মানুষ প্রথমত ছিল অস্তিত্বহীন। তারপর পৃথিবীতে অস্তিত্বশীল করে পাঠানো হয়েছে। অত:পর মৃত্যুর মাধ্যমে অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে। তারপর পুনরায় পূনরুত্থিত হবে হাশরে, এ হিসেবে তার জীবন লাভ দু’বার এবং মৃত্যু বরণও দ’ুবার। মানবের জীবন-মরণের এ লিলা- খেলা একমাত্র তাকে পরীক্ষা করার জন্য। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- পূণ্যময় তিনি, যাঁর হাতে রাজত্ব। তিনি সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান। যিনি মরণ ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন – তোমাদের মধ্যে কে কর্মে শ্রেষ্ঠ। তিনি পরাক্রমশালী, মেহেরবান (সূরা আল মুলক;- ১,২)। অন্যত্র ইরশাদ করেন। আর তোমরা ছিলে নিস্প্রাণ, অতঃপর তোমাদেরকে আল্লাহ প্রাণদান করেছেন। তারপর মৃত্যু দান করবেন, পুনরায় তোমাদেরকে জীবনদান করে হাশরে উঠাবেন (সূরা আল বাকারা – ২৮)।
পার্থিব জীবন ক্ষণিকের : মানুষের পরকালীন জীবনের তুলনায় পার্থিব জীবন অত্যন্তনগন্য।হাদীসের বর্ণনানুযায়ী আখেরাতের একদিন দুনিয়ার এক হাজার বছরের সমান, আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন – তোমরা কি আখেরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে পরিতুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ আখেরাতের তুলনায় পার্থিব জীবনের উপকরণ অতি অল্প। (সূরা আত-তাওবা -৩৮)।
আল্লাহর অপর বাণী- আল্লাহ যার জন্যে ইচ্ছারুযী প্রশস্ত করেন এবং সংকুচিত করেন। তারা পার্থিব জীবন পেয়েঅ্রতি মুগ্ধ ও উৎফুল্ল। অথচ পার্থিব জীবন পরকালের তুলনায় অতি নগন্য (সূরা রাদ -২৬)। অন্যত্র ইরশাদ করেন- পার্থিব জীবনের উদাহরণ তেমনি, যেমন আমি আসমান থেকে পানি বর্ষণ করলাম, পরে তা মিলিত সংমিশ্রিত হয়ে তা থেকে যমীনের শ্যামল উদ্ভিদ বেরিয়ে এল, যা মানুষ ও জীবজন্তুরা খেয়ে থাকে। এমনকি যমীন যখন সৌন্দর্য-সুষমায় ভরে উঠল তখন যমীনের অধিকর্তারা ভাবতে লাগল, এগুলো আমাদের হাতে আসবে, হঠাৎ করে তার উপর আমার নির্দেশ এল রাত্রে বা দিনে, তখন সেগুলোকে কেটে (এমন) স্থপাকার করেদিল, যেন কালও এখানে কোন আবাদ ছিল না (সূরা ইউনুস- ২৪)।
দুনিয়া ধোঁকার বস্তু : এ পার্থিব জগত যদিও অনেক লাভের ও উপভোগের বস্তু বলে মনে হয়, কিন্তু তা মূলত প্রতারণা ও ধোঁকার বস্তু। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন -আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয়। (সুরা আল ইমরান -১৮৫)
দুনিয়া ক্রীড়া কৌতুক, সাজ সজ্জা ও গর্বের বস্তু : পার্থিব জীবন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা কিছু মানুষ ভোগ করে এবং যাতে মানুষ মগ্ন ও আনন্দিত থাকে এগুলো ক্রীড়া- কৌতুক, সাজ-সজ্জা, অহমিকা, ও গর্বের বিষয় মাত্র। আল্লাহ তায়ালার বাণী- জেন রাখ, পার্থিব জীবন ক্রীড়া- কৌতুক, সাজ-সজ্জা- পারষ্পরিক অহমিকা এবং ধন ও জনের প্রাচুর্য ব্যতীত আর কিছুই নয়, যেমন এক বৃষ্টির অবস্থা, যার সবুজ ফসল কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, এরপর তা শুকিয়ে যায়। ফলে তুমি একে পীতবর্ণ দেখতে পাও, এরপর তা খড়কুটা হয়ে যায়। আর পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপরণ বৈ কিছু নয় (সূরা আল হাদীদ -২০)।
আরো ইরশাদ করেন- পার্থিব জীবন ক্রীড়া কৌতুক ব্যতীত অন্য কিছু নয় (সূরা আনয়াম – ৩২) আল্লাহর অপর বাণী- অবশ্যই পার্থিব জীবন কেবল খেলাধূলা ও আনন্দ-প্রমোদের জায়গা (সূরা মুহাম্মদ -৩৬) অন্যত্র ইরশাদ করেন- এই পার্থিব জীবনক্রীড়া- কৌতুক বৈ তো কিছুই নয় (সূরা আনকাবুত – ৬৪)। ক্রীড়া কৌতুকের যেমন কোন স্থিতি নেই এবং এর দ্বারা কোন বড় সমস্যার সমাধান হয় না, অল্পক্ষন পরেই সব তামাশার পরিসমাপ্তি ঘটে, পার্থিবজীবনের অবস্থাও অনুরূপ।
