কোনো এক স্থানে বড় কোনো ঘটনা ঘটেছে, সংবাদমাধ্যম এখনো ঘটনাস্থলে পৌঁছে সরাসরি সম্প্রচার শুরু করতে পারেনি। কিন্তু এরইমধ্যে জনৈক ব্যক্তি ফেসবুক মারফত ঘটনাস্থলের খবর ছড়ানো শুরু করেছেন। হয়তোবা ফেসবুকে লাইভ প্রচারও করছেন। সাধারণ একজন নাগরিকের সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার ব্যাপারটা বেশ দারুণ বলেই বিবেচিত হবে সবার কাছে। বিকল্প সংবাদমাধ্যম হিসেবে চারপাশের খবর আগের চেয়ে এখন বেশ সহজেই পাওয়া যাচ্ছে। আর এর পরই তৈরি হয় হইচই।
সম্প্রতি সাভারের একটি বাড়ির ছাদের উপরে এক নারীর গাছ কাটার দৃশ্যটি আলোচনায় এসেছে দেশের শীর্ষ সংবাদ মাধ্যমগুলোতে। প্রতিবেশীর লাগানো গাছ কাটার দায়ে এরই মধ্যে সাভারের পুলিশ গ্রেফতার করেছে সেই নারীকে।নারীর গাছ কাটার দৃশ্যটি সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হওয়ার আগে লাখ, লাখ মানুষ তা দেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দৃশ্যে দেখা যায় গ্রেফতার হওয়া নারী গাছ কাটছেন, আর গাছের মালিক চিৎকার করে কান্নাকাটি করছেন আর দৃশ্যটি ভিডিও করছেন। ফেসবুকে ভিডিওটি আপলোড হওয়ার পরবর্তী ঘটনা আমরা সবাই দেখেছি।
ঘটনাটির পর মনে হয়েছে, নাগরিক হিসেবে আমরা সচেতন হচ্ছি। নিজেদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা বিচার চাইতে পারছি আমরা। আর এর মাধ্যমেই আমরা সিটিজেন জার্নালিস্ট হয়ে উঠছি। এখন তো কোনো জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটলে টিভি চ্যানেল পৌঁছানোর আগে ফেসবুকে লাইভ দেখাতে পারেন যেকোনো আগ্রহী নাগরিক সাংবাদিক। নাগরিক সাংবাদিকতার যুগে সাধারণ ব্যক্তিও এখন খবর জোগান দিতে পারছেন। তা ছাড়া ইদানীং অনেক প্রথম শ্রেণির সংবাদমাধ্যম নাগরিকদেরও খবর সংগ্রহ করে পাঠানোর ব্যবস্থা রেখেছে। তাই এখন আমাদের চারপাশের সচেতন সব মানুষই এক একজন সংবাদ সংগ্রাহক হয়ে কাজ করছেন।
সাংবাদিকতা বলতে বোঝায় আমাদের চারপাশের সবকিছু সম্পর্কে খবর, তথ্য ইত্যাদি সংগ্রহ করে তা যথাযথ সংবাদমাধ্যমে সরবরাহ করা, প্রচার করা বা উপস্থাপন করা। এটি একটি পেশা। অর্থাৎ যে পেশাদার ব্যক্তি কোনো সংবাদ সংস্থায় সংবাদ সংগ্রহ, সংবাদ প্রস্তুত বা সম্পাদনার কাজ করেন তখন তাকে সাংবাদিক বলা যেতে পারে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সংবাদমাধ্যম এক অপরিহার্য উপাদান, এতটাই অপরিহার্য যে সংবাদ মাধ্যমকে ফোর্থ এস্টেট বলে অভিহিত করা হয়। একটি রাষ্ট্রের মূল উপাদান কেতাবীভাবে তিনটি ধরা হয়- আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ আর বিচার বিভাগ। সংবাদমাধ্যমের অপরিহার্যতার কারণে চতুর্থ উপাদান হিসেবে এই ফোর্থ এস্টেট নামকরণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে অনলাইন পত্রিকা হিসাবে নিবন্ধনের জন্য ২ হাজার ১৮টি আবেদন করেছেন অনলাইন পত্রিকার জন্য। তবে অনলাইন পত্রিকার সঠিক সংখ্যা বলা কঠিন। বর্তমানে দেশে বেসরকারি অনুমোদিত টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা ৪৫টি আর মোট নিবন্ধিত পত্রিকার সংখ্যা ৩ হাজার ২৫টি। এর মধ্যে দৈনিক পত্রিকা রয়েছে ১ হাজার ১৯১টি, অর্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা ৩টি, সাপ্তাহিক পত্রিকা ১ হাজার ১৭৫টি। পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় ২১২টি, মাসিক ৪০৪টি, দ্বিমাসিক ৭টি, ত্রৈমাসিক ২৮টি, চতুর্মাসিক ১টি, ষাম্মাসিক ২টি এবং বার্ষিক পত্রিকা ২টি। (সূত্র: জাতীয় সংসদ অধিবেশন, ২০১৮, জানুয়ারি)।
সাংবাদিকতা শব্দের সঙ্গে সব শ্রেণির মানুষের পরিচয় থাকলেও নাগরিক সাংবাদিকতা সম্পর্কে হয়তো ধারণা নেই অনেকরই। স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বপ্রণোদিত হয়ে গণমানুষের বা আম-জনগণের খবর ও তথ্য সংগ্রহ, পরিবেশন, বিশ্লেষণ এবং প্রচারে অংশগ্রহণ হচ্ছে নাগরিক সাংবাদিকতা। যখন একজন সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছায় খবর বা তথ্য সংগ্রহ করে বøগ, ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইত্যাদিতে প্রকাশ করে থাকে, তখনই সে নাগরিক সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।
সাংবাদিকতার কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই অনলাইনভিত্তিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কেউ তার চারপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনা, বিষয় বা নিজস্ব মতামত কিংবা সঠিক তথ্য-উপাত্ত লেখা, তথ্যচিত্র, খুদেবার্তা, অডিও, ভিডিও বা অন্য েেকানোভাবে জনস্বার্থে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার বা প্রকাশ করে থাকে। তবে জনকল্যাণেই তার একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে। পাঠকের মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরে নাগরিক সাংবাদিকতার প্লাটফর্ম তৈরি করে অনেক গণমাধ্যম। দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও রয়েছে চিঠিপত্র ও মতামত কলাম। তবে ফেসবুকই এখন নাগরিক সাংবাদিকতার প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।
২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে দৈনিক সমকালের একটি সংবাদের মাধ্যমে জানতে পারি মুক্তিযোদ্ধা মন্তাজ আলীর কথা। যিনি চিকিৎসাসেবা না পেয়ে মৃত্যুর দিন গুনছিলেন। টাকার জন্য চিকিৎসাও বন্ধ তার। পাঁচ মাস ধরে বিছানায় শয্যাশায়ী। তার জীবনের এই সমস্যা তুলে ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সাহায্যের আবেদন করেন তার পাশের বাড়ির এক ছেলে। আর এই আবেদনে সাড়া দেয় বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ।
চলতি বছরের ২৬ জুন বরগুনায় রিফাত শরীফ নামের এক ব্যক্তিকে তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সামনেই কুপিয়ে হত্যা করে একদল লোক। ঘটনার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়ালে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। আর এই ভিডিওর মাধ্যমেই পুলিশের আসল অপরাধীদের শনাক্ত করা এবং ধরা সহজ হয়েছে।
একটি রিকশা ভ্যান চুরির অভিযোগ তুলে ২০১৫ সালের ৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁওয়ে ১৩ বছর বয়সী রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা কারো ভোলার কথা নয়। মূল আসামি কামরুলের সহযোগী নূর মিয়া সেদিন রাজনকে পেটানোর দৃশ্য ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেন। ওই ঘটনায় সারাদেশে তৈরি হয় তীব্র ক্ষোভ। আর এই ভিডিও পরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়ে গ্রেফতার করে আসামিদের।
ওপরের সবই নাগরিক সাংবাদিকতার অংশ। আপনার কাছে বলার জন্য কথা আছে। তথ্য আছে। আপনার নিজের, আশপাশের, মানুষের গল্প আছে। আপনি সেটা মানুষকে সহজেই জানাতে পারেন। আপনার সে কথা, সেই গল্প সমাজের বা রাষ্ট্রের নয়, একইসঙ্গে শুনবে, জানবে পুরো বিশ্ব। আপনি নিজে সেটার স্থপতি। স্থপতি যেভাবে ভবন নির্মাণের জন্য কাজ করবে। সেখানে গল্প থাকবে, প্রশ্ন, উত্তর থাকবে। যুক্ত হতে পারে ভিডিও, অডিও বা ছবি। আরো থাকতে পারে নির্দেশনা।
নাগরিক সাংবাদিকতা বর্তমান সময়ের এক নতুন শক্তির নাম, এতকাল মানুষ শুধু একতরফাভাবে খবর পড়েছে। এখন খবর পড়া এবং সরবরাহ করা দুদিকেই অবস্থান নেওয়ার অভূতপূর্ব সুযোগ মানুষকে আরো শক্ত অবস্থান দিয়েছে। আবার নাগরিক সাংবাদিকতার মাধ্যম ফেসবুক হয়ে উঠেছে অনেকটা বিপজ্জনক। মোবাইল ফোনে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় মিথ্যা খবর ছড়িয়ে পড়ছে। বিভ্রান্ত হচ্ছে নাগরিকসমাজ। অনেক সময় মিথ্যা খবর ঠেকাতে কিংবা তার প্রভাবমুক্ত করতে হিমসিম খেতে হয় রাষ্ট্রকেও। সম্প্রতি ছাত্রআন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের প্রচারণায় তার প্রমাণ সবাই দেখতে পেয়েছেন। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়েও অনেকে আবার যাচাই-বাছাই না করেই অনেক খবর ছড়িয়ে দেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফলে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্র মুক্তি পায় না। আবার অনেক সময় সত্য ঘটনা বা ছবি কিংবা ভিডিও জনমনে ভয় বা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণ হয়ে ওঠে। যেমন ধরা যাক- সড়ক দুর্ঘটনায় ১০ জন নিহত হলেন। আর সেই দুর্ঘটনাকবলিত মানুষের রক্তাক্ত ছবি বা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হলো। এই ছবির বীভত্সতা শিশু, বৃদ্ধ কিংবা হূদয়বান মানুষের মনে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। কখনো সেই ছবি হতে পারে মৃত্যুরও কারণ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রমাণ হয়েছে কেউ একজন বা কোন গোষ্ঠী নাগরিক সাংবাদিকতার সুযোগ ব্যবহার করেছেন সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যে।
এ সুযোগের সঠিক ব্যবহার ও গঠনমূলক চর্চা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার এ ‘ফোর্থ এস্টেট’কে শক্তিশালী করবে। সত্যিকারের সুফল ভোগ করতে সব পক্ষকেই আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
তবে নাগরিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সব ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখা এর বড় চ্যালেঞ্জ। এ সুযোগের সঠিক ব্যবহার ও গঠনমূলক চর্চা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার এ ‘ফোর্থ এস্টেট’কে শক্তিশালী করবে। সত্যিকারের সুফল ভোগ করতে সব পক্ষকেই আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
লেখক : ব্যাংকার, কবি ও প্রাবন্ধিক।