অধ্যাপক রফিক রহমান ভূঁইয়া
এক.
মনে হয় এইতো সেদিন। তবু দেখতে দেখতে তেরো বছর পেরিয়ে চৌদ্দতে পা রাখলো ফেনীর সময়। চৌদ্দ মানে দূরন্ত কৈশোর। ফেনী জেলার সেদিনকার এডিএম জনাব মোমিনুর রশিদ আমিনের অফিসরুমে তাঁর সামনেই বসেছিলেন একজন সৌম্য শান্ত বয়োবৃদ্ধ মানুষ। তিনি ‘দৈনিক ফেনীর সময়’ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেনের বাবা। তাঁর নাম জনাব আহম্মদ উল্যাহ। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ফেনীর একজন কবি। আমার জনৈক প্রাক্তন ছাত্র এবং অন্যতম কবিতা-শিষ্য, মনজুর তাজিম। আর শাহাদাত এবং শাহাদাতের খালাতো ভাই আলী হায়দার মানিক।
ওরা দুই ভাই এডিএম সাহেবের ডান পাশেই দাঁড়িয়েছিলো।
শাহাদাত হোসেন আমাকে আগেই ফোন করে রেখেছিলো, স্যার, আগামী ২৩ মার্চ তারিখ ১০ টায় আপনাকে দয়া করে একটু এডিএম স্যারের অফিসে যেতে হবে। আমি তার ফোন পেয়েই সেদিন সেখানে উপস্থিত হয়েছিলাম।
জনপ্রশাসনের তুখোড় কর্মকর্তা জনাব মোমিনুর রশিদ আমিন আগে থেকেই আমার খুব ভালো পরিচিত ছিলেন। তিনি আমাকে হেসে সামনের চেয়ারে বসতে বললেন।
শাহাদাতের বাবাকে সম্ভবতঃ আমি সেদিন
ই প্রথম দেখেছিলাম। ছিপচিপে নাতিদীর্ঘ গড়ন। থুত্নিতে এক গোঁছা সাদা দাড়ি। মুখে মনে হয় তাঁর কয়েকটা দাঁতই ছিলো না তখন। তবু মুখমন্ডল সরল, অপূর্ব ¯িœগ্ধ। নির্মল অমিয় হাসিতে একান্তই উজ্জ্বল। শাহাদাত নিজেই আমার সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলো, স্যার, আমার বাবা। আমি নতুন পত্রিকার ডিক্লারেশন নি”িছ জেনে বাবা এসেছেন।
শাহাদাত তখনো একটি পত্রিকার সম্পাদক, ‘সাপ্তাহিক আলোকিত ফেনী’। পত্রিকাটি ভালো চলছে বলেই সে একটি দৈনিক পত্রিকার ডিক্লারেশন নিতে উৎসাহিত হয়েছে। জেনে আমিও খুব খুশি হলাম।
আমার খুশি হওয়ার কারণ, ফেনীর পত্র-পত্রিকার সাথে আমার যোগাযোগ একান্তই হৃদয়ের। ফেনীর পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে আমি প্রাক্তনদের মধ্যেই অতিশয় নগন্য একজন। আমার পত্রিকার নাম ছিলো ‘সাপ্তাহিক ফেনী’।
আমার কালের পত্রিকা মালিক ও সম্পাদকদের মধ্যে একমাত্র এরশাদ মজুমদার ছাড়া সম্ভবতঃ আর কেউই আজ বেঁচে নেই্। জনাব মজুমদার আমার যৎকিঞ্চিৎ সিনিয়র। তিনি এখন ঢাকাতেই স্থায়ীভাবে নিবাস করেন। পরিচয় একজন কবি এবং কলামিস্ট। তাঁর ইমিডিয়েট ছোটভাই এছাক মজুমদার আমার সহপাঠী। অন্য ভাই ছালু, নূরু এরা আমার ছাত্র।