দুনিয়া অভিশপ্ত : এ দুনিয়ায় যদি স্রষ্টার যিকির ও তাঁর আদেশ নিষেধ পালন করা না হয়, তবে তার জীবন মূল্যহীন ও অভিশপ্ত। মহানবী (স:) বলেছেন : দুনিয়া অভিশপ্ত এবং দুনিয়ার সব কিছু অভিশপ্ত, যদি তাতে আল্লাহর যিকির না থাকে অথবা আল্লাহর যিকিরের দিকে ধাবিত হয় এমন কর্ম না থাকে। জ্ঞানী ও শিক্ষার্থী উভয়ই পূণ্যে অংশিদার। অবশিষ্ট মানুষ নির্বোধ, তাদের মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। (তিরমিযী হাদীস নং- ২৩২২, ইবন মাজাহ হাদীস নং – ৪১১২)
দুনিয়া মূল্যহীন বস্তু : মহানবী (স:) বলেছেন – যদি এ দুনিয়া আল্লাহ তা’য়ালার নিকট মাছির ডানার সমান মূল্য হতো, তবে আল্লাহ কোন কাফিরকে দুনিয়ার এক ঢোক পানি পান করতে দিতেন না (তিরমিযী- হাদীস নং- ২৩২০)।
দুনিয়া কর্মের ক্ষেত্র : দুনিয়া আখেরাতের কর্মক্ষেত্র। মহানবী (স) ইরশাদ করেন- দুনিয়া সুমিষ্ট ও সবুজ শ্যামল।আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে তাঁর প্রতিনিধি করেছেন। অতঃপর তিনি দেখছেন তোমরা কি কর্ম করছো। সুতরাং দুনিয়া ও নারীদের ব্যাপারে সতর্ক থাক (মুসলিম)।
উভয় জগতের কল্যাণ কাম্য : আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে দুনিয়া ত্যাগ করতে বলেননি; বরং দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের মধ্যে সমতা বিধান করে উভয় জগতের কল্যাণ কামনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন তিনি ইরশাদ করেছেন -আর তাদের মধ্যে যারা বলে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান করুন, আখেরাতেও কল্যাণ দান করুণ এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন, তাদের জন্য অংশ রয়েছে নিজেদের উপার্জিত সম্পদে। আর আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী (সূরা বাকারা- ২০১, ২০২)।
আরো ইরশাদ করেন (মু’মিনেরা বলে) পৃথিবীতে এবং আখিরাতে আমাদের জন্য কল্যাণ লিখে রাখুন। আমরা আপনার দিকে প্রত্যাবর্তন করছি। (আরাফ -১৫৬)। আরো ইরশাদ করেন : যারা ঈমান এনেছে এবং ভয় করছে, তাদের জন্য সুসংবাদ, পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে (সূরা ইউনুস -৬৩, ৬৪)।
এক সাহাবী মহানবী (স) কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার একটি মাত্র সন্তান, অথচ আমি অনেক সম্পদের মালিক। আমি কি আল্লাহর রাস্তায় দু’তৃতীয়াংশ দান করে দেব, রাসুলুল্লাহ (স) বললেন- না, সাহাবী আবার প্রশ্ন করলেন তবে অর্ধেক? রাসূল (স) বললেন-না। সাহাবী আবার প্রশ্ন করলেন -এক তৃতীয়াংশ?রাসুলুল্লাহ (স) বললেন- হ্যাঁ। তবে তাও অনেক। তোমার সন্তানকে রিক্ত হস্ত অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে স্বাবলম্বী অবস্থায় রেখে যাওয়া উত্তম (বুখারী, হাদিস নং- ৬২৭৭)।
দুনিয়ার সম্পদ শান্তির প্রতীক নয় : মানুষের জীবন নির্বাহের জন্য সম্পদের প্রয়োজনের রয়েছে, তবে আখিরাত বাদ দিয়ে শুধু পার্থিব সম্পদ অর্জনে মগ্ন থাকা নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে গাফেল রাখে, এমন কি তোমরা কবরস্থানে পৌঁছে যাও। (সূরা তাকাসুর -১৩২)।
আরো ইরশাদ করেন- প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর দুর্ভোগ, যে অর্থ সঞ্চিত করে ও গণনা করে সে মনে করে যে, তার অর্থ চিরকাল তার সাথে থাকবে (সূরা হুমাযা -১, ২, ৩)। আল্লাহর বাণী- ধনৈশ^র্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য (সূরা কাহাফ -৪৬)।
অন্যত্র ইরশাদ করেন -তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে ধন- সম্পদ, সন্তান সন্ততিওসম্পত্তি দিয়ে যাচ্ছি, এতে তাদেরকে দ্রুত মঙ্গলের দিকে নিয়ে যাচ্ছি? বরং তারা বুঝে না (সূরা আল মুমিনুন- ৫৫,৫৬)।
