আরিফ আজম :
ফেনী জেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ১২টি দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত ও উন্নয়ন বঞ্ছিত রয়েছে। বিভিন্নসময় এসব মাদরাসার উন্নয়নে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ বরাদ্দ দিলেও সেটি মাদরাসার কাজে লাগানো হয়নি। শুধু তাই নয়, সর্বশেষ দুটি বরাদ্দের মেয়াদ কালক্ষেপনে ইতিমধ্যে অর্থবছর পার হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৮ সালে ফেনী জেলার প্রতিটি উপজেলায় দুটি করে দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ফেনী সদরের মোটবী ইউনিয়নের শাহাপুর, পূর্ব কাজিরবাগ, সোনাগাজী উপজেলার চরমজলিশপুর ইউনিয়নের আলামপুর, দুর্গাপুর, ফুলগাজী উপজেলার বন্দুয়া, দক্ষিন ধর্মপুর, পরশুরামের চম্পকনগর, দক্ষিন চন্দনা, ছাগলনাইয়ার দক্ষিন সতর ও জগন্নাথ সোনাপুর, দাগনভূঞার গজারিয়া, আলিপুর এলাকায় প্রতিষ্ঠিত এসব মাদরাসা পরিচালনা করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাদরাসা প্রতি ১১টি খাতে ৩৪ হাজার ৯শ টাকা বরাদ্দ দেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়। এ বরাদ্দ থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জেলা কার্যালয় থেকে প্রতিটি মাদরাসায় নামমাত্র ৩টি ফ্যান, একটি দেয়াল ঘড়ি ও তিনটা বই বুঝিয়ে দিয়ে বাকি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এনিয়ে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ প্রতিবাদ না করতে তাদের কাছ থেকে অগ্রিম ভাউচারে স্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়। এছাড়া ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে প্রথম দফায় ৩৭ হাজার ৪৯১ টাকা ও দ্বিতীয় দফায় ৭৮ হাজার ৬৮০ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে এসব বরাদ্দ ব্যয়ের নিয়ম থাকলেও সেটি কোন মাদরাসায় দেয়া হয়নি।
সূত্র আরো জানায়, এসব বিষয়ে ২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর শাহাপুর দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সদস্য সোহরাব হোসেন ভূঞা প্রকল্প পরিচালক ও জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ দেন। এর প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) ফাহমিদা হককে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি এসব মাদরাসার ১২ জন শিক্ষককে ডেকে ঘটনার বিস্তারিত জেনে ও সরেজমিনে মাদরাসাসমূহ পরিদর্শন করেন। প্রকল্প দপ্তর থেকে মসজিদ ভিত্তিক শিশু গণশিক্ষার অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক বজলুর রশিদকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
অপর একটি সূত্র জানায়, ২০২৩ সালে প্রতিটি মাদরাসার জন্য একজন করে পরিচ্ছন্নতাকর্মী কাম অফিস সহকারী নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। এর আলোকে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে শুধুমাত্র ৪ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়।
ছাগলনাইয়ার দক্ষিন সতর দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষক সাইফুল ইসলাম জানান, “গত বছর ফেনী শহরের ট্রাংক রোডের কোর্ট মসজিদ সংলগ্ন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সদর উপজেলা কার্যালয়ে তিনদিনের প্রশিক্ষণ দায়সারাভাবে এক ঘন্টায় শেষ করে দেয়া হয়েছে। ওই প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষক প্রতি ১৩শ টাকা ভাতা নির্ধারণ থাকলেও শুধুমাত্র ৩শ টাকা দেয়া হয়েছে।”
বন্দুয়া দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সদস্য ছলিম উল্যাহ জানান, “মাদরাসা প্রতিষ্ঠাকালে চেয়ার-টেবিলের জন্য কিছু বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এরপর ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ৩৫ হাজার টাকার বিল ভাউচারে সাক্ষর নিয়েছে। কিন্তু তারা ১৯শ টাকা দামের তিনটি ফ্যান, একটি দেয়াল ঘড়ি ও তিনটি বই দিয়েছেন। এছাড়া আর টাকা-পয়সা, মালামাল কিছুই দেয়নি।”
শাহাপুর দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদরাসার ইনচার্জ মুফতি মুহাম্মদ তরিকুল ইসলাম জানান, “প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক অভিপ্রায় ও দিকনির্দেশনায় প্রকৃত ইসলামি চেতনার মর্মালোকে আরবি ধারায় একটি দ্বীনি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। এ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা, মর্মবাণী ও চেতনার প্রচার-প্রসার এবং আরবি ভাষা শিক্ষার সুযোগ তৈরি হয়। তবে মাদরাসাগুলোতে সরকারের বরাদ্দ যথাযথভাবে ব্যবহার না হওয়ায় প্রান্তিক পর্যায়ে কাঙ্খিত দ্বীনি প্রসার হচ্ছেনা।”
অভিযোগ প্রসঙ্গে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ফেনী জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মীর মুহাম্মদ নেয়ামত উল্যাহ ফেনীর সময় কে বলেন, “বায়বীয় অভিযোগের তদন্ত হয়েছে। এসব বিষয়ে কিছু বলতে চাইনা।
তার দাবী, বরাদ্দ হওয়া অর্থ ব্যবহার না হওয়া উপজেলা পর্যায় ও সংশ্লিষ্ট মাদরাসা কর্তৃপক্ষের বিষয়। বরাদ্দের টাকা ব্যাংকেই জমা রয়েছে।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার ফেনীর সময় কে বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ধরনের একটি অভিযোগের তদন্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যবহার না হওয়ার বিষয়টি তার জানা নেই।
দারুল আরকাম এর প্রকল্প পরিচালক ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো: আব্দুস সবুর ফেনীর সময় কে বলেন, “বরাদ্দ হওয়া অর্থ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যবহারের নিয়ম রয়েছে। প্রত্যেকটি উপজেলা কমিটির মাধ্যমে বরাদ্দের টাকা ব্যবহার করার কথা। ব্যাবহার না হলে বছর শেষে ফেরত চলে যাবে।”
তিনি আরো বলেন, “ফেনীর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিডির স্বেচ্ছাচারিতার লিখিত অভিযোগ রয়েছে। এসব ব্যাপারে ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক অবহিত হয়ে তদন্ত কর্মকর্তা পাঠিয়েছেন। তবে এখনো চূড়ান্ত প্রতিবেদন এখনো পাইনি।”
নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালক আরো বলেন, “নিয়োগ কর্তৃপক্ষের সভাপতি জেলা প্রশাসক ও সদস্য সচিব ডিডি। তাছাড় জেলা পর্যায়ে ৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি রয়েছে। যোগ্য প্রার্থী না থাকলে পুনরায় নিয়োগ প্রক্রিয়া করার কথা। এ ব্যাপারে ডিডির গাফিলতি রয়েছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে তাগিদ দেয়া হলেও সেটি সম্পন্ন হয়নি।”