সেকালে যাঁরা সাংবাদিকতা করতেন, সংবাদপত্রকর্মী ছিলেন, তাঁরাও সকলেই গতস্য। এক এক করে সকলেই খসে পড়েছেন এক একজন উজ্জ্বল প্রজ্জ্বলিত দেউটির মতো। এখন পূর্ব প্রজন্মের মধ্যে বেঁচে মজুমদার ছাড়া সম্ভবতঃ শুধু আমিই একা। আমার পত্রিকাটিও মরেছে সে কবে। বঙ্গবন্ধুর বাকশাল আইন করে অন্যদের সাথে ওটিকেও মেরে ফেলেছে উনিশ শ’ চুয়াত্তর খ্রিস্টাব্দে। আর সরকারি কর্মকর্তা হয়ে সংবাদপত্র জগত থেকে জীবিত থেকেও কালক্রমে খসে পড়েছি আমি নিজে। তাও সে কবেকার কথা! তবু ফেনীর সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা এসব আমার এখনো হৃদয় জুড়ে বসে আছে। তাই বলছিলাম, শাহাদাত হোসেন নতুন পত্রিকার ডিক্লারেশন দিচ্ছে জেনে সেদিন আমিও প্রভ’তভারে খুশি হয়েছিলাম।
ফেলে আসা দিনগুলোর কথা আমার খুব মনে পড়ে।
বছরটা ছিলো ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ।
আমি জননেতা মরহুম খাজা আহম্মদের কল্যাণে ফেনী সংবাদপত্রের সাথে সে বছর থেকেই জড়িয়ে পড়ি। এবং সে বছরই ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর ‘কচি-কাঁচা’র আসরে আমার একটি ছড়া কবিতা ছাপা হয়। কবিতাটির নাম ছিলো ‘শরৎ তুমি এলে’। তার প্রথম ক’টি লইন আমার এখনো মনে আছে :
শরৎ তুমি এলে
সাদা মেঘে নাও ভাসিয়ে
পরির ডানা মেলে।
শরৎ তুমি এলে
কাশের বনে দাদুর দাড়ির
সাদা ছায়া ফেলে।-
তারপর থেকে সত্তুরের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমি সাহিত্য ও ফেনীর পত্র-পত্রিকার জগতের অলিতে গলিতে পাগলের মতোই ঘুরঘুর করেছি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে ‘সাপ্তাহিক ফেনী’, ‘আধুনিক ছাপাঘর’ আর ‘ফেনী কলেজ’ এ তিনটাই ছিলো আমার নিরন্তর ঠিকানা। এ সময়ে আমি বাংলাদেশ বেতারের গীতিকার হয়ে ‘সংগীত শিক্ষার্থী সম্মিলন’ নামে একটি নাচ, গান শেখার প্রতিষ্ঠানও দিয়েছিলাম। ‘তিথি’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকাও সম্পাদনা করতাম। তাই ফেনীর তখনকার উঠতি বয়সী সংগীত শিক্ষার্থী, সাহিত্য, শিল্প ও সংবাদপত্র জগতের তরুণ অধিবাসীরা আমাকে প্রায় ঘিরেই রাখতো। সে-ই ছিলো আমার এক অনন্য-মধুর অপূর্ব আনন্দ অবগাহনের দিন! আমি আজ পরম তৃপ্তির সাথে বলতে পারি যে, আমার বড়োরা সেদিন আমাকে ¯েœহ করেছেন, সমবয়সীরা বন্ধু ভেবেছেন। আর ছোটরা দিয়েছেন সম্মান। আজকের প্রজন্ম আমাকে কতটা জানে জানি না। এদের সাথে আমার জেনারেশন গ্যাপতো কম নয়! প্রায় অর্ধ শতাব্দীর কাছাকাছি সময়।
দুই.
