নিজস্ব প্রতিনিধি :
নদীর বাঁধ খুলে ফেনীসহ দেশের ১১টি জেলাকে বন্যায় ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। এই পানি আগ্রাসনের দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে ভারতের বিচার এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন বিশিষ্টজনেরা।
শুক্রবার ফেনীতে ‘স্ট্রাইক ফর ওয়াটার জাস্টিস’ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে তারা এ দাবি জানান। শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এই কর্মসূচির আয়োজন করে ‘আমরা ফেনীবাসী’। দেশের খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, ছাত্র-জনতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে অংশ নেন।
কর্মসূচিতে সভাপত্বি করেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। কর্মসূচি থেকে ‘১১ দফা ফেনী ঘোষণা’ তুলে ধরেন দৈনিক ফেনীর সময় সম্পাদক ও সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক ফেনী জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন।
‘আমরা ফেনীবাসী’র অন্যতম উদ্যোক্তা বুরহান উদ্দিন ফয়সলের সঞ্চালনায় স্ট্রাইক কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন নদী ও পানি বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ এজাজ, বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম-সম্পাদক মিহির বিশ্বাস, বাপা যুগ্ম-সম্পাদক হুমায়ুন কবির সুমন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি এম আব্দুল্লাহ, নারী নেত্রী নুর তানজিলা রহমান, ফেনী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আব্দুর রহিম, দৈনিক ফেনী সম্পাদক আরিফ রিজভী, ফেনী জেলা আইনজীবী সমিতির যুগ্ম-সম্পাদক এমদাদ হোসাইন, কবি ও সমাজকর্মী ফজলুল হক, সমাজকর্মী আমের মক্কি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ফেনী জেলার সমন্বয়ক আব্দুল আজিজ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক ইমাম হোসেন, কবি আলাউদ্দিন আদর।
অনুষ্ঠানের শেষ দিকে এসে এই কর্মসূচির প্রতি সংহতি জানান জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরা সদস্য অধ্যাপক লিয়াকত আলী ভূইয়া। স্বাগত বক্তব্য রাাখেন আমরা ফেনীবাসী প্লাটফর্মে অন্যতম উদ্যোক্তা কেফায়েত উল্যাহ চৌধুরী শাকিল, ব্যবস্থাপনায় ছিলেন আরেক উদ্যোক্তা আবদুল্লাহ হাসান।
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘এই বন্যা শুধুই প্রাকৃতিক নয়, ভারত কোনোভাবে এর দায় এড়াতে পারে না। এই বন্যায় ফেনীসহ ১১টি জেলার মানুষ মানসিক, শারীরিক ও আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।’
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দাবি করেন তিনি। একইসাথে সকল অভিন্ন নদীতে ড্যাম বা বাঁধ অপসারণের দাবি জানান এই বিশেষজ্ঞ।
মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘ভারত চাইলেই যে এক দিনে বাঁধ কেটে বাংলাদেশের মানুষকে বিপদে ফেলে দিতে পারে, এবারের বন্যা তার উদাহরণ। বাংলাদেশ ও ভারতের ৫৪টি অভিন্ন নদীতে ৬৮টি বাঁধ দিয়েছে ভারত। প্রতিটির হিসাব ভারতকে দিতে হবে।’
এই পানি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ভারত দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও ফাঁরাক্কায় বাঁধ দিতে পারেনি। শেখ মুজিবের শাসনামলে ভারত এই বাঁধ দিতে সক্ষম হয়। ফেনী নদীর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে। এদেশে দিল্লির আধিপত্যবাদের প্রোডাক্ট ছিল শেখ হাসিনা। দেশে উন্নয়নের বয়ান হাসিনার ছিল না, এটি ছিল মোদির শেখানো বুলি। উন্নয়নের নামে নদী ও পরিবেশ ধ্বংস করেছে শেখ হাসিনা।’
মিহির বিশ্বাস বলেন, ‘ফেনীর মানুষ লড়াই-সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে জানে। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও ফেনীবাসী হারবে না।’ ভারতকে পানি নিয়ে বৈষম্যহীন আচরণের আহ্বান জানান তিনি।
হুমায়ুন কবির সুমন বলেন, ‘দেশের এবারের বন্যা যতটা না প্রাকৃতিক তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক।’ পানি আগ্রাসনের দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে ভারতের বিচার দাবি করেন তিনি।
সাংবাদিক নেতা এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ভারত শুধু পানিসন্ত্রাস নয়, সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা, এদেশের ভোটাধিকার হরণ ও বাণিজ্য আগ্রাসন চালিয়ে আসছে দীর্ঘদিন। আচরণ না পাল্টালে ভারতকে এর মূল্য দিতে হবে।’
১১ দফা : আন্তঃসীমান্তীয় সব নদী থেকে ড্যাম/ব্যারেজ বা যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তা অপসারণ করতে হবে। এবারের বন্যার জন্য ফেনীর পরশুরামে ভারতের ইচ্ছাকৃত বাঁধ কেটে দেয়া বহুলাংশে দায়ী। এ জন্য জাতিসংঘের সহায়তায় ভারতকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। মুহুরীর চরে নোম্যান্সল্যান্ডে ভারতের কেটে দেয়া সুরক্ষা বাঁধটি অবিলম্বে পুনর্র্নিমাণ করতে হবে। বাংলাদেশের পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে হবে এবং ফেনী নদী থেকে অবৈধভাবে পানি উত্তোলন চলবে না। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি নাগরিককে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
কৃষি, মৎস, পোল্ট্রি ও অন্য ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ, প্রণোদনা এবং সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে অতিদ্রুত তা মেরামত করতে হবে। নদীভাঙন রোধে এখনি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। মুছাপুর ক্লোজার পুনর্র্নিমাণে কালবিলম্ব না করে পদক্ষেপ নিতে হবে। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি বাড়ার পেছনে বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনেরও দায় আছে, এ জন্য দায়ী দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে এবং বাংলাদেশ সরকারকে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। উন্নয়নের নামে জলাধারে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা যাবে না। ভরাট করা খাল ও নদীর নাব্য ফিরিয়ে দিতে হবে। দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নদী ও পরিবেশ দূষণ রোধ এবং বনভূমি উজাড় বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্থানীয় কিছু যুব সংগঠন এতে অংশ নেয়। এর মধ্যে রয়েছে ফেনী জেলা স্বেচ্ছাসেবক পরিবার, ইয়ুথ নেট গ্লোবাল ফেনী শাখা, ইকো রেভ্যুলেশন, ফেনী ছাত্র ও যুব সমিতি, লস্কর হাট ব্লাড ডোনেট অ্যাসোসিয়েশন, মির্জা ফাউন্ডেশন, মিশন গ্রিন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোট (বিএনসিএ), প্রয়াস, আমরাই আগামী ও ফেনী ফ্লাড রেসপন্স টিম।