দৈনিক ফেনীর সময়

দাদায় কইছে বাইনতো ধান, বাইনতে আছে ওদা ধান

দাদায় কইছে বাইনতো ধান,  বাইনতে আছে ওদা ধান

-মোহাম্মদ সফিউল হক

১. গত ১১ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে ফেনী রেললাইন ধরে হাঁটছিলাম।হাঁটতে হাঁটতে ভাঙারির দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ওখানে একটি বইয়ে চোখ আটকে গেলো। বইটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের প্রাক্তন অধ্যাপক, বিজ্ঞান লেখক ও বিজ্ঞান সংগঠক ডঃ মুহাম্মদ ইব্রাহীম’র লেখা ‘শিকড় ( জিন, জীবন- ধারা ও ভাষার প্রবাহঃ আফ্রিকা থেকে চট্টগ্রাম)। বইটির মুদ্রিত মূল্য ৫০০ টাকা এবং বিক্রয় মূল্য ৪০০ টাকা। তবে আমি বইটি ক্রয় করলাম মাত্র ৭০ টাকায়। এতে আমি ও দোকানী রিহ রিহ পড়হফরঃরড়হএ ছিলাম।দোকানী ৫/৭ টাকার জিনিস ৭০ টাকায় বিক্রি করলো আর আমি ৪০০ টাকার জিনিস ৭০ টাকায় কিনলাম। খুশি মনে বইটি বাসায় নিয়ে এসে খুলতেই দেখলাম ফেনীর একটি নামকরা স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা- ২০২২ এ ৬ষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্রীকে প্রথম পুরস্কার হিসেবে এই বই দেয়া হয়েছে।

২. মানুষের জীবনকালটি ছোট, কিন্তু মানব জাতির ধারাবাহিকতাটি অনেক বড়। আমরা এই ধারাবাহিকতার মধ্যে আমাদের শিকড়কে সন্ধান করি। শিকড় নামের এই বইয়ে সেই শিকড় চলে গেছে অনেক গভীরে, আমাদের একেবারে আদি পূর্বপুরুষদের জগতে। সেখান থেকে শুরু করে এ শিকড় নানা কাল ধরে, নানা দেশ ঘুরে, আমাদেরকে রস যুগিয়েছে– জিন, জীবনধারা আর ভাষার প্রবাহে। জিন প্রবাহিত হয়েছে বাবা-মা থেকে সন্তানে; জীবনধারা এক ভাবে শিক্ষক থেকে ছাত্রে; আর ভাষা মানুষে মানুষে কথোপকথনে। এই সবক’টি প্রবাহের গতিপথের ছবি পাওয়া যাবে এই বইতে। শিকড়ের গল্পটি এমন যে সে বহু কাল বহু দেশ হয়ে এসে আজকের আমাদের যে কারো অনুভূতিতে হিল্লোল তুলতে পারবে।

বইটি সম্পর্কে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস লিখেছেন: “মোটেই বুঝতে পারিনি যে বইটি আমাকে একেবারে মাতিয়ে তুলবে। বইটি কিছুতেই হাত থেকে ছাড়তে পারছিলামনা। ছোটবেলায় রহস্য উপন্যাসে যে রকম মজে যেতাম শিকড় পড়তে গিয়ে আবার সেই আমেজ ফিরে পেলাম। আগ্রহের এমন উত্তেজনা নিয়ে কোন বই পড়েছি এমন ঘটনা গত বহু বছরের মধ্যে ঘটেছে বলে মনে আসছেনা ; শিকড় পড়ার সময় কোনো সময় মনে হয়নি আমি কোন গবেষণামূলক বই পড়ছি। সব সময় মনে হচ্ছিলো আমি দীর্ঘপথ ধরে আমার পারিবারিক পরিক্রমার কাহিনী পড়ছি .. মানুষের অভিবাসন নিয়ে লেখা বই পড়তে গিয়ে কারো চোখে পানি এসে যাবে এরকম কোনদিন কল্পনা করিনি।… বইটি একটি গবেষণা গ্রন্থ, এতে এমন কিছু নেই যাকে বৈজ্ঞানিক ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়নি, তথ্যের দিক থেকে এ এক ঠাস-বুনোট বই। অথচ লেখক একে পরিবেশন করেছেন ভ্রমণকাহিনীর সাবলীলতা দিয়ে যা তরতর করে পাঠককে এগিয়ে নিয়ে যায়। … ড. ইব্রাহীমকে ধন্যবাদ এই বই লেখার জন্য, আমার মত অনেককে নতুন দৃষ্টি ভঙ্গি দেয়ার জন্য।’ বইটি একটি সুখ পাঠ্য। ৩১৯ পৃষ্ঠার এই বইতে যেসব স্রোতধারার ফলে এখানে আমরা, পথে পথে রেখে যাওয়া চিহ্ন, কেন আফ্রিকা কেন চট্টগ্রাম, জ্ঞানীর জীবন ও যাত্রা, চিরন্তন পেশার পরিবর্তন, এই গন্তব্যে মানুষ, বড় অভিবাসনে বড় মিশ্রণ, ধর্ম নির্ধারিত সমাজ, সমাজ নির্ধারিত ধর্ম, মুখের ভাষার ভাষা-পরিবার, পান্ডুলিপি করে আয়োজন, কাছের জীবন ও দূরের বাণিজ্য, সংঘাতে সন্ধিতে চট্টগ্রাম, পালতোলা চিরায়ত প্রবাহে আমাদের খালাসিরা ও যারগুই খর্নফুলি এই ১৪টি বিষয় নিয়ে লিখিত।

৩. প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং কলেজের ‘বার্ষিক সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া’ অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পুরস্কার হিসেবে মেলামাইন অথবা কাচের থালা, বাটি বা গ্লাস দেওয়া হয়। পুরস্কার হিসেবে থালা-বাটি একটা জঘন্য মনোনয়ন। কেননা এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এক ধরনের ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। থালা-বাটি নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার শিক্ষার্থীদের বই দিতেই পারে এবং উপহার বা পুরস্কার হিসেবে বই একটা সেরা মনোনয়ন।একটা শিক্ষার্থী কেবল তার পাঠ্য বই পড়বে, এটা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নীতি হতে পারে না। বরং একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চাইবে, তার এখানে যারা শিক্ষা গ্রহণ করতে এসেছে, তারা বর্তমান সময়ের প্রাসঙ্গিক সব কিছু সম্পর্কে জানুক। তারা হয়ে উঠুক একজন জ্ঞানী মানুষ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল দায়িত্ব হল শিক্ষার্থীদের জ্ঞান পিপাসু হিসেবে গড়ে তোলা।

এই থালাবাটি পুরস্কার দেয়া নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে রয়েছে বিস্তর সমালোচনা। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের প্রতি সহশিক্ষা কার্যক্রমের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে পুরস্কার হিসেবে ক্রোকারিজ সামগ্রী না দিয়ে বই অথবা শিক্ষা সহায়ক উপকরণ দিতে নির্দেশনা দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল বুধবার অধিদপ্তরটি এ আদেশ জারি করে। প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষদের কাছে পাঠানো আদেশে বলা হয়, বিদ্যালয়গুলোর সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রতিযোগীদের মধ্যে পুরস্কার হিসেবে ক্রোকারিজ সামগ্রী দেওয়া হয়। এ ধরনের পুরস্কার শিক্ষার্থীদের শিখন-শেখানো কার্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। গুণগত শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে সব অনুষ্ঠানে প্রতিযোগী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরস্কার হিসেবে বয়স উপযোগী মানসম্মত বই অথবা শিক্ষা সহায়ক উপকরণ দিতে হবে। অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক মো: আবদুল মান্নানের সই করা আদেশটি ‘অতি জরুরি ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

৪. ফেনী শহরের নামকরা ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ তারা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে বই দেয়ার জন্য কারণ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনো মাউশি’র এই নির্দেশনা মানছে না। তবে তারা শ্রেনী উপযোগী বই পুরস্কার হিসেবে দিতে পারেনি। যে বই পুরস্কার হিসেবে দেয়া হয়েছে তা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী নয়।তাই এই বই শিক্ষার্থীকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। ফলে ২০২২ সালের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় দেয়া বই (২০২২ সালের ডিসেম্বরে দেয়া বই হয়তো) সম্পূর্ণ নতুন অবস্থায় এপ্রিলের মধ্যে(এর আগেও হতে পারে) চলে যায় ভাঙারির দোকানে। এই পুরো বিষয়টি আমাকে মনে করিয়ে দিলো নোয়াখালীর বহুল প্রচলিত প্রবাদ- ‘দাদায় কইছে বাইনতে ধান, বাইনতে আছে ওদা ধান।’ অর্থ্যাৎ অগ্র পশ্চাৎ কোন কিছু না বুঝে বা না চিন্তা করে কোন কাজ করতে হবে তাই দায়সারাভাবে করা। শুধু নির্দেশনা মানা হয়, বই নির্বাচনে শ্রেনী বিবেচনায় আনতে হবে না হলে শুধু নির্দেশনাই মানা হবে। কাজের কাজ কিছু হবে না। এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ভূমিকা আশা করি।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!