তখনকার দিনের কথা বলছি।
বলতে গেলে আজকের চাইতে অনেক বেশি জননির্জন ছিলো তখনকার দিনের ফেনী। সংবাদপত্রই বা তখন কয়টা ছিলো! আর সাংবাদিক মাত্র হাতে গুণার মতোই ছিলেন কয়েকজন। তাঁদের আশেপাশে বেকার ঘুরঘুর করার মতো উৎসাহীর সংখ্যা আরো কম ছিলো। এক সময় নাকি খাজা আহম্মদেও সাথে ছিলেন পরবর্তী কালের কিংবদন্তি সাংবাদিক প্রয়াত এবিএম মূসা সাহেব। আরো কয়েকজনের নাম আমার মনে আছে। লুৎফুর রহমান ভানু মৃত। এডভোকেট রফিকুজ্জমান ভ’ঁইয়া এমপি মৃত। আনসারুল হক, সাঈদ শামসুর রফি মরে, না বেঁচে জানি না। এ কে সামসুল হক মৃত। আমি নিজেও প্রায় পৌনে এক শতাব্দীর প্রান্ত স্পর্শ করেছি।
সে দিনগুলোতা এখন আর নেই। যেমন কারো কপি হাউজের আড্ডাটাও নেই। নেই খাজা আহম্মদের ‘তৃপ্তি রেস্টুরেন্ট’। রাতদিন সেটি এক সময়ে খোলা থাকতো। কলেজ রোডে যোগেন্দ্রর দোকানের চানামিষ্টি, ট্রাঙ্ক রোডে মাখন বাবুর দোকানে কাঁচাগোল্লার স্বাদ নিয়েছেন, এমন মানুষও কারা কারা বেঁচে আছেন, তাদের কারো নাম মনে করতে পারছি না। ওখানে মওলানা ভাসানীর ভক্তরাই বেশি বসতেন। ও হ্যাঁ একজনের নাম মনে পড়ছে, ছোটভাই মোয়াজ্জেম। মোয়াজ্জেম হোসেন, বেঁচে আছে। সে এখন ‘দৈনিক ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস্’-এর সম্পাদক।
দিন গিয়েছে। দিন যায়। দিন কারোই থাকে না। সেদিনকার মানুষগুলোও গেছেন। তবু সেদিনের কথারা আজো আমার মনে সব স্মৃতি হয়ে বসে আছে। স্মৃতিরা স্বúœ, স্মৃতিরা সত্যি, ওরা রূপময় জীবনে উজ্জ্বল মুখরিত কালের ইতিহাস। দিনতো যায়, দিন চলে যায়। কিন্তু কথা থাকে। তবে মানুষ থাকে না। মানুষ মরে যায়। কিন্তু স্মৃতিরা কখনো মরে না। ওরা মন থেকে মনে সঞ্চারিত হয়ে স্বপ্ন হয়ে আজীবন বেঁচে থাকে।
আজকের প্রজন্ম সে স্বপ্নকে কতটা ধারণ করে কিংবা ফেনী সাংবাদিকতার অতীত ইতিহাসের প্রতি তারা কতটা শ্রদ্ধশীল আমি তা জানি না। তবে তারা প্রেস ক্লাবের অধিকার নিয়ে মারামারি করছে কেন ? সংবাদ, সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকের নৈতিকতা নিয়ে তারা কে কি ভাবে, তাও বা কে জানে!
ফেনীর এ কালের সাংবাদিকেরাতো সবাই আমার অতি আদরের। অতিশয় প্রৈমেয় উত্তরসূরী। তাদের উজ্জ্বল অত’লনীয় কর্মযোগ আমার পরম কাঙ্খিত আনন্দলোক। এটা আমি তাদের বুঝাবো কেমন করে! তাদের কারো প্রতি কেউ যদি পেছনেও আঙ্গুল তুলে কথা বলে তখন আমার বুকের রক্ত ঝরে।
আমি শ্রদ্ধার সংগে আজো স্মরণ করি সেদিনের বরেণ্য সে সম্পাদক ও সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও ছাপাখানাকর্মীদের নাম। যাঁদের মধ্যে সর্বপ্রয়াত খাজা আহম্মদ, এম এ গফুর, মাহবুবুল হক, মাওলানা ওবায়দুল হক, এডভোকেট নুরুল ইসলাম, মাহবুবুল হক পেয়ারা, মির্জা আবদুল হাই, এ, অদুদ, সামসুল হক, রসিকলাল দাস, শ্রীদামচন্দ্র দাস, এম এম রমজান আলি প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও ফেনীর সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার জগতকে প্রাণের আলোয় একান্ত উদ্ভাসিত করে রেখেছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের স্বপ্নের পাদপীঠ ‘ফেনী প্রেস ক্লাব’। ‘প্রেস ক্লাবের’ স্থপতি-পুরুষদের মধ্যে এখন একমাত্র এরশাদ মজুমদারই বেঁচে আছেন।
এখনকার ফেনীতে সংবাদপত্রের সংখ্যা প্রায় অর্ধ শতাধিক। সাংবাদিকের সংখ্যাও অনেক। আমি ভাগ্যবান যে, তাঁরা অধিকাংশই আমার ছাত্র। তাঁদের অনেককে নিয়েই আমি গর্ব করি। তাঁরা আমার জন্মমাটি এ ফেনীর যোগ্য সন্তান। সংবাদপত্রসেবীদের যে ত্যাগ, নিষ্ঠা, সততা আর জীবননিষ্ঠ মূল্যবোধ থাকতে হয়; সর্বোপরি ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সমাজ ও জনগণের স্বপক্ষে নির্ভয়ে সদা সত্য কথাটি বলে দেওয়ার গুণ, তা তারা অনেকেই রপ্ত করেছে। এজন্য নানা সময়ে তারা কেউ কেউ ক্ষমতাসীনদের হাতে নির্যাতিতও হয়েছে। আমার জানা মতে ফেনীর সাংবাদিকদের মধ্যে একজন মীরু, একজন টিপু এবং একজন রফিক তাদের বলিষ্ঠ উদাহরণ। এরা তিনজনই আমার ছাত্র।
আর এটাতো জানা কথা যে, সত্যি কথা সব সময়ে সহজে বলা যায় না। সামাজিক স্বার্থবাদ ও ক্ষমতার দাপট সত্যিকে সর্বকালেই দাবিয়ে রাখতে তৎপর। আইনে বেআইনে সাংবাদিকের কলমকে গলা টিপে ধরতে কখন কোন্ ক্ষমতাসীনরা চাননি ?
সম্প্রতি ফেনী সাংবাদিকদের কিছু কিছু কর্মকান্ড যেমন তাদের নিজেদের মধ্যে বাক-বিতন্ডা, মারামারি ইত্যাদি আমাকে নিশ্চুপ ও হতবাক করেছে। বলতে গেলে আমি আহত হয়েছি দারুণভাবে। কারণ এসবতো আমরা কোনদিন দেখিনি!
তাদের সব ভালো। তবে আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না, আগেও বলেছি, তারা প্রেসক্লাব ভাগাভাগি করতে যায় কেন ? এর ধারাবাহিকতাতেই আবার সেই মাথা ফাটাফাটি! (ওদের কারো কারো মাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি! ওরা এসব কেন করে ? উদ্দেশ্য চেয়ার দখল, না কেউ জানে না এমন কিছু নিয়ে ভাগাভাগি ?) এক্ষেত্রে আমি লজ্জিত যে, যাদের মাথা ফাটছে, তারা যেমন আমার ছাত্র আর যারা মাথা ফাটাচ্ছে তারাও আমার ছাত্র। এটা কেন হচ্ছে ? এ ঐতিহ্য তো ফেনী সাংবাদিকতার কোনদিনই ছিলো না এবং এটা কখনো কারো কাম্য নয়।
তিন.
যাক, যে নাম দিয়ে শুরু করেছিলাম। তেরো পেরিয়ে দুরন্ত কৈশোরে। এটা সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেনেরই নিজের একান্ত অনুভ’তি। এটা তার এবারকার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর মূল প্রতিপাদ্য। দীর্ঘ চলার পথের কষ্টকর অভিজ্ঞতা আর অনুভূতিকেই বহন করা। এমনটাই সে বুঝাতে চেয়েছে কিনা কে জানে!
