-নাসির উদ্দিন বাহার
২৬ মার্চ বাঙ্গালীর মহান স্বাধীনতা দিবস। নির্যাতন নিপিড়নের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করে আত্মত্যাগের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে বাঙালীর। তারই পথ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ১৯৭১ এর মার্চে পুরোজাতি একটি বিন্দুতে এসে মিলে যার নাম স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো”। তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রæর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তা ঘাট যা যা আছে আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমারা বদ্ধ করে দেবে’’। সে নির্দেশ মোতাবেক আজ থেকে ৫০ বছর আগে মুক্তি যোদ্ধারাই শিখিয়েছিলেন এগিয়ে চলার মন্ত্র, দেখিয়ে ছিলেন ভবিষ্যতের স্বপ্ন। স্বপটি ছিল সমষ্টিগত, যেটি কোন এক বিশেষ দিনে শুরু হয়নি। স্বপ্নটি ছিল দীর্ঘ সময়ের। যেটি আমরা ব্রিটিশ শাসনে দেখেছি পাকিস্তান আমলেই দেখেছি। পাকিস্তানী হানাদারও তাদের দোসরেরা ওই স্বপ্নের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তারা মানুষ হত্যা করেছে, কেননা মানুষ স্বপ্ন দেখেছে মুক্তির এবং সেই স্বপ্নের জন্য লড়াইটাকে ক্রমাগত তীব্র করে তুলছে। আপোষ করতে রাজি হয়নি। স্বপ্নটা আসলে কিসের? সেটা ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সাম্য ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার।
১৯৪৮ ও ১৯৫২ভাষা আন্দোলনের সাংস্কৃতিক পাটাতনের ওপর নবধারার ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগ্রামের সূত্রপাত। এরই ধারাবাহিকতায় ২৩ বছর ধরে চলে উপনিবেশ বিরোধী, সামরিক শাসন বিরোধী জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম। ১৯৬২ এ দেশ ও কৃষ্টি শীর্ষক পাঠ্য বইয়ে বাঙালী জাতিসত্তাবিরোধী তথ্য অন্তভূক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ভিত্তিক পূর্ববাংলার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের আন্দোলন বাঙালী স্বাধিকার সংগ্রামকে গুনগত রাজনৈতিক পরিবর্তনের স্তরে উন্নীত করে। এই আন্দোলনে পাকিস্তানী সরকার বঙ্গবন্ধুকে শুধু গ্রেফতার করে ক্ষান্ত হয়নি- আগর তলা স্বড়যন্ত্র মামলায় তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিত অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। তাকে মুক্ত করার দুর্বার আন্দেলনকে জনগণ ১৯৬৯ এর গণঅভূথানে পরিণত করে। গণঅভূত্থানে মুক্ত শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হয়ে পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত রাজনৈতিক নেতার মর্যদা লাভ করেন। এই অভ্যূত্থান ছিল বাঙালীর মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের ড্রেস রিহার্সসাল স্বরূপ।
১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয়ের পরও বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি পাকিস্তানী স্বৈরশাসকেরা। ফলে পূর্ব বাংলার সঙ্গে সাত কোটি মানুষের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে ও তিনি ক্ষমতা পাননি, ফলে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসকি ভাষণে বলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এ-অনন্য ভাষনে তিনি মুক্তির সংগ্রামের জন্য গেরিলা যুদ্ধের রুপরেখাও নির্দেশ করে দেন, বঙ্গন্ধুর দিক নির্দেশনা ও তার বিশ্বস্ত সহযোগী তাজউদ্দিন আহম্মেদ ও অন্যান্যদের নেতৃত্বে মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাঙালীর হাজার বছরের স্বপ্নের সংগ্রামের সাধনার গণতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক সাম্যমূলক অর্থনৈতিক আদর্শ ভিত্তিক ধর্ম নিরপেক্ষ জাতি রাষ্ট্র। পাকিস্তানি বন্দী শিবির থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে ১৯৭১ এর ১০ই জানুয়ারী বঙ্গঁবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানে দেয়া ঐতিহাসিব ভাষনে বলেন ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে- আর তার ভিত্তি কোন বিশেষ ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না, রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা। এদেশের কৃষক শ্রমিক হিন্দু মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে’ এর আগে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করবে।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্রে ও স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতার পরে রাষ্ট্রনীতি হিসাবে গৃহিত হয় এবং সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে- ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন বা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এমন এক রাষ্ট্র গঠন ও সংবিধানে রচনা হাজার বছরের শ্রেষ্ট্র বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিচয় ফুটে উঠে। কিন্তু বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাস এবং মধ্যযুগের ভারতবর্ষের মুসলীম শাসকদের রাষ্ট্র ও ধর্মনীতির ইতিহাস সম্পর্কে অভিজ্ঞতা এবং আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রবোধের প্রশ্চাতপদতার জন্য স্বৈরশাসক জিয়া এরশাদ এবং পাকিস্তানের গোপন দোষর মোস্তাক ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা মিলে বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নের জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশের মূল শ্রষ্টা শেখ মুজিবকে শুধু হত্যা করেননি, রাষ্ট্রের মূল নীতি পরিবর্তন করে একে একটি পাকিস্তানী ধাচের ধর্মপ্রবন পশ্চাৎপদ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। এর বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশকে দুঃশাষন সামরিক ও ছদ্দসামরিক স্বৈরাচারের মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত করা হয় ফলে ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তি নানা প্রতিকূলতায় বিপন্ন- আর ধর্মীয় জঙ্গীবাদ ধর্মান্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি জিয়ার দলের সঙ্গে জোট বেঁধে বাংলাদেশ দাঁপিয়ে বেড়াতে থাকে। স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার ও আলবদর বাহিনী মূল হোতাদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে বাংলাদের পতাকা উড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়। জিয়া যেখানে গোপনে স্বাধীনতা বিরোধী জামাতকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন, স্বাধীনতা বিরোধী শাহআজীজ কে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন, গোলাম আজমকে নাগরিকত্ত¡ দিয়েছেন, বদর বাহিনীর প্রধান ও বুদ্ধিজিবী হত্যার মাস্টারম্যান মতিউর নিজামি ও আলী আহসান মুজাহিদীকে মন্ত্রীত্ব দিয়েছেন, তাদের সঙ্গে জোট বেধে দেন এবং জিয়া তারেক রহমান বলেছেন ‘বিএনপি জামাত একই পরিবারের সদস্য’।
এই সূত্রেই ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল সত্ত¡া বিরোধী একটি শক্তিশালী চক্র নানা চক্রান্তে ও ষড়যন্ত্র জালের ছক ফেলে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত জণগণের এই রাষ্ট্রটিকে তার জন্ম ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিপথে বিকশিত হতে দেয়নি। আর এর জন্যই বিস্তার ঘটে দুর্বত্তায়ন- দুঃশাসন আর স্বৈরাচার ও জঙ্গিবাদ। বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দিন আহম্মেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজামান সহ বহু দেশপ্রেমিকে প্রাণ নিয়েও রাষ্ট্র শক্তির গোপন কুঠুরিতে স্থায়ী আসন পাতা দুষ্টচক্র তথা ধর্ম ব্যবসায়ী ও উগ্র ধর্মীয় জঙ্গিবাদ ও তাদের মমদদাতারা বাংলাদেশকে চক্রান্ত ষড়ডন্ত্রের বৃত্ত ভেঙ্গে বের হতে দিচ্ছে না। তবুও বঙ্গবন্ধু কণ্যা শেখ হাসিনা ১৭ই মে স্বদেশে ফেরা বাংলাদেশের মাটিতে নুতন যুগের সূচনা করে। বঙ্গবন্ধুবিহীন তারই কণ্যাকে অভ্যর্থনা জানাতে সেদিন বিমান বন্দরে এসে জড় হয়েছিল সর্বস্তরের লাখো মানুষ, যে মানুষ জাতির পিতার ধমনী বহনকারীকে স্বাগত জানিয়েছে-যে মানুষ সেনাপতি শাসন থেকে মুক্তি- যে মানুষ মনে প্রাণে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে মূল্যবোধ ও চেতনার পুনঃ প্রতিষ্ঠা চেয়েছে। যেহেতু শেখহাসিনার স্বদেশ ফেরার মধ্যে বাংলাদেশের ইতিহানের আরেক অভিযাত্র আছে, অনেক বেদনার মাঝেও আরেক বিজয় আছে বঙ্গবন্ধুর ১০১ তম জন্ম শতবার্ষিকি ও স্বাধীনতার ৫০ বছরে সুবর্ণজয়ন্তীতে, এসময় হৃদয় আশা ও নিরাশার দৌলাচলে আবতির্ত হচ্ছে। যে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি কিসিঞ্জার তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যায়িত করেছিল সে দেশ অর্ধশত বর্ষে স্বল্প উন্নত দশে থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হয়েছে, সামাজিক সূচকেও উন্নতি করেছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ, বিদ্যুৎ ঘাটতির দেশ থেকে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত দেশে উত্তরন, জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ এবং সব শেষে করোনা সংক্রমণ রোধে সাফল্য আমাদের মধ্যে আশাবাদ জাগ্রত করে। অন্যদিকে সর্বস্তরের দুর্নিতি ও সাম্পদায়িকতার বিস্তার রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, ধনবৈষম্য এবং মুক্ত চিন্তার ক্ষেত্রে সংকোচন আমাদের নৈরাশ্যবাদী করে তুলেছে।
মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তিতে সমগ্র জাতির প্রত্যাশা, রাষ্ট্র ও সমাজ এর সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা অতিক্রম করবে। এক্ষত্রে ভরসার জায়গাটি বাংলাদেশের তরুন সমাজ, তারাই বাংলাদেশের অগ্রগতির চালিকা শক্তি, তারা তথ্য প্রযুক্তির সর্বোতম ব্যবহার করে বিশে^র সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে। জাতির প্রত্যাশা তারা যে আধুনিক বাংলাদেশ গড়বে সেখানে সামাজিক বৈষম্য, সম্প্রদায়িকতার স্থান থাকবে না, মুক্ত চিন্তা বিকশিত হবে, জয় বাংলা।
লেখক : সিনিয়র সহ-সভাপতি
সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামীলীগ।