নাজমুল হক :
রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রবর্তিত সরকারি কর্মচারীদের পেশাগত দক্ষতা, সততা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে পুরস্কার প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর প্রাক্তন প্রধান বেনজির আহমেদ নীতি নৈতিকতার ২০২০-২১ সালে জাতীয় শুদ্ধাচার পদক পেয়েছেন। ২০২৪ সালে বেনজির এবং তার স্ত্রী ও সন্তানের বিরুদ্ধে দুনীতি দমন কমিশন হাজার কোটি টাকার দুনীতির মামলা করেছে। সরকারের জাতীয় শুদ্ধাচার বাস্তবায়ন কমিটি সাবেক পুলিশ বাহিনীর প্রধানকে জাতীয় শুদ্ধাচার পদক দিয়েছে, সেই কমিটির নীতি নৈতিকতা কি? বেনজিরের শুদ্ধাচার পদক বাতিল এবং জাতীয় কমিটির সদস্যদের শাস্তি হবে কি? ২০১৭ সালের ৭ এপ্রিল জাতীয় শুদ্ধাচার নীতিমালা প্রনয়ন করা হয় এবং ২০১৯ সালের ২৮শে জুলাই অতিরিক্ত সচিব (সংস্কার) মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ কে আহবায়ক করে ১০ সদস্য বিশিষ্ঠ জাতীয় শুদ্ধাচার বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্যতম সদস্য সদস্যরা হলেন কমিশনার ঢাকা বিভাগ এবং উপ সচিব ( প্রশাসনিক সংস্কার) মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ কে সদস্য সচিব করা হয়েছে।
জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে শুদ্ধাচার কৌশল কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন নির্দেশিকা, ২০২৩-২৪ প্রনয়ণ করা হয়েছে। শুদ্ধাচার কৌশল কর্ম-পরিকল্পনায় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন এবং শুদ্ধাচার সংশ্লিষ্ট ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়ক অন্যান্য কার্যক্রম এই ৩ (তিন) টি ক্ষেত্রে কার্যক্রম নির্ধারণ করা হয়েছে। একটি নৈতিকতা কমিটি আছে এবং নৈতিকতা কমিটির সভা করা বাধ্যতামূলক। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল কর্ম-পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ সংক্রান্ত ত্রৈমাসিক ন্যূনতম ১টি করে নৈতিকতা কমিটির সভা আহ্বান করতে হবে । দপ্তর/সংস্থাসমূহ সরকারি যানবাহনের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করবে। যে সকল কর্মকর্তা গাড়ি ক্রয়ের জন্য সুদমুক্ত ঋণ পেয়েছেন এবং গাড়ি ক্রয় করেছেন তারা যাতে অফিসের গাড়ি ব্যবহার না করেন এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। অথচ নিয়মিত সরকারী যানবাহন কর্মকর্তাগণ তাদের সন্তানদের স্কুল কলেজে যাতায়াত এবং শুক্র ও শনিবার সকাল বিকাল ভ্রমন এবং আত্বীয়স্বজনের বাড়ীতে দাওয়াত খাওয়ার কাজে ব্যবহার করছে, যে কোন নাগরিক ছুটির দিনে রাস্তায় সরকারী গাড়ি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার দেখতে পায়। কিন্তু শুদ্ধাচার কমিটির নজরে আসে এমন সংবাদ প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আসে না। একজন গাড়ির ড্রাইভারের মাসিক ওভারটাইমের বিল তার অফিসারের বেতনের চেয়েও বেশী। এখন প্রশ্ন থেকে যায় রাস্ট্র কেন সরকারী কর্মকর্তার ছেলে মেয়ের স্কুল ও কলেজে যাওয়ার দায়িত্ব বহন করবে। এটা কেমন শুদ্ধাচার কমিটির নৈতিকতা?
রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রবর্তিত সরকারি কর্মচারীদের পেশাগত দক্ষতা, সততা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে প্রদান করা একটি পুরস্কার। ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল শুদ্ধাচার পুরস্কার প্রদান নীতিমালা-২০১৭ প্রকাশিত হয়। ‘সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়: জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ শিরোনামে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ২০১২ সালে মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদন করে। সরকারের মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা রাষ্ট্রীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত কর্মচারীদের পুরস্কার প্রদানের উদ্দেশ্যে শুদ্ধাচার পুরস্কার নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। কর্মচারী বলতে মন্ত্রণালয়, বিভাগ, বা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বোঝানো হয়েছে। শুদ্ধাচার চর্চার ১৮টি ক্ষেত্রে ৫ নাম্বার করে মোট ৯০ নাম্বার এবং মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, দফতর বা সংস্থা কর্তৃক ধার্যকৃত অন্যান্য কার্যক্রমে ১০ নাম্বার; মোট ১০০ নাম্বারের মধ্যে একজন কর্মচারীকে যাচাইবাছাই করে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়। শুদ্ধাচার পুরস্কারপ্রাপ্ত কর্মচারীরা পুরস্কার হিসেবে একটি সার্টিফিকেট এবং এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পাবেন। বাংলাদেশ সরকারের শুদ্ধাচার নীতিমালা ২০১৭ অনুযায়ী শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য যারা মনোনীত হবেন : ১) মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সিনিয়র সচিব বা সচিব। ২) প্রতিটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের গ্রেড ১ থেকে গ্রেড ১০ ভুক্ত একজন এবং গ্রেড ১১ থেকে ২০ পর্যন্ত একজনসহ মোট দুই জন কর্মচারী। ৩) মন্ত্রণালয় বিভাগ বা রাষ্ট্রীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের মধ্য হতে একজন কর্মচারী। ৪) মন্ত্রণালয় বিভাগ বা রাষ্ট্রীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাঠপর্যায়ের আঞ্চলিক কার্যালয়সমূহ থেকে একজন কর্মচারী। ৫) মন্ত্রণালয় বিভাগ বা রাষ্ট্রীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাঠপর্যায়ের আঞ্চলিক কার্যালয়সমূহের গ্রেড ৩ থেকে ১০-ভুক্ত একজন কর্মচারী। ৬) গ্রেড ১১ থেকে ২০ পর্যন্ত একজন কর্মচারী। ৭) মাঠপর্যায়ের জেলাসমূহের মধ্য থেকে একজন কর্মচারী ৮) মন্ত্রণালয় বিভাগ বা রাষ্ট্রীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাঠপর্যায়ের উপজেলা কার্যালয়সমূহের প্রধানদের মধ্য হতে একজন কর্মচারী।
প্রশ্নের মুখে বেনজীরের সততার পুরস্কার ও পদক : পুলিশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন বেনজীর আহমেদ। তিনি ছিলেন আইজিপি, র্যাব ডিজি, ডিএমপি কমিশনার এবং পুলিশ সদর দফতরের প্রশাসন বিভাগের ডিআইজি। চাকরিতে থাকাকালে বেশকিছু মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারও পেয়েছেন। ৫ বার বিপিএম পদক লাভ করেন তিনি। এছাড়া সততার জন্য পেয়েছেন শুদ্ধাচার পুরস্কার। সেই বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে এখন কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। এরই মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ অবস্থায় দেশের সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশের শীর্ষ পদগুলোতে থাকার সময় কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করলেও কেন বেনজীরকে এত এত পদক দেওয়া হলো? বিশেষ করে তার শুদ্ধাচার পুরস্কার পাওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে প্রশ্ন।
