নোয়াখালী প্রতিনিধি :
টিকটকের অপসংস্কৃতির ছোবলে মারজাহান আক্তার রিক্তা নামে তরুনীর আত্মহত্যার পর তার ৮মাসের শিশু ফারাবীর কি হবে এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভা ৭নং ওয়ার্ড ওয়াজ উদ্দিন ব্যাপারী বাড়ীর আবু নাছেরের মেয়ে গত ২০ অক্টোবর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। আত্মহত্যার প্ররোচনায় মামলা হওয়ার পর এ প্রতিবেদক অনুসন্ধানে নামলে বেরিয়ে আসে লোমহর্ষক নানা কাহিনী। এ প্রতিবেদকের হাতে আসে অশ্লীল ছবি, ভিডিও, অডিওসহ টিকটকের নানা রঙ্গিন অপসংস্কৃতির চিত্র। অনৈতিক উচ্ছৃঙ্খল জীবন আচার থেকে ভয়াবহ টিকটকার হয়ে ওঠে তরুনী রিক্তা। এরই কুফলে একাধিক স্বামী পরিবর্তন করে রিক্তা। সামাজিক ভাবে বিয়ে দেয়া হয়েছিল তাকে উপজেলার মুছাপুরের মঞ্জু নামের এক যুবকের কাছে। বিয়ের পর টিকটকে পরিচয় হয় লক্ষ্মীপুর জেলার চন্দ্রগঞ্জ পশ্চিম লতিফপুর গ্রামের আরেক টিকটকার ফয়সল মাহমুদের সাথে। টিকটকার ফয়সলের প্রলুব্ধ ও প্ররোচনায় পড়ে স্বামী মঞ্জুর সাথে রিক্তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।

এরই মধ্যে পরিবারের অমতে পালিয়ে গিয়ে টিকটকার রিক্তা ও ফয়সল মাহমুদ বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়। টিকটকার রিক্তার ২য় স্বামী ফয়সাল মাহমুদ তার স্ত্রী রিক্তাকে দিয়ে টিকটকের মাধ্যমের প্রবাসীদের সাথে প্রতারণা করে আয়ের পথ বেছে নেয়। একই সাথে রিক্তার সাবেক স্বামী মঞ্জুর কাছ থেকে পাওয়া দেনমোহরের ৫লাখ টাকা ফয়সালকে দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। এতে রিক্তা সায় না দেয়ায় তার জীবন হয়ে যায় দুর্বিসহ। স্বামী ফয়সাল, শাশুড়ি তাসলিমা ও ননদ পিংকির অত্যাচারে নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে রিক্তা। এরই মধ্যে বিকল্প পথ বেছে নিয়ে নরসিংদী জেলার দুবাই প্রবাসী ইমনের সাথে টিকটকে সম্পর্ক গড়ে রঙ্গিন স্বপ্নে বিভোর হয় সে। এটা জানাজানি হলে রিক্তার জীবনে নেমে আসে আরো ভয়ঙ্কর নির্যাতন। স্বামী ফয়সালের পরিবারের সদস্যদের অবর্ণনীয় নির্যাতনে টিকটকে পরিচিত প্রবাসী ইমনের সাথে রিক্তার সম্পর্ক আরও গভীর থেকে গভীরতর রূপ লাভ করে।

এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, প্রবাসী ইমনের মামা সম্পর্কিয় হাবিবুর রহমান নামে এক ব্যাক্তির সাথে রিক্তার কথোপকথনে তিনি বলছেন, টিকটকার রিক্তা ফয়সালকে স্বামী হিসেবে আর মানতে রাজি নয়। টিকটকার প্রবাসী ইমনকেই সে জীবন সঙ্গী করতে চায়। এখানে বাঁধসাধে শিশু ফারাবি। রিক্তার সাথে হাবিবের কথোপকথনে বুঝা যায়, ইমনের বাবা সন্তানসহ রিক্তাকে মেনে নিতে অপারগ। ইমনের বাবার সু-স্পষ্ট বক্তব্য সন্তানসহ ইমনের স্ত্রী হিসেবে রিক্তাকে ঘরে উঠানো সম্ভব নয়। কিন্তু রিক্তার পাল্টা জবাবে বুঝা যায়, ইমন সন্তানসহই রিক্তাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে তার অসুবিধা নেই। রিক্তার শিশু সন্তান ফারাবির জন্মের পূর্বেই নামটি রেখেছিল, ইমন। স্বামী না হয়েও প্রতি মাসে রিক্তার হাত খরচের জন্য হাজার হাজার পাঠাতো ইমন। টিকটকার রিক্তার সন্তান ফারাবিসহ ইমনের সংসার গড়ায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ইমনের বাবা। এরই মধ্যে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে রিক্তা লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ থেকে তার স্বামী ফয়সাল মাহমুদসহ বসুরহাটে বাবার বাড়িতে আসে। ফয়সাল দুইদিন থাকার পর শ্বশুর বাড়ী থেকে নিজ বাড়ীতে চলে যায়।
গত ২০ অক্টোবর বেলা সাড়ে ১১টায় বাবার বাড়ির একটি কক্ষে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে রিক্তা। সংবাদ পেয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে, জব্দ করে রিক্তার ব্যবহৃত মুঠোফোন। এ ঘটনায় রিক্তার বাবা আবু নাছের বাদী হয়ে স্বামী ফয়সাল মাহমুদ, শ্বাশুড়ী তাছলিমা বেগম ও ননদ পিংকিকে আসামী করে একটি আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা করে। রিক্তার স্বামী ফয়সাল মাহমুদকে ২১ অক্টোবর রাতে তার গ্রামের বাড়ী থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়।
গলায় ফাঁস দেয়ার আগে রিক্তার দুই মিনিট ৪৮ সেকেন্ডের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে নানা জনের মুঠোফোনে। ওই ভিডিওতে তার মৃত্যুর জন্য স্বামী ফয়সাল মাহমুদ, শ্বাশুড়ি তাসলিমা বেগম এবং ননদ পিংকিকে দায়ী করে। মা-বাবাকে আকুতি করে রিক্তা জানায়, তারা যেন তার ঔরসজাত শিশু ছেলে ফারাবী ইসলামকে তার বাবা ফয়সালকে না দেয়। নানার বাড়িতেই যেন শিশু ফারাবীর আশ্রয় হয়।
গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আত্মহত্যাকারী রিক্তার বাবা প্রবাস ফেরত আবু নাছের ও রিক্তার মা, বোন, ভগ্নিপতিসহ স্বজনরা শোকে বিহ্বল। ফুটফুটে দুধের শিশু ফারাবি এ কোল থেকে সেকোল যাচ্ছে, মুখে হাসি ফুটলেও চেহারায় তার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিত্র দেখা গেছে। বীভৎস অপমৃত্যুর ঘটনাটি কোম্পানীগঞ্জবাসীকে নাড়া দিয়েছে সর্বতোভাবে।
সমাজ বিশ্লেষক, সমাজবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদসহ সকলকে ভাবিয়ে তুলেছে স্মার্টফোনের অপব্যবহারের কালো অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে সকলেরই এ ধরনের প্রগাড় অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে গণমাধ্যম কর্মীদের অনুসন্ধানে। জৈতুন নাহার কাদের মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক নিগাত সুলতানা এবং মানিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরিদা ইয়াছমিন মুক্তা বলেন, টিকটকারেরা নানা রঙ্গিন স্বপ্ন বিভোর থাকে, এরা অন্যদেরকেও এ ধরনের অপসংস্কৃতির স্বপ্ন দেখাতে প্রভাবিত করে। তারা দু’জনই বলেন, টিকটকারেরা স্বপ্ল সময়ে সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে চায়। এ জনপ্রিয়তা পেতে গিয়ে টিকটকরেরা অশ্লীলতায় মেতে ওঠে নিজেদের বিপদগামী করে। এরই পরিনতিতে আত্মহনন, বিবাহ বিচ্ছেদ, পরকীয়াসহ নানা সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। এজন্য সকল অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্মার্টফোনের অপব্যহার রোধে সর্তক থাকতে হবে।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি প্রণব চৌধুরী বলেন, টিকটকের অশুভ আশক্তির কারণে এ আত্মহত্যাটি ঘটনাটি ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে আমরা গভীর তদন্ত করছি।