আরো ইরশাদ করেন- সেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন উপকারে আসবে না; কিন্তু যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে (তারই উপকারে আসবে) (সূরা আশ-শোয়ারা – ৮৮,৮৯)
আরো ইরশাদ করেন- আর তোমরা ধন-সম্পদকে প্রাণভরে ভালবাস (অথচ তা অনুচিত) (সূরা কলম-২০)। আল্লাহর অপর বাণী- আর তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান- সন্ততি যেন আপনাকে বিস্মিত না করে (সূরাতাওবা- ৫৫,৮৫)। কারণ তা বিস্মিত হওয়ার বিষয় নয়। আরো ইরশাদ করেন- আল্লাহর কবল থেকে তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান- সন্ততি তাদেরকে মোটেও বাঁচাতে পারবে না (সূরা মুজাদালা – ১৭)।
ব্যক্তির আসল মাল : হযরত মুতাররাফ (র) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তাঁর পিতা বলেন- আমি একদা মহানবী (স) এর নিকট আসলাম। তিনি তখন সূরা তাকাসুর পাঠ করছেন আর বলছেন, আদম সন্তান বলে আমার মাল আমার মাল। হে আদম সন্তান ! তোমার মালতো উহাই যা তুমি খেয়ে পরে নিঃশেষ করেছ, অথবা দান করেছ। অবশিষ্ট যা রেখে যাচ্ছ তা অন্য মানুষের জন্য (মুসলিম -২৭৯৫৮, তিরমিযী -২৩৪২)।
সম্পদের লোভ অফুরন্ত : হযরত আনাস ইবন মালেক (রা) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন- যদি কোন আদম সন্তানের একটি স্বর্ণের উপত্যকা থাকে, তবে সে দ’ুটির জন্য আকাংখা করবে। তার মুখ মাটি ছাড়া পূর্ণ হবে না। তবে যে তাওবা করে, আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন (কুরতুবী ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা নং ১২৮)।
হাদীস শরীফে আরো রয়েছে, আল্লাহ তা’য়ালা হযরত মুসা (আ) এর নিকট এ বলে প্রত্যাদেশ করেন যে, যখন তুমি দারিদ্রতাকে তোমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখ, তখন তুমি নেককারদের প্রতীক বলে একে ধন্যবাদ দাও। আর যখন ধনাট্যতা তোমার দিকে এগিয়ে আসে, তখন একে পাপের অগ্রিম শাস্তি বলে মনে কর (কুরতুবী ২০ খন্ড পৃষ্ঠা নং -৩১৩)।
ধনের প্রাচুর্য ভেলকি : মহানবী (স) ইরশাদ করেন- যখন তোমরা দেখতে পাও যে, পাপীদের তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রদান করা হচ্ছে, তখন মনে করবে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য ভেলকি (কুরতুবী)। মৃত্যু তার রঙ্গীন স্বপ্ন ভঙ্গ করে দেবে। ঈমানের নূর দুনিয়া বিমুখতায় ঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) যখন “আল্লাহর বাণী- “আল্লাহ যাকে হেদায়াত করতে চান, দ্বীনের জন্য তার অন্তরকে উম্মুক্ত করে দেন।” এ আয়াত শুনেনতখন তিনি প্রশ্ন করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তা’য়ালা কি অন্তরকে উন্মুক্ত করেন? রাসূল (স) বলেন, হ্যাঁ, (অন্তর উম্মুক্তের অর্থ) অন্তরে (ঈমানের) আলো প্রবেশ করান। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) পূণরায় প্রশ্ন করেন অন্তরে যে ঈমানের আলো প্রবেশ করেছে তার নিদর্শন কি?
রাসুল (সাঃ) বলেন- দুনিয়া থেকে বিমুখ হওয়া, স্থায়ী ঘর তথা জান্নাতের দিকে ধাবিত হওয়া এবং মৃত্যু আসার পূর্বে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। দুনিয়া মুমিনের জন্য জেলখানা: মানুষ জেলা খানা থেকে দ্রুত মুক্তি লাভ করতে চায়।
শান্তিতে থাকলেও কেউ জেল খানায় থাকতে চায় না। মহানবী (স) বলেছেন, দুনিয়া মুমিনের জন্য জেলখানা, কাফিরের জন্য জান্নাত (মুসলিম, হাদিস নং-২৩৫৬)। রাসুলুল্লাহ (স) আরো বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা চান মুমিনের আত্মা দ্রুত তাঁর কাছে চলে আসুক, কিন্তু মুমিন (না বুঝে) মৃত্যুকে অপছন্দ করে (বুখারী, হাদিস নং-৬৫০২)।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ।