মোহাম্মদ সফিউল হক :
নৈতিকতা বা মূল্যবোধের অবক্ষয় বর্তমান সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা। প্রতিটি মানুষ এটা স্বীকার করলেও মানছেন না সিংহভাগই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি আলোচনায় আসি; তাহলে আমরা দেখবো, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়সহ যত অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তার প্রায় সবগুলোই নৈতিক স্খলন ও মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত কারণে হচ্ছে। বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবার-সমাজ। আহত হচ্ছেন উন্নত মূল্যবোধে বেড়ে ওঠা কিছু মানুষ। ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে আম জনতা। অপর দিকে অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, স্বজন কেন্দ্রিক ক্ষমতায়ন, দলান্ধ সুবিধা দান, বাহ্যিক চাকচিক্যের প্রতি টান ইত্যাকার সমস্যা মিলিয়ে আমাদের পরিবার ও সমাজ প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি!
ব্যক্তির যখন নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়, তখন অবধারিতভাবে সে সংস্কৃতিক বিকলাঙ্গে ও আধ্যাত্মিক দেউলিয়ায় পরিণত হয়! তার কাছ থেকে বিদায় নেয় লজ্জা, মানবিকতা, আদব-আখলাকসহ যাবতীয় সুন্দর আচরণ। সেই ব্যক্তি তখন নিজের অবস্থানটাকেই মূখ্য মনে করে। তার চারপাশ হয়ে যায় কেবল আমিময়। সকল দায়বোধ থেকে মুক্ত ভাবে নিজেকে। সমাজ, পরিবার ও সামাজিক সুনীতিগুলোকে তার কাছে মনে হয় সেকেলে, অবাস্তব, অপ্রয়োজনীয় ও জঞ্জাল! নিজের অপরিণত বিবেক আর বুদ্ধি যা সায় দেয় তাই তার কাছে সিদ্ধ মনে হয়। নিজস্বতা বলতে তখন তার আর কিছু থাকে না। সে হয়ে যায় প্রবৃত্তির দাস। তার মনোজগতে চলতে থাকে অস্থিরতার সুনামি! ছোট ছোট অপরাধ করতে করতে একসময় বড় অপরাধের দিকে ধাবিত হয় সে। পরিবিার, আত্মীয়-স্বজন ও নিকটজনের উদ্বেগ উৎকণ্ঠার কোন মূল্য থাকে না তার কাছে। চলতে থাকে সামাজিক ও পারিবারিক অশান্তি। একসময় তা বিরাট পারিবারিক ক্ষতির কারণ হয়। কখনো বা খুন পর্যন্ত গড়ায়। নাড়িয়ে দেয় দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র-সরকারের আদর্শিক ভিত! প্রমাণ পাওয়া যাবে ২০১৩ সালের মধ্য আগস্টের ১৬/১৭ তারিখের পত্রপত্রিকায়। আমরা দেখতে পাই পুলিশ দম্পত্তি মাহফুজুর রহমান ও স্বপ্না রহমান নিহত হন স্বীয় কন্যা ঐশির হাতে। যে ঘটনাটি আহত করেছিল আমাদের।
নৈতিক ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সূচনা কোত্থেকে, কীভাবে শুরু হয়? এটা প্রাথমিকভাবে পরিবার থেকে শুরু হলেও পূর্ণতা পায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার কারণেই। এরপর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। একসময় নতজানু প্রশাসন, অর্থলোভী কর্মকর্তা, শীথিল পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, দলীয় প্রভাব, পারিবারিক শক্তি, এলাকা ভিত্তিক লালন-পালন, কোন প্রভাবশালী নেতার দলে ভীড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে কেউ কেউ আরো আস্কারা পায়। কেউ কেউ হয়ে যায় ত্রাসের অপর নাম। চলতে থাকে পারিবারিক ও সামাজিক অশান্তি। চরম উদ্বেগে থাকে সমাজের সাধারণ মানুষ। আর সেই অবক্ষয় স্থান-কাল-পাত্রভেদে চলতেই আছে আমাদের সমাজে। ব্যক্তির অবস্থান আর ক্ষমতার প্রেক্ষিতে সমাজের সবচেয়ে ছোট প্রতিষ্ঠান, পরিবার থেকে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানেও সংক্রমিত হচ্ছে দিন দিন। মানুষ হিসেবে কমে যাচ্ছে আমাদের অনূভূতি। কমে যাচ্ছে আবেগ, ধর্মাচারের আগ্রহ। বেড়ে যাচ্ছে চাহিদা, শ্রেষ্ঠত্বের আকাক্সক্ষা, বিলাসি জীবনের ইচ্ছা, অনুকরণের ভয়াবহ স্রোত, বেয়াদবির মাত্রাসহ নানা অনাকাঙ্ক্ষিত উপসর্গ।
প্রথমত দেখি, পরিবার থেকে কীভাবে শুরু হয় সেই অবক্ষয়টা? একেবারে খুব ছোট বেলা থেকে যদি দেখি তাহলে দেখা যায়, বর্তমানে আমরা খুব অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছি আমাদের সন্তানদের বেলায়। গ্রাম কিংবা শহরে সব জায়গায় আজকাল নিজের সন্তানের দোষ-ত্রুটির প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতে দেখা যায় কম জনকেই। সন্তানের প্রতি যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে সেটার মিমাংসা হয়ে যায় তার সামনেই। এক্ষেত্রে অধিকাংশ অভিভাবকই নিজের সন্তানের নির্দোষিতার প্রমাণে সচেষ্ঠ থাকেন। আবার ক্লাসে শিক্ষক কোন কারণে তাকে যদি একটু-আধটু গালমন্দ করেন অথবা ডর-ভয় দেখান তখন সন্তান মা-বাবার কাছে নালিশ করে। মা-বাবা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সন্তানের সামনেই শিক্ষকের সাথে খারাপ আচরণ করছেন। একটু উচ্চবিত্ত হলে তো কথাই নেই! সমাজের আর কাউকে মানুষ মনে করার শিক্ষাটা পর্যন্ত দেওয়া হয় না! কোন কোন ক্ষেত্রে। শ্রমিক শ্রেণি, দরিদ্র পরিবার, দিন মজুর পরিবারসহ এমন পরিবারের অবক্ষয় শুরু হয় মা-বাবার ঝগড়া, প্রতিবেশির সাথে ঝগড়ায় অশ্লীল বাক্য প্রয়োগ আর গালি থেকে। কখনও কখনও পবিারের নিজস্ব নৈতিক অবক্ষয় থেকে।
মধ্যবিত্ত ও নিু মধ্যবিত্ত পরিবারের অবক্ষয়টা শুরু হয় পারিবারিক প্রতিযোগিতা, কাজের চাপে সন্তানের খোঁজ খবর না নেওয়া, মা-বাবা উভয়ের চাকরি করার জন্য কাজের লোকের কাছে বেড়ে ওঠা, সন্তানের শিক্ষাকে বিনিয়োগ মনে করা, আদরের প্রাবল্য, অন্যের সন্তান থেকে নিজের সন্তানকে বেশি ভাল মনে করা, সন্তানের প্রতি অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে কোন অভিযোগকে পাত্তা না দেওয়া, যে কোন মূল্যে সাফল্যের চেষ্টাকে বাধা না দেওয়া ইত্যাদি। যেমন: পরীক্ষায় নকল করা; আজ পর্যন্ত কোন মা-বাবাকে দেখিনি সন্তানকে বলছেন যে নকল করে যদি পরীক্ষা দিস তাইলে বাড়িতে জায়গা নাই। কিন্তু শুনেছি; রেজাল্ট ভাল না হলে বাড়িতে আসবি না। দেখেছি একটু সুবিধা লাভের আশায় নিজ সন্তানের সীট যেন ভাল ছাত্রছাত্রীর সাথে পড়ে তা নিয়ে অভিভাবকদের ইঁদুর দৌড়। সম্প্রতি দেখেছি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে সেই খবরে অভিভাবকদের কী ছুটাছুটি! প্রশ্নপত্রটা পেতেই হবে। যেসব সন্তান মা-বাবার এই অবস্থান প্রত্যক্ষ করে বড় হচ্ছে সেই সন্তানকে কীভাবে তারা আখলাকে হসানার সবক দিবেন?
আছে আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন। আমরা আমাদের সন্তানদের এখন আর সাহাবীদের কাহিনী, মনীষীদের কাহিনী শুনাই না। তাদের হাতে তুলে দেই রিমোট কন্ট্রোল! একসাথে বসে দেখি সিনেমা, নাটক আর নানা অনুষ্ঠান। আজকালের নাটক সিনেমা যৌনতা, আর অপরাধ প্রবণতা ছাড়া হয় না। নায়কের ভালমানুষির ভেতরও থাকে প্রেম প্রেম খেলার নষ্টামি। আর বাঙ্গালি সবসময় মন্দটাকে নিতে পছন্দ করে। ফলে ভিলেনের চরিত্রটাই আমাদের সন্তানদের উপর প্রভাব ফেলে বেশি। আর মেয়েদের উপর প্রভাব ফেলে নাটক সিনেমার নায়িকাদের ফ্যাশনেবল পোষাক-আষাক। বর্তমানে উটকো ঝামেলা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইন্ডিয়ান সিরিয়াল। আমাদের মা-মেয়েদেরকে দেদারছে শেখাচ্ছে পরকিয়া আর কীভাবে স্বামী-ভাই-বাবাকে ফাঁকি দিয়ে ডেটিং করা যায়। শিশু কিশোরদের শেখাচ্ছে ইচরে পাকামু, বেয়াদবি, ঔদ্ধত্য, কল্পনাবিলাশী হওয়ার মন্ত্র।
উভয়ে চাকরিজীবি ও এক সন্তানের কোন কোন একক পরিবার সন্তানের নিসঙ্গতাকে কাটানোর জন্য বাসায় নিয়ে আসেন নানা ধরণের বিনোদন সামগ্রী। তাতে আছে কম্পিউটার, টিভি ও ডিশ লাইনের সংযোগ। ফলাফল, শিশু-কিশোররা মেতে থাকে কার্টুন আর গেমস নিয়ে। একটু বড়রা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আছে নানা এডাল্ট সাইট আর পর্নো নিয়ে। নারীদের বড় একটা অংশ মেতে থাকে কলকাতা আর ইন্ডিয়ান সিরিয়াল নিয়ে। একসময় সবকিছু থেকেই তাদের মজা নষ্ট হতে থাকে। শুরু হয় নেশার জগতের প্রথম ধাপ। কেউ কেউ আবার সংগী সাথীদের সাথে ধুমপান করতে করতে মাদকাসক্ত হয়ে যায়।কারো কারো সন্তান মানুষ হয় কাজের লোকদের সহায়তায়। স্কুলে আনা নেওয়ার কাজটাও হয় ড্রাইভার অথবা কাজের লোকের মাধ্যমে। যদি কাজের লোকেটি মানুষ ও সৎ হয় তাহলে তো বাঁচা গেল। যদি তা না হয়। ক্ষেত্র বিশেষ দেখা যায় সন্তানের চরিত্রে সেই কাজের লোকের চরিত্রের প্রভাব পড়ছে।
শিক্ষাঙ্গনের অবস্থা আরো ভয়াবহ! যারা আশা করেন যে, বাড়ির বা বাসার পরিবেশ হতে বিদ্যালয়ে গিয়ে একটু উন্নত মানসিকতা ও নৈতিকতা নিয়ে বড় হবে তাও আজকাল আর সম্ভব নয়। শুরু সেই কিন্ডারগার্টেন থেকে! ভর্তির পর প্রথমেই একটি শিক্ষার্থী দেখতে পায় কোচিং আর প্রাইভেট নিয়ে শিক্ষকদের অনৈতিক অবস্থান। কিছু দিন পর চলে আসে টার্ম পরীক্ষা, তখন শুরু হয় সাজেশান্সের নামে প্রশ্ন আউটের উৎসব। এরপর আসে ভাল স্কুলে ভর্তির সংগ্রাম। চলে টিউটর, কেচিং ও অভিভাবকের নানা কসরত। কোথাও কোথাও অর্থের আদান প্রদান। কোচিং আর টিউটর নিয়ে চলে দড়ি টানাটানি। আর এর সবই অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় শিক্ষার্থীর সামনেই। তারপর আবার পরীক্ষার রাতে প্রশ্ন ফাঁসের প্রচেষ্টা তো আছেই। তারপর যদি আসি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের কথায়। সেখানে আছে উপবৃত্তির আরেক লীলাখেলা। কত যে অনৈতিক খেলা চলে এই উপবৃত্তির জন্য তার কোন হিসেব নেই। এর পর আছে শিক্ষকদের দায়সারা কাজ কারবারের নানা অভিযোগ। ছাত্রদের অধিকাংশই কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি থাকায় নেই জবাবদিহিতা। ফলে প্রাইমারির একটা ছাত্র প্রায় সময়েই ওঠে আসে চরম অবহেলা আর অমনোযোগ নিয়ে। শিক্ষা ও জ্ঞানের যথার্থ অভাবের কারণে তাকে একসময় পরীক্ষা পাশের জন্য নিতে হয়ে অসদুপায়ের অবলম্বন।
এরপর আসে হাইস্কুল অথবা আলীয়া মাদ্রাসায়। সেখানেও চলে প্রাইভেট আর কোচিং নামের বাণিজ্য। দেখা যায় শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ার কারণে প্রশ্নের উত্তর না দিয়েও নম্বর পেয়েছে। আবার প্রাইভেট না পড়ার কারণে যথাযথ উত্তর করেও কাক্সিক্ষত নম্বর পায়নি। ময়মনসিংহ জিলাস্কুলের আমার এক ছাত্র পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশের পর সখেদে বলেছিল, “স্যার একজন শিক্ষক যিনি আমাদের মানুষ বনানোর কাজ নিয়ে এই পেশায় এসছেন, তিনি যদি তার কাছে প্রাইভেট না পড়ার কারণে আমাকে কম নম্বর দেন। তাহলে আমরা কি শিখলাম যে, আমি যখন পাশ করে উচ্চ পদে চাকরিতে যাবো, তখন যদি এই শিক্ষক পেনশনের কারণে অথবা অন্য কোন কারণে আমার কাছে যান তাইলে আমি তার কাছ থেকে ঘুষ নিবো?” একজন শিক্ষক হিসেবে আমি তখন নিজেকে খুবই লজ্জিত মনে করেছিলাম। ছাত্ররা যখন একজন শিক্ষকের নানা ভনিতা ধরে ফেলে তখন সেই শিক্ষকের উপদেশ, আদেশ, আর আদর্শ সেই ছাত্রটিকে আর টানে না। ফলে সেও নিজের মত নিজের জীবন ব্যবস্থা তৈরি করে নেয়।
এবার আসি ভার্সিটি ও কলেজের কথায়। সেখানেও আছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, অর্থনৈতিক আত্মসাৎ, শিক্ষকদের দলাদলি অধ্যাপক-ভিসির দলান্ধ আদর্শ, ছাত্রদের ছাত্র রাজনীতির নামে দলীয় লেজুড়বৃত্তি, স্যেকুলারিজমের নামে ধর্ম ও সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে বিষোধাগার, প্রগতিশীলতার নামে ইসলাম ও মুসলমানের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অধিকার হরণের নির্লজ্জ কূটচাল ইত্যকার নানা সমস্যা। ফলে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা নেওয়ার পরও একজন মানুষ সত্যিকারের মানুষ হতে পারছে না। শিক্ষিত কোন রাজনৈতিক নেতাও আসছেন না; যিনি বদলে দেবেন আমাদের সমাজের খোলনলচে। অন্যদিকে সমাজের শিক্ষিত শ্রেণি ও সৎ মানুষেরা ক্রমেই রাজনীতি বিমুখ হচ্ছেন। সেই জায়গা দখল নিচ্ছে একদল গোয়ার, অশিক্ষিত, লোভী এবং সুযোগ সন্ধানী মানুষ নামের অমানুষ। আমরা পাচ্ছি একটি অনিশ্চিত আগামীর স্বদেশ। পাচ্ছি আগত প্রজন্মের জন্য এক আকাশ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তৈরি হচ্ছে একদল সরকারি আমলা আর চাকুরে। তৈরি হচ্ছে কেরানি আর শোষক। রাষ্ট্রের পরতে পরতে, ধাপে ধাপে এখন চলছে ঘুষের বাণিজ্য। চলছে সুদের উৎসব। আর এইসব ঘুষ আর সূদের কারবারিদের মধ্যে শিক্ষিত ও সমাজের উপর তলার মানুষই বেশি। যারা সমাজটাকে আলোকিত করবেন তারাই এখন অন্ধকারের সারথি। কে দেবে আলোকের সন্ধান? কোথায় পাবো আশার সঞ্জিবনী শক্তি। চারপাশের বাতাস ও পরিবেশ এখন বিষাক্ত! মানুষের কেন্দ্রীয় কমান্ড ভেঙ্গে পড়েছে মনে হয়!
সমাজের প্রতিটি সেক্টরে আজ সুদখোর আর ঘূষখোরে প্রতাপ। মসজিদ-মাদ্রাসার কমিটিতেও একজন না একজন ঘুষখোর আছেই। নৈতিকতার কোন বালাই নেই; আজকের সরকারি চাকুরেদের মধ্যে। ইয়া লম্বা দাঁড়ি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে পড়ছেন নিয়মিত। কিন্তু সেই নামাজ ও সুন্নাত তাকে বাঁচাতে পারছে না ঘুষ থেকে। কারণটা কী? কোথায় এই সমস্যার উৎস? এর একটাই কারণ, ভেঙ্গে গেছে আমাদের মূল্যবোধের দেয়াল। ছিড়ে গেছে নৈতিকতার চাদর। দিন দিন মানুষের হতাশা বাড়ছে। বাড়ছে অপরাধের খতিয়ান। দুর্বল ঈমান আর ঈমানী আদর্শহীন মানুষ অন্যায় করেই যাচ্ছে। একদল তা সয়েও যাচ্ছে। অপর দিকে যারা আদর্শিক মানে উন্নত তারাও আছে অনেকটাই বেখবর। তাদের মাঝেও আছে নানা মত-পথ আর অনৈক্যের সাতকাহন। ফলে একটা দেশ জাতীয়ভাবে ঘূষ আর দূর্নীতির কাছে হেরে যাচ্ছে।
একটি সমাজ যখন তার নৈতিক অবস্থান হারায় তখন সেই সমাজে ধেয়ে আসে নানা অপরাধের সুযোগ। সমাজের আবাল-বুদ্ধ-বণিতা হয়ে যায় অপরাধ প্রবণ। আইন তখন আর সেই সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সবাই খুঁজতে থাকে আইনের ফাঁকফোকর। সেইসব ফাঁকফোকর গলে অপরাধিরা সহজেই মুক্তি পায়। মুক্তির পর শুরু করে আরো বেশি। ফলে সমাজে বাড়তে থাকে ইভটিজিং, মাদকাসক্ত, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, কিশোর অপরাধ, ধর্ষণ, হত্যা, গুম, মিথ্যা মামলা, নারী নির্যাতন, যৌতুকের ভয়াবহতা, এসিড নিক্ষেপ, অপহরণ, চিনতাই, হাইজ্যাক, কিডন্যাপ, উৎকোচ ইত্যাদি অপরাধ। বাড়তে থাকে রাজনৈতিক সহিংসতা। মানুষের জীবনে নেমে আসে স্তবিরতা। জনজীবনে আসে অনিশ্চিত আগমীর পদধ্বনি। ভাঙ্গন ধরে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে। তৈরি হয় বিভেদের দেয়াল ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের, প্রতিবেশীর সাথে প্রতিবেশির। বন্ধুর সাথে বন্ধুর। নৈতিক আর আদর্শিক ঐশ্বর্য না থাকলে চিন্তাগত ও আদর্শগত মতানৈক্যের কারণে শত্রুতার বীজ বুনে যায় যে কেউ। বর্তমানে আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার দলনীতিতে তাই দেখছি। পরমত সহিষ্ণুতা চলে যায় শূন্যে। সমালোচনা হয়ে যায় শত্রুতা। প্রতিবাদ হয়ে যায় যুদ্ধ। ক্ষমতার জন্য মানুষ হয়ে যায় অন্ধ।
সুতরাং পরিবার ও সমাজকে বাঁচিয়েই রাষ্ট্রকে বাঁচতে হবে। আর রাষ্ট্রকে বেঁচে থাকতে হলে তাকে তৈরি করতে হবে সুনাগরিক। সুনাগরিকের অন্যতম শর্ত হলো তারা হবে নৈতিক মানে উন্নত। সামজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে উজ্জিবীত।আদর্শিক চেতনায় সুদৃঢ়। কর্ম প্রচেষ্টায় নিয়মিত। এখন যদি আমরা পরিবার, সমাজ আর রাষ্ট্রকে নিয়ে সফল হতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাদের নৈতিক মানে উন্নত হতে হবে। আর এই মান উন্নয়নের জন্য, পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সবাই এক একযোগে কাজ করতে হবে। নিতে হবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। চেষ্টা চালাতে হবে সম্মিলিত। একক প্রচেষ্টায় এই দেশের নৈতিক, আদর্শিক, আধ্যাত্মিক দেউলিয়াত্বের শেষ করা যাবে না। এক্ষেত্রে শিক্ষক, সুশীল সমাজ, রাজনীতিক ইমাম ও আলেম সমাজের এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে সমাজের আরো সৎ মানুষকে সাহসি ও নির্ভিক চেতনা নিয়ে। তাহলেই আমরা পাবো একটি নিারাপদ পারিবারিক ও সামাজিক বাংলাদেশ।
লেখক : ব্যাংকার, কবি ও প্রাবন্ধিক।