্যাংক এবং রাজনৈতিক দলের উদ্যোক্তাদের ক্ষুদ্রঋণ সেক্টরে পুঁজি নিয়ে ভূমিকা রাখা উচিৎ।

বাংলাদেশে ১/১১-এর ঘটনার পর সুশীল সমাজের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। এই পরিবর্তনের জন্য কেউ কেউ ড. ইউনুসকে দায়ী করেন। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাগরিক শক্তি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করা নিয়ে রাজনৈতিক অংগনে সমালোচনা এবং নেগেটিভ ধারণা তৈরি হয়েছে। কেউবা ১/১১-এর নেপথ্যের কুশীল হিসেবে তাকে দায়ী করেন। ড. ইউনুস জাতীয় সংকটে মানুষের পাশে দাঁড়াননি, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সময় দেশে যে রাজনৈতিক সংকট চলছিল তা নিরসনেও তিনি কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেননি। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মায়ানমারে ফেরতের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে ও বাংলাদেশে উদ্যোগ গ্রহণ করেন নাই ইত্যাদি সমালোচনা রয়েছে। নোবেল পুরস্কারকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে যে উদ্যোগ গড়ে উঠেছে তার সাথে মানবাধিকার ও সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য ড. মোহাম্মদ ইউনুসকে এগিয়ে আসা উচিৎ।

ড. ইউনুস গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে অতিরিক্ত ১০ বছর ছিলেন। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদটি নিয়েই তার আদালতে যাওয়া এবং উচ্চতর আদালতে হেরে যাওয়া এবং সাংবাদিকদের একটি অংশ তার নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তির মর্যাদাকে কিছুটা হলেও ক্ষুন্ন করেছে। তবে এর জন্য রাজনৈতিক দলের এবং সুশীল সমাজের ভূমিকা অনেকাংশে দায়ী। ড. ইউনুস শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছে বিধায় তার সাথে ভালো আচরণ করা হলে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ সরকার প্রশংসিত হতো। শান্তির নোবেল পুরস্কারটির মর্যাদাও ক্ষুন্ন করেছে। কিন্তু শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস শান্তির জন্য কী করলেন বাংলাদেশের নাগরিকদের মাঝে প্রশ্ন রয়েছে। সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বের ৪০ জন বিশেষ ব্যক্তির একটি খোলা চিঠি বিজ্ঞাপন আকারে। এই বিজ্ঞাপনের অর্থমূল্য কত ডলারের এবং কাহারা খরচ করেছে তাহা নিয়ে টকশোতে তার দেশপ্রেম এবং মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কি কি অবদান ইত্যাদি সমালোচনা হয়েছে। একজন নোবেল বিজয়ীকে বাঙ্গালী জাতি উঁচু স্থান দিতে পারে নাই।

ড. ইউনূসকে ১/১১ কুশীলব, পদ্মাসেতু নির্মাণ বিরোধিতাকারী, জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের পক্ষ বিপক্ষে ভুমিকা রাখা ইত্যাদি বিষয়ে নেগেটিভ ধারণা তৈরি ও প্রচারণা চালিয়ে তার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটি অংশের ধারণা ড. ইউনূস দেশে রাজনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে দেশে নতুন করে কোনো সংকট সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন। জাতী হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লিডাররা ড. ইউনূসকে উচ্চ আসন না দিয়ে তাকে খাটো করে চলেছেন। বাঙ্গালী জাতি হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে তাকে হাসির পাত্র বানিয়ে ফেলেছেন। ড. ইউনূসকে জাতির সন্মান জানানো উচিৎ ছিল এবং তার উন্নয়নে অবদান সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরা উচিত। ড. ইউনুসের উচিত আন্তর্জাতিক কুটনীতিতে রোহিঙ্গাদের মানবিক মর্যাদা মূল্যবোধ রক্ষা করে মায়ানমারে ফেরত এবং মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখা।

লেখক : গবেষক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!