বেনজীর পুলিশে থাকাকালে নীতি-নৈতিকতার ব্যাপারে বিভিন্ন সময় জুনিয়র কর্মকর্তাদের নানা নির্দেশনা দিতেন। সেই জুনিয়র কর্মকর্তারা বেনজীরের ঘটনায় বিব্রত। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, পুলিশের এসব পুরস্কার ভালো কাজের স্বীকৃতির প্রতিফলন নয়। মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার দেওয়ার আগে সঠিকভাবে যাচাই করা উচিত।
পুলিশের ডিআইজি ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তার ভাষ্য, সাবেক কোনো শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতি-সংক্রান্ত বিব্রতকর তথ্য সামনে এলে পুলিশের সদস্যদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। পরিবার ও সমাজের কাছে ভিন্ন ধরনের বার্তা যায়। তাই এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে মাঝে মাঝে পুলিশের ভেতরে বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান চালানো প্রয়োজন। এতে অন্যরা সতর্ক হবেন। সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে পুলিশের প্রত্যেক সদস্যের ব্যাপারে নানা সময় বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। কী ধরনের কর্মকাণ্ডে তারা জড়িত- এসব সেখানে উঠে আসার কথা। যথাযথ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীল জায়গায় পদায়নের ওপর জোর দেন তারা।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১১, ২০১২, ২০১৪, ২০১৬ ও ২০১৯ সালে সাহসী ভূমিকা, জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান, রাজনৈতিক সহিংসতা প্রতিরোধ এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অবদানের জন্য বিপিএম পদক পান বেনজীর। একেকটি বিপিএম পদক অর্জনে একটি পদক, ১ লাখ টাকা এবং একটি সনদ পেয়েছেন তিনি। এছাড়া অতিরিক্ত হিসেবে প্রতিবার পুরস্কারপ্রাপ্তির পর মূল বেতনের সঙ্গে ১ হাজার ৫০০ টাকা ভাতা যোগ হয়েছে। তবে বেনজীর নিজে পুলিশের সর্বোচ্চ ৫টি পুরস্কার নিলেও পরবর্তী সময়ে পদকপ্রত্যাশীদের জন্য নতুন নিয়ম করেছিলেন। সর্বোচ্চ দু’বারের বেশি কেউ এখন বিপিএম পেতে পারবেন না। তার করা নতুন নিয়ম নিয়েও পুলিশের অনেকের মধ্যে অসন্তোষ আছে। অনেকে বলছেন, সাহসী কাজ করলে একাধিকবার পুরস্কার পেতে কেন বাধা থাকবে? ২০২০-২১ সালে বেনজীরকে শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়া হয়। দুদকের তথ্য অনুযায়ী, তিনি ও তার পরিবার ২০২০-২১ সালেই প্রায় ৮৭ দশমিক ৯ একর জমি কিনেছিলেন। এছাড়া গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে কিনেছেন প্রায় ৬০০ বিঘা জমি। তার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু অনেককে ভয় দেখিয়ে কম দামে জমি কেনার অভিযোগ রয়েছে। সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পূর্বানুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু বেনজীর আগে থেকে এ অনুমোদন নিয়েছেন কিনা, জানা যায়নি।
দুদকের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেনজীর ও তার পরিবার ২০০৯-২০২৩ সালের মধ্যে অন্তত ২০৪ দশমিক ৫ একর জমি কিনেছেন। এর মধ্যে ১১২ একর জমি কেনেন পুলিশ ও র্যাবপ্রধান থাকাকালে। পুলিশ আইন অনুযায়ী, বাহিনীর কোনো সদস্য বেআইনি কাজে জড়ালে লঘু ও গুরুদণ্ডের বিধান আছে। গুরুদণ্ডের আওতায় চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিত, বেতন কর্তন, চাকরিকালীন সুযোগ-সুবিধা রহিত করা হয়। গুরুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করা যায়। লঘুদণ্ড হলে প্রত্যাহার, অপারেশনাল ইউনিট থেকে পুলিশ লাইন্স বা রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। বিসিএস ক্যাডারের পুলিশ কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়।
এদিকে পুলিশের যেসব কর্মকর্তা বেনজীরের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলার পেছনে ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। জাতীয় শুদ্ধাচার কমিটির উচিত বেনজিরকে প্রদত্ত শুদ্ধাচার পদক বাতিল করা।
লেখক : গবেষক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।