বিজয় দিবসের কথা বলতে হলে আমদের অতীত ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখতে হয়। আমাদের রয়েছে রক্তাক্ত গৌরবোজ্জ্বল পরিচয়। এই ‘বিজয়’ শব্দটির সাথে আমাদের অস্তিত্বের সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে।
আমরা জাতিতে বাঙ্গালি। বিশ্বে এই জাতির রয়েছে গর্বিত আত্মপরিচয়। বাঙ্গালির রয়েছে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বাঙ্গালি ছিল সোচ্চার। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট (পশ্চিম ও পূর্ব )পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র জন্মলাভ করার পর থেকে বাঙ্গালিরা (তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের জনগণ) বিভিন্ন কারণে প্রতিবাদী হতে বাধ্য হয়ে ছিল। পশ্চিমপাকিস্তানের বিমাতা সুলভ আচরণ যতোই দৃশ্যমান হয়েছিল ক্রমে প্রতিবাদের শক্তি মানুষের মনে সুদৃঢ় হয়েছিল। ধারাবাহিকভাবে পূর্বপাকিস্তানের জনমতকে উপেক্ষা করে, অবমূল্যায়নের মধ্যদিয়ে শাসকশ্রেণি ধীরেধীরে শোষকের ভূমিকায় গিয়ে উপনীত হয়েছিল। ক্ষমতা পুজারী পাকিস্তান সরকারের এরূপ অন্যায় ও পক্ষপাতদুষ্ট শাসননীতির কারণে অধিকার বঞ্চিত জনতা সময়ের বিবর্তনে সংঘটিত হয়ে সময়োচিত জবাব দিতে পিছপা হয় নি। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণ অভ্যুত্থান ও ৭১’র চূড়ান্ত মুক্তির সংগ্রামে বীরবাঙ্গালি আপোষহীন ভূমিকা রেখেছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। মুক্তিকামী জনতার সেই ঐক্যবদ্ধ ও ন্যায্য আন্দোলন পাকিস্তান সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দুর্বার গতিতে সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। শোষণ বিরোধী আন্দোলনের প্রতিটি পর্বে একটু একটু করে সাফল্য অর্জন করে সাহস ও শক্তি সঞ্চয় করেছিল সংগ্রামী জনতা।
প্রথমে এই আন্দোলন ছিল মাতৃভাষাকে রক্ষার আন্দোলন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই আমাদের মাতৃভাষার উপর তারা নগ্ন হস্তক্ষেপ করেছিল। তারা আমাদের মায়ের ভাষা কেড়ে নিয়ে সারা জীবনের মতো কৃতদাস বানিয়ে রাখার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল। কায়দে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দিয়েছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। মুহূর্তে ছাত্র-জনতা তার সামনেই সেদিন না না বলে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছিল।
১৯৪৮ সালে জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য স্মারকলিপি দেয়। তখন থেকে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিতে শুরু করে। এ আন্দোলনের পরিক্রমায় ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম,বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউল প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন বাঙ্গালি ভীতু নয়। পাকিস্তানীরাও বুঝতে পেরেছে বাঙ্গালিদের এতো সহজে দমানো যাবে না। ভাষা আন্দোলনে জয় হলো বাংলাভাষা বাসীদের। বাঙ্গালির প্রথম আন্দোলন সফল হলো। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলা ও বাঙ্গালি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি অর্জন করলো। বাঙ্গালিচিত্তে আরো মনোবল বৃদ্ধি পেলো। ভাষাশহীদদের পবিত্র রক্ত বীরবাঙ্গালিদের স্বাধীনতার স্বপ্নে সেদিন বিভোর করে তুলে ছিল।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সফল হওয়ার পর ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল আমাদের ছাত্রজনতা। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য একটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। সেই মোতাবেক তিনি ১৯৫৯ সালের ৫ জানুয়ারি কমিশনের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের সচিব এবং আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক এস এম শরিফকে চেয়ারম্যান করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছয়জন এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে চারজন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় এই কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যানের নামানুসারে এটির নামকরণ হয় ‘শরিফ কমিশন’।
১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট অন্তর্বতীকালীন প্রতিবেদন হিসেবে এই কমিশনের সুপারিশগুলো প্রেসিডেন্টের কাছে দাখিল করা হয়, যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। কমিশনের সুপারিশে অবৈতনিক শিক্ষার ধারণাকে অবাস্তব কল্পনা করে পরিহাস করা হয় এবং সর্বজনীন শিক্ষার গণদাবিকে নির্বিচারে ব্যঙ্গ করা হয়। স্বৈরাচার আইয়ুব সরকার কর্তৃক ঘোষিত এই অগণতান্ত্রিক ‘শরিফ কমিশন’ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সারা বাংলার ছাত্রসমাজ সেদিন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এতে বেশ কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল। ছাত্রজনতার প্রতিবাদের মুখে আইয়ুব খান সেসময় ‘শরিফ কমিশন’ স্থগিত করতে বাধ্য হয়। ১৯৬৬ সালে উত্থাপিত ছয়দফা দাবি মহান মুক্তিযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “৬ দফা দাবি” পেশ করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা উত্থাপন করা হয় ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাবের সাথে মিল রেখে। ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য- পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র এবং ছয় দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে এই ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। ছয়দফা কর্মসূচীর ভিত্তি ছিল ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। পরবর্তীকালে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার করা হয়। বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে একে ম্যাগনা কার্টা বা বাঙালির মুক্তির সনদ বলা হয়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান যুগান্তকারী মাইলফলক হিসেবে কাজ করেছে। এইসময় আইয়ুব খান বিরোধী গণঅভ্যুত্থান আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেয়। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পর ৭০ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসে। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা দাবী পূর্ব বাংলার মানুষ মনেপ্রাণে গ্রহণ করে। পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠিতা অর্জন করে। কাজেই স্বাভাবিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ সরকার গঠন করে পাকিস্তান শাসন করবেন। কিন্তু সেনা শাসক ইয়াহিয়া খান তা করতে দিলেন না। বঙ্গবন্ধু আন্দোলন অব্যাহত রাখলেন। ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ভুট্টোর সঙ্গে আতাত করে ইয়াহিয়া খান পূর্ব বাংলার ঘুমন্ত বাঙ্গালির উপর ২৫ মার্চ কালরাতে হত্যা-নির্যাতন শুরু করে। তার আগেই ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে তার অমর ভাষণে জাতিকে নির্দেশনা দিয়ে স্বাধীনতার পথকে সুগম করলেন। তারই প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ আন্দোলনকামী বাংলার মানুষের উপর পাকিস্তান সরকারকর্তৃক লেলিয়ে দেয়া পাকিস্তানী মিলিটারি হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তখন থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের পর থেকে মাত্র ৯ মাসে বাংলার দামাল ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করে। লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আমরা আমাদের বিজয় পতাকা ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হই। তাই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, মুক্তির দিবস। বিজয় দিবস আসলে আমাদের ভাবনা হৃদয়ে উঁকি দিতে থাকে। কেন আমরা যুদ্ধ করেছি? ত্রিশলাখ মানুষ জীবন দিল কেন? আমরা কী চেয়েছি ? আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমন্বয় হয়েছে কী?
আমাদের যুদ্ধ, সংগ্রাম, ত্যাগ নানাবিধ প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হয়েছিল। তম্ম্যধে উল্লেখযোগ্য হলো গণতন্ত্র ও গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা। ১৯৭০ সালে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩০০ আসেনর মধ্যে ১৬২ আসেনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পরও ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তান সরকার গণতন্ত্রকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে স্বৈরশাসন কায়েম করে। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল আমাদের প্রবল প্রতিবাদ, সংগ্রাম এবং সব শেষে মুক্তিযুদ্ধ। মূলত গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মানোভাব থেকেই সংগঠিত হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কবল থেকে গণতন্ত্রকে উদ্ধার করার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। অনেক ত্যাগ ও জীবনের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন দেশের মানচিত্র লাভ করলাম। গণতন্ত্র মুক্তি পেল। আজ আমাদের দেশ স্বাধীন, আমাদের স্বাধীন জাতি, আমাদের স্বাধীন জাতীয় সংসদ রয়েছে। আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কর্তৃক আমাদের দেশ পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু প্রকৃত বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সর্বস্তরে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি কী ? বিজয় দিবসে এই ভাবনা আমাদের মনকে বারবার বিচলিত করে তোলে। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছি। বিশ্বদরবারে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বলেইতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জন। আমরা জানি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেছিল। দীর্ঘসময় ধরে এই বৈষম্যের ফলে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পিছিয়ে পড়েছিল। অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফলে পূর্বপাকিস্তানের মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্র হচ্ছিল। নানাভাবে শোষণের ফলে আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ছিল অকল্পনীয়। তাই অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমাদের জীবনযু্দ্ধূ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল।
দু:খের বিষয় হলো এখন স্বাধীন দেশেও আমরা চরম ভাবে রাজনৈতিক -অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার। রক্তে অর্জিত স্বাধীনদেশেও আমাদের মাঝে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলছে। এখনো বহু মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। বড়রা আরও বড় হচ্ছে, ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। দুর্নীতির মাধ্যমে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা সম্পদের পাহাড় গড়ছে। দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করেছে।ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশের স্বার্থবিরোধী কাজে করেই যাচ্ছে একশ্রেণী গোষ্ঠী। রাষ্ট্রের সর্বত্র স্বেচ্ছাচারিতার মহোৎসব ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে। দোষারোপের রাজনীতি, ঘাতপ্রতিঘাত ও প্রতিহিংসার মনোবৃত্তি আমাদেরকে বিজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে দিচ্ছে না। একই কারণে বাঙ্গালিরা আজ অবধি জাতিগত ভাবে জাতীয়স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে নি। অথচ বহুজাতিক ঐক্যের মেলবন্ধনে গড়ে উঠেছিল আমাদের মুক্তিবাহিনী। আর এই বহু জাতিক ঐক্যের শক্তিতেই আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছি। দুঃখের বিষয় হলো এই যে, স্বাধীনদেশেই আমরা এখন অনেকাংশে পরাধীন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হায়নারা আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছিল। তা এখনো হাজার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিনিয়তই শিশুকন্যাসহ সকলস্তরের নারী দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষিত হচ্ছে। হচ্ছে নির্মমভাবে খুনের শিকার। গুপ্ত হত্যা,গুম,অপহরণ,নারীপাচার, শিশুপাচার, দুর্নীতি, লুটপাট, ভিন্নমত দমনের সংস্কৃতি এসব কিছু বিজয়ের সকল অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, গণতান্ত্রিক অধিকার তথা ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমরা রণাঙ্গনে লড়াই করেছিলাম। দুঃখজনক ভাবে জাতি আজ সেই ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে আছে। যে কোন মুহূর্তে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের আশঙ্কায় জাতি শঙ্কিত। তাহলে কী প্রশ্ন দাঁড়ায় না, এই জন্যই কী আমরা রক্তসাগর পাড়ি দিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করেছি? আর এটাই কী বিজয়ের কৃতিত্ব। আমরা জানি, বিজয় নেতৃত্বের মুকুট। আমাদের নেতৃবৃন্দের ত্রুটিপূর্ণ নেতৃত্বের কারণে বিজয়ী জাতি আজ অবধি সত্যিকারার্থে বিজয়ের মুকুট ধারণ করতে পারেনি। একই কারণে বিজয়ের ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা বিজয়ের আদর্শ এখনো রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে পারি নি। কারণ আমরা মনের দিক থেকে বড় হয়ে উঠতে পারিনি। আমাদের মনের দিক থেকে আরও উন্নত হতে হবে। মুক্তির সংগ্রামের কিছু প্রতিশ্রুতি ছিল। আমাদের জাতীয়নেতৃবৃন্দ, যারা এই সুদীর্ঘ সময় ধরে আমাদের জাতি ও রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তারা এই প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। স্বৈরাচারী পাকিস্তানি সরকারের শোষণ থেকে পূর্ববাংলার গণমানুষকে মুক্ত করে তাদের মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত কারাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য। মুক্তিযুদ্ধ হলো, আমরা স্বাধীন হলাম, বিজয় অর্জন করলাম। এর ফলে বিশ্বে বাঙ্গালিরা স্বাধীন জাতি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, পেয়েছে লালসবুজের পতাকা, নির্দিষ্ট ভূখন্ড ও সার্বভৌমত্ব।
স্বাধীনতার আগে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা চিকিৎসা,চাকুরী,ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের (পূর্বপাকিস্তান) মানুষ পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক চরম বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। সে বৈষম্যের শিকল ভেঙে সমতার বাংলাদেশ গড়তে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের ত্রিশলাখ মানুষ, দুই লাখ মা- বোন হারিয়েছেন তাদের সম্ভ্রম। কিন্তু সে বৈষম্য নির্মূলতো হয়নি বরং স্বাধীন দেশে গত তিপ্পান্ন বছর ধরে তা যেন বেড়েছে বহুগুণ। শিক্ষার অধিকার অধিকার সবার সমান হওয়ার কথা থাকলেও দেশে এখন ধনীদের জন্য একধরণের শিক্ষাব্যবস্থা আর সাধারণ মানুষের সন্তানদের গিনিপিগ বানিয়ে চলছে এক্সপেরিমেন্টাল অন্য এক শিক্ষাব্যবাস্থা।
স্বাস্থ্যব্যবস্থা এতটা বাণিজ্যিকি করণ করা হয়েছে যে,সমাজের বিপুল সংখ্যক মানুষ যেখানে টাকার অভাবে চিকিৎসা নিতে পারে না, সেখানে একশ্রেণির মানুষ সামান্য জ্বর,সর্দি, কাশি হলে চলে যায় প্রতিবেশী দেশে –— ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া।
দেশে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে দামী গাড়ির আমদানি। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ যেখানে চরম দারিদ্র্যসীমার বসবাস করছে সেখানে একশ্রেণির মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়েছে। রাজধানী ঢাকায় যেখানে ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বসবাস করছে সেখানে চলছে বিলাসবহুল এপার্টমেন্ট কেনা বেছা। গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের ধনীদের বিদেশে বাড়ি কেনার হিড়িক পড়েছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবাহ বেড়েছে। ধন্যাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ, সেইসাথে বেড়েছে পাঁচতারকা মানের হাসপাতাল ক্লিনিক, বেড়েছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজ। এসবের নেপথ্যে রয়েছে একশ্রেণির ধনী মানুষ। আর এর বড় অংশই ধনী হয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতির আর অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে। এবং কি টাকা কিংবা রাজনৈতিক – প্রশাসনিক শেল্টার যাদের আছে আইন ও যেন ঠিক তাদের পকেটে থাকে।
যে রাজনীতি গণমানুষের মুক্তির প্লাটফর্ম হওয়ার কথা সে রাজনীতিও দিনে দিনে চলে গেছে বিত্তবান ও প্রভাবশালীদের দখলে। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে নব্বইয়ে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের পতনের পর দেশ যখন গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে আরম্ভ করলো, ঠিক তখনই আবার বাংলাদেশ যাত্রা পথে হোঁচট খেলো। নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রথা ভেঙে দিয়ে দেশে কায়েম করছে ফ্যাসিবাদি শাসনব্যবস্থা।
মানুষের মৌলিক অধিকার যেখানে ভূলুণ্ঠিত, এমন এক বাস্তবতায় দেশে নতুন একটি বিপ্লব অনিবার্য হয়ে পড়ে ছিল বলেই কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে ছাত্র জনতার হাত ধরে জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। রাজপথে প্রায় দুই হাজার নিরীহ ছাত্রের জীবন কেড়ে নিয়েছে ফ্যাসিবাদের বুলেট। ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের নৃশংস দমন, নিপীড়নে পঞ্চাশ সহস্রের অধিক আন্দোলনকারী, পথচারী, রিক্সাশ্রমিক, সাধারণ জনতা অঙ্গ হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছে। কেউ কেউ মৃত্যুর সাথে এখনো পাঞ্জা লড়ছে।
স্বাধীন দেশের রাজপথে জীবন দিয়ে রক্ত দিয়ে এভাবে দ্বিতীয় বার বিজয় ছিনিয়ে আনবার ইতিহাস পৃথিবীতে দুর্লভ। একটানা যোল বছরের ফ্যাসিবাদী অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অবজ্ঞা, ফ্যাসিশক্তিসহ সর্বগ্রাসী বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনতার গণঅভ্যুত্থান, যাত্রা শুরু হলো নতুন এক বাংলাদেশের। আর এই বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রধানতম দায়িত্ব হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর। কেবল প্রতিশ্রুতিশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাজনৈতিক একতা, রাজনৈতিক ঐক্যই পারে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে। দেশপ্রেমে উল্লাসিত হয়ে সংকীর্ণ দলীয়স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ছাত্রজনতার বিল্পবের চেতনার সাথে সংহতি প্রকাশ করে গড়ে তুলতে হবে স্বপ্নের আগামীর বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে বড় দলগুলোর রয়েছে গুরু দায়িত্ব। কাউকে বড় কাউকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। দেশ গড়ার প্রত্যয়ে সবাইকে নিয়ে সমান এগিয়ে যেতে হবে। প্রতিহিংসা ও দলীয়স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে আমরা একাজ যদি করতে পারি কেবল তাহলেই শহীদের রক্ত ও আত্মদান সফল হবে।
এই অমূল্য প্রাপ্তি ও ত্রিশলক্ষ শহীদের অমরাত্মার প্রতি সম্মান রেখে সবে মিলে দেশটাকে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। নতুন প্রজন্মের হাতে এমন দেশ উপহার দিতে হবে, যা হবে তাদের স্বপ্নের নিরাপদ বাসস্থান। আগামীর বাংলাদেশেকে এগিয়ে নিতে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জুলাই বিপ্লবের আদর্শে আলোকিত রাষ্ট্র নতুন প্রজন্মের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। যার ভিত্তি হবে মেধাবী, সৎ ও দুর্নীতি মুক্ত নেতৃত্ব। কিন্ত, ভয় ও শঙ্কা জাগে মনে, সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে বাংলাদেশ কি পারবে ঐক্যের পথে হাঁটতে? বাংলাদেশ কি পারবে বিপ্লবের চেতনা ধারণ করতে? বাংলাদশ কি পারবে বিজয়ের কাঙ্খিত সুফল অর্জন করতে?
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, কবি ও প্রাবন্ধিক।