তার দৈনিকটিও আজ চৌদ্দ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। কষ্টকর বিগত ১৩ বছরের অভিজ্ঞতা শাহাদাতকে সমৃদ্ধ করেছে, ঋদ্ধ করেছে, না কাহিল করেছে, সেটাই সবার দেখার বিষয়।
একে সংশ্লিষ্ট সবাই হয়তো স্বাগতঃ জানাবে আরেক জন্ম দিন হিসেবে। আর তার অনুভূতি আনন্দের হলেও কতটা কষ্টকর আর পথশ্রান্তির, তা আমি ভালোভাবেই জানি। তার ‘সময়কর্মীরা’ সব সময়ে এ যাবত একটি গানই গেয়েছে ঃ আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয় । এবং এর ধারাবাহিকতায় সৌভাগ্যের কথা যে, বিগত ১৩ বছরের মধ্যে তারা কোন বাধাকেই বাধা মনে না করে পত্রিকার সমুজ্জ্বল প্রকাশনাকে অব্যাহত রেখেছে। শাহাদাতের এক ঝাঁক তরুণ সহযোদ্ধা ‘সময়কর্মীরা প্রতিদিন সকাল বেলা একটি উজ্জ্বল স্বপ্নের জয় হাতে করেই ঘুম থেকে জেগে উঠে। তাদের প্রত্যয়ের লাল সূর্য আকাশে আলো ছড়িয়ে রাতের অন্ধকারকে যখন দূর করে দেয়, তখন তাদের আনন্দের সীমা থাকে না। যারা কলম হাতে যুদ্ধ করে, তাদের এমনই হওয়ার কথা। এটা আমার অনুভূতি।
পত্রিকা বের করতে গেলেই কষ্ট আছে। কষ্ট সবার থাকে। আমাদেরও ছিলো। তাই কষ্টকর পথশ্রান্তির এ অনুভূতি সম্পাদক শাহাদাত হোসেনের একার নয়। এ দেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসের দিকে তাকালে যেমন ‘দৈনিক আজাদ’, ‘ইত্তেফাক’, ‘সংবাদ’ এসব জাতীয় দৈনিকগুলোর অতীত চলার পথের অভিজ্ঞতার মধ্যেও এ সত্যের প্রতিতি মেলে। অবশ্যি বর্তমানে কিছু কিছু সংবাদপত্রের মালিকানার ওপর রাজনীতি ও ব্যবসায় ভর করায় অবস্থা হয়তো অনেকেরই তেমন নেই। তবে ভিন্ন মত পোষণকারীদের অবস্থা কোন কোন ক্ষেত্রে আজো ত্রাহি ত্রাহি রব। পরোক্ষ চাপ কাজ না দিলে জেল, জুলুম, এমন কি সাংবাদিক হওয়া স্বত্তে¡ও কাউকে কাউকে রিমান্ডে পর্যন্ত যেতে হয়। আর কাউকে কাউকে মৃত্যুর পরেও রেহাই দেওয়া হয় না। তাদের ডেডবডিকেও যেখান পর্যন্ত যাওয়ার অধিকার সেখান পর্যন্ত যেতেও দেওয়া হয় না। যেমন আচরণ করা হয়েছে এবিএম মূসার ডেডবডির সাথে।
কিছুদিন আগে কোথায় যেন লিখেছিলাম। তার কয়টি চরণ ঃ
ও আমার দেশ,
দেশরে তুমি ভালো আছো, ভালো থাকো
আকাশ নীলে তারায় তারায় ছবি আঁকো
বাংলার গৃহিণীরা ঘরে ঘরে ভালো আছে,
মাটির উঠোন জুড়ে তারা বসে আছে
চাল ডাল কিছু আছে সবার ভান্ডে
শিক্ষক, সাংবাদিক কিছু তবে যান রিমান্ডে
ও আমার জননীগো, তুমি কেন লজ্জায় মুখ ঢাকো ?
তবে কি তুমি ভালো নেই ? আমি চাই, তুমি ভালো থাকো
আমি গান গাই আকাশের নীল দিয়ে তুমি ছবি আঁকো।
শাহাদাত হোসেনের মতো সাংবাদিকেরা, তাঁরা মফস্বলে কিংবা নগরেই থাকুন, আজো বুঝেন, সংবাদপত্রের জীবন বাঁচাতে তাঁদের কী কষ্ট! এঁদের চলার পথের কষ্টকর অভিজ্ঞতাই বা কি ! এটাতো আমাদের কালেও দেখেছি। এখনো কারো কারো ক্ষেত্রে সে অবস্থার পরিবর্তন যে হয়নি সংবাদপত্র জগতের দিকে চোখ বুলালে তা সহজেই চোখে পড়ে। এ অবস্থার পরিবর্তন কখন হবে কে জানে!
আর একটি কথা। এ দেশে সাংবাদিকেরা অনেকেই বেঘোরে মরেন। হয়তো সব দেশেই কিছু মরেন। এ দেশে একটু বেশি মরেন। সাগর-রুণিদের নিজের ঘরে ঘুমন্ত অবস্থাতেই মরতে হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে হত্যাকারীদের একটিই অভিযোগ, তাঁরা লিখেন কেন ? কেন সমাজের বিদ্যমান অসংগতিকে আঘাত করে লিখেন। ঘুষ, দুর্নীতি, লুন্ঠনের বিরুদ্ধে লিখেন। দখলদারী, টেন্ডারবাজি, ইয়াবা, গাঁজা, মাদক সম্রাটদের বিরুদ্ধে লিখেন। ন্যায়ের পক্ষে, নির্যাতিতের কল্যাণে কালোকে কালো, সাদাকে সাদা বলে সুস্থ্য জীবন গঠনের স্বপক্ষে লিখেন। ক্ষমতার অপব্যবহার, দম্ভ, কেন্দ্র দখল, ভোট চুরি, গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার কিংবা দেশে গণতন্ত্রহীনতার কথা লিখেন। অবশ্যি দেশের আমজনতা, বিপুল পাঠক সম্প্রদায় সাংবাদিকদের কাছে এমনটাই আশা করে।
একেবারেই ছোট্ট একটি ঘটনার কথা বলি, একজন ক্ষমতাসীন এমপির ইচ্ছে করেছে, তিনি একটি অবুঝ ছেলের পায়ে খেলতে খেলতে গুলি করেছেন, এটাও লিখতে হবে নাকি? অথবা একজন এমপি পুত্র, মায়ের অতিশয় আদরের দুলাল, নেহাৎ ফূর্তি করেই না হয় মধ্যরাতে রাস্তায় নিজের রিভলভার থেকে গুলি ছুঁয়েছেন। তাতে দু’জন অতি সাধারণ মানুষ মরেছে, তাতে কি হয়েছে। তা নিয়েও সাংবাদিকদের এত বাড়াবাড়ি কেন ? আর একজন শক্তিধর এমপি এক শিক্ষকের পেটে লাথি দিয়েছেন, শক্ত হাতে তার শুকনো গালে কয়টা চড় মেরেছেন, প্রকাশ্যে কান ধরে উঠবস্ করিয়েছেন, তাতে কি! শিক্ষক আবার মানুষ নাকি! (অবশ্যি তিনি নাকি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন!) এনিয়েও সাংবাদিকদের এমন হৈচৈ, মিডিয়াকর্মীদের এত বাড়াবাড়ি কার গায় সয়?
তাঁরা হয়তো বলতে চান, ভালো কথা, লিখার অভ্যেস যখন গড়ে তুলেছেন, আর না লিখলে পেটের ভাত হজমই হবে না তখন শক্তিমানের পক্ষেই লিখুন। যারা যখন রাষ্ট্রের পাহারাদার, তাদের পক্ষে লিখুন না যত পারেন। নন্দিত আয়োজনে লিখতে লিখতে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরিয়ে তুলুন। কিন্তু বিপক্ষে লিখতে যান কেন। বিপক্ষে লিখলে যে খবর আছে, সাংবাদিক হয়েও এটা না জানাটা একদম বোকামো। এ বোকামো আজকাল কিছু কিছু সাংবাদিক হরদম করেই যাচ্ছেন। কিছু সংখ্যক সচেতন পাবলিকও আবার বোকা। তারা কিছু না বুঝেই এসব সাংবাদিককে এপ্রিসিয়েট কওে থাকেন।
পাদটীকা ঃ
তেরো বছর আগে তার বাবার আশীর্বাদ নিয়ে শাহাদাত হোসেন আমাকে সাক্ষী রেখে ‘দৈনিক ফেনীর সময়’ নামে যে সংবাদপত্রটির ডিক্লারেশন দিয়ে এসেছে, তার ভার আজো সে একা বুকে বহন করেই হাঁটছে। তার সাদাসিদে চলার পথের নির্ভীকতা আমাকে মুগ্ধ করে। ভাবি, এভাবে নিরবচ্ছিন্ন জীবন চলার সঞ্চয় এবং দুঃসাহসিকতা কোথায় পেলো সে ?
এরিমধ্যে একদিন ফোন করে সে আমার দোয়া চেয়েছে।
আমি শাহাদাত হোসেনের মতো একটি তরুণ মনের আপোষহীন এগিয়ে চলার এই অক্লান্ত সাহসকে একান্তই সাধুবাদ জানাই। আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। তাদের এগিয়ে চলার উদ্যম দেখে বয়সকে ছাড়িয়ে আমার মাঝে মাঝে শ্লোগান দিতে ইচ্ছে করে ঃ ওহে তরুণ, তুমি/তোমরা এগিয়ে চলো, আমি প্রতিদিন তোমার/ তোমাদের কাগজ পড়ছি। যত দিন বেঁচে থাকি, যেন ততদিনই পড়তে পাই।
লেখক : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক।