সোলায়মান হাজারী ডালিম
আজ ৩ মে, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। জাতিসংঘ ঘোষিত এই দিনটি বিশ্বব্যাপী সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা এবং মুক্ত তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উদযাপিত হয়। এ দিবসটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কতটা অপরিহার্য। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে—বিশ্বের বহু দেশেই সাংবাদিকদের জীবনে নেমে এসেছে ভয়, নির্যাতন ও নিপীড়নের ছায়া। তারই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ আজকের ফেনী।
গত আট মাসে ফেনীতে যেসব সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো—প্রত্যেকটিতেই অভিযুক্তদের সঙ্গে বর্তমান সময়ের একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে এসেছে। এই ঘটনাগুলো শুধু একটি জেলার নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা পুরো দেশের সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও পেশাগত স্বাধীনতা নিয়ে এক গভীর প্রশ্ন তোলে।
আট মাসে সাংবাদিকদের ওপর লাগাতার হামলা
১. দৈনিক ইনকিলাবের ওমর ফারুকের ওপর হামলা হয় বালু মহালের সংবাদ প্রকাশের কারণে। এ ঘটনায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা জড়িত ছিল বলে জানা গেছে
২.দৈনিক ফেনীর সম্পাদক আরিফ রিজভী ও প্রতিবেদক তারেকের বিরুদ্ধে মামলা হয় মাদক সিন্ডিকেটের সংবাদ প্রকাশ করায়। এই ঘটনায় উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট—সাংবাদিকদের ভয় দেখানো
৩.সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে এনটিভির রাজন ও ফেনী সমাচারের কাওসারের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা চেয়েছিল, সংবাদ যেন বাইরে না যায়।
৪.গরু চুরির সংবাদ প্রকাশ করায় ছাগলনাইয়ার শেখ কামাল, সজীব ও সেপাল নাথের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এটি একটি পরিষ্কার বার্তা—সংবাদ লিখবে, শাস্তি পাবে।
৫. সর্বশেষ, চাঁদাবাজির খবর প্রকাশ করায় দৈনিক ফেনীর সময় পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক আরিফ আজম হত্যার হুমকি পেয়েছেন। এ হুমকি শুধু আরিফ আজমের বিরুদ্ধে নয়, এটি এক প্রকার হুঁশিয়ারি- ‘চুপ না থাকলে খেসারত দিতে হবে’।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফেনীর মহিপাল হতাহতের খবর সংগ্রহ পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন এবং দেশ রুপান্তর প্রতিনিধি শফি উল্যাহ রিপন এর মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দিয়েছেন।
বিগত দুই দশকেও ফেনীতে সাংবাদিক নির্যাতন: থামেনি হামলা-মামলার চক্র:
ভাটির এই জেলার সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতনের ইতিহাস দীর্ঘ এবং বেদনাদায়ক। শুধুমাত্র বর্তমান নয়, বরং বিগত দুই দশকজুড়েই সাংবাদিকরা বারবার নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা, প্রশাসনিক দুর্ব্যবহার এবং প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা যেন দিন দিন আরও ঘনীভূত হয়েছে।
আলোচিত গডফাদার জয়নাল হাজারীর শাসনামলে সাংবাদিক নির্যাতনের বিষয়টি সর্বজনবিদিত। সেই সময় ফেনীর সাংবাদিক টিপু সুলতান, মীর হোসেন মীরু এবং বখতেয়ার ইসলাম মুন্না গুরুতর শারীরিক নিপীড়নের শিকার হন। এদের মধ্যে টিপু সুলতানকে হত্যার উদ্দেশ্যে বর্বর হামলা চালানো হয়, যা দেশব্যাপী আলোড়ন তোলে। এছাড়া বাংলাভিশনের রিপোর্টার রফিকুল ইসলামকেও বিভিন্ন সময় শারীরিকভাবে হেনস্তা হতে হয়েছে। হামলার শিকার হয়েছেন দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রতিনিধি নাজমুল হক শামীম।
গেল সরকারের সময়েও সাংবাদিক নির্যাতনের ধারা থেমে থাকেনি। ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকারের নির্দেশে দায়ের হয় একের পর এক মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা। দৈনিক ফেনীর সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন, দৈনিক আমার দেশের প্রতিনিধি ইউসুফ, সময়ের আলোর মাইন উদ্দিন পাটোয়ারী এমনকি আমি নিজেও দেড় ডজন মিথ্যা মামলার ফাঁদে পড়েছিলাম। গেল সরকারের আমলে শুধু সাংবাদিক নির্যাতন করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, হামলা হয়েছে প্রেসক্লাবেও।
এছাড়াও ফেনীর আরও অনেক সাংবাদিক বিভিন্ন সময়ে হুমকি, হয়রানি, এমনকি আর্থিক এবং পেশাগতভাবে চাপে পড়েছেন, যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। যদিও সকলের নাম উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি, তবে প্রতিটি ঘটনার প্রতি তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
এই পরিস্থিতি দেশের গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। একটি স্বাধীন গণমাধ্যম ব্যতীত কোনো রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক হতে পারে না।
এই চিত্র শুধু ফেনীর নয়; বরং সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা ভয়ানক বাস্তবতার প্রতিফলন। গত এক বছরে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার, বরিশাল, রংপুর, এমনকি রাজধানী ঢাকাতেও সাংবাদিক নির্যাতনের বহু ঘটনা ঘটেছে। প্রভাবশালী অপরাধী চক্র, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের একটি অংশ সাংবাদিকদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে রাষ্ট্রের আয়না
সংবাদমাধ্যম রাষ্ট্রের আয়না—এই আয়নায় সমাজের অসঙ্গতি, দুর্নীতি, অবিচার ফুটে উঠে। তাই যখন সেই আয়না ভাঙার চেষ্টা হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে—কার স্বার্থে? কীসের ভয় থেকে?
আজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে দাঁড়িয়ে আমাদের চিন্তা করা উচিত—কেন সাংবাদিকরা এতটা অনিরাপদ? একটি পেশাদার রিপোর্টারের কাজ কীভাবে এতটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলো? একটি সংবাদ লিখে কেন তাকে হামলা, মামলা, হুমকি ও এমনকি প্রাণনাশের হুমকি সহ্য করতে হয়?
উত্তরটা স্পষ্ট—যেহেতু গণমাধ্যম দুর্নীতিবাজদের স্বার্থে আঘাত করে, তাই তারা চেষ্টা করে সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করে দিতে। কিন্তু যে সমাজে সত্য বলা যায় না, সেখানে উন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সেখানে গণতন্ত্রের শিকড় গজায় না, কেবল ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দেয়।
ফেনীতে দিবসটি পালনের তাৎপর্য
ইয়ুথ জার্নালিস্ট ফোরাম ফেনীতে প্রতিষ্টালগ্ন থেকেই দিবসটি পালন করছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই জনপদে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালনের তাৎপর্য এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি। কারণ, এখানে সাংবাদিকদের অধিকার আজ সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে। তাই এই দিনে শুধু প্রতীকী আলোচনা বা বর্ণাঢ্য র্যালি যথেষ্ট নয়; চাই একটি শক্ত বার্তা—”সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমরা এককাট্টা।”
স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও নাগরিক সমাজকে এই বার্তা গ্রহণ করতে হবে এবং প্রতিশ্রুতি দিতে হবে—সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। যারা সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালিয়েছে, মামলা দিয়েছে কিংবা হুমকি দিয়েছে—তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব
রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ সেই মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনেক সদস্যই এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেন না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা হামলাকারীদের রক্ষা করতেও দেখা যায়। এটি কেবল পেশাগত অবিচার নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার নামান্তর।
করণীয়
১. সাংবাদিক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন—শুধু আইন থাকলেই হবে না, কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
২. হামলার তদন্তে নিরপেক্ষতা ও দ্রত বিচার—অপরাধীদের রাজনৈতিক পরিচয় থাকলে যেন বিচার ব্যাহত না হয়।
৩. সাংবাদিক ইউনিয়ন ও সংগঠনগুলোর ঐক্য—পেশাগত স্বার্থে জাতীয় পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
৪. সচেতন নাগরিক সমাজের সম্পৃক্ততা—সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবস্থান স্পষ্ট হলে সরকার বা প্রশাসনকে জবাবদিহি করতে হয়।
আজকের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে ফেনীর সাংবাদিকদের কণ্ঠে একটি আকুতি—“আমরা সত্য বলি, কিন্তু সেই সত্য যেন আমাদের গলার কাঁটা না হয়।” সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়, এটি সমাজের জন্য একটি অপরিহার্য সেবা। তাই সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই হবে এই দিবসের প্রকৃত সফলতা।
আজকের দিনে আমাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা হোক—আমরা কোনো সাংবাদিককে একা পড়তে দেব না। আমরা সত্যের পক্ষে, সাংবাদিকতার পক্ষে, মুক্ত গণমাধ্যমের পক্ষে। কারণ, যেখানে সাংবাদিকতা বিপন্ন, সেখানে মানুষের অধিকারও বিপন্ন।
লেখক : রিপোর্টার, এখন টেলিভিশন ।