নিজস্ব প্রতিনিধি :
সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভবন নির্মাণে দুইবার জরিমানা দিয়েও নির্ধারিত মেয়াদে কাজ শেষ না করে পালিয়েছেন ঠিকাদার। আর এদিকে রোগী সাধারণ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। অন্যদিকে রাষ্ট্র বিপুল অংকের টাকার আর্থিক সম্মুখীন হতে হবে। কবে কখন নতুন দরপত্র আহবান করে ফের কাজ শুরু করা হবে এনিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বর্তমানে রডগুলো মরিচা ধরে ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। নির্মাণ কাজের শুরু থেকে অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠনটির বিরুদ্ধে রহস্যজনক কারণে নেয়া হয়নি কোন ব্যবস্থা। পরপর দুইবার জরিমানা দিয়ে মেয়াদ বৃদ্ধি করেও নির্ধারিত মেয়াদে শেষ করা হয়নি নির্মাণ কাজ। নির্মাণ কাজ সম্পর্কে খোদ কিছুই জানেননা বলে জানালেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. উৎপল দাস।
তিনি জানান, কার্যাদেশ সহ কোন প্রকার নথিপত্র তাকে দেয়া হয়নি। তাই নির্মাণ কাজের গুণগত মান ও পরিধি নিয়েও অন্ধকারে রয়েছেন। তার দাবি, কার্যাদেশের একটি ফাইল তার কাছে জমা দিলেও সেটি কিছুদিন পর স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের লোকজন নিয়ে গেছেন। রহস্যজনক কারণে কার্যাদেশের প্রায় এক বছর পর হাসপাতালটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
নতুন দরপত্রের বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে আরও বলেন, ইতোমধ্যে আমার বদলীর আদেশ চলে এসেছে। কবে কখন নতুন দরপত্র হয় আর কাজ শেষ হয় এমন কোন উত্তর আমার কাছে নেই।
২০২৩ সালে তিন তলা ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত এক তলার ছাদ ঢালাই শেষ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য প্রকৌশল আধিদপ্তরের নিয়মিত তদারকি না থাকায় যথেচ্ছভাবে কাজ করেছিল ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নিন্মানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করে রাতের আঁধারে ঢালাইয়ের কাজ করা হয়েছিল ভবন নির্মাণে। এক থেকে দুই মাস পরপর কাজ দেখা বা তদারকির জন্য ঘটনাস্থলে যেতেন স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নোয়াখালী জোনের সাবেক সহকারি প্রকৌশলী মেহেদি হাসান। ফেনী জেলা আ.লীগের এক সিণ্ডিকেট নেতাকে ৬শতাংশ চাঁদা দিয়ে কাজ শুরু করতে দেরী হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। জনবল সংকটের কারণে নিয়মিত সাইট ভিজিটে করতে পারতেননা বলে জানিয়েছেন তিনি। হাসপাতালের সামনে স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. ইকবাল হোসেন জানান, হাসপাতালটির নির্মাণ কাজে অতি নিন্মমানের ইট, নিন্মমানের শুভপুরের বালু, স্বল্প গ্রেডের রড, নিন্মমানের পাথর, সিলেকশন বালুর পরিবর্তে ভিটি বালু, মরিচা পড়া রড দিয়ে ঘূর্ণিঝড় রিমালের দিনও রাতের আঁধারে ঢালাইয়ের কাজ করা হয়েছিল। লোকচক্ষু আড়াল করতে প্রায় সময় দিনে কাজ না করে রাতেই কাজ করা হত। নির্মাণ কাজ স্থলে সাঁটানো হয়নি কোন সিটিজেন সার্টার। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটির ধীরগতির কাজ ও দীর্ঘ সূত্রতার কারণে রোগীরা পোহাচ্ছেন অবর্ননীয় দুর্ভোগ। হাসপাতালের সিড়ি ও বারান্দায় বিচানা ও বেড পাতিয়ে নিতে হচ্ছে চিকৎসা সেবা। ধুলোবালিতে সীমাহীন কষ্টের শিকার হচ্েেছন রোগী সাধারণ।
স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সোনাগাজী ৫০ শয্যা হাসপাতালের ৩১ শয্যা বিশিষ্ট ছয় তলা ফাউণ্ডেশনের তিন তলা ভবন নির্মাণের জন্য ২০১৮ সালে ৯ কোটি ৬৯ লাখ ৫২৫টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। উক্ত বরাদ্দের মধ্যে আরো রয়েছে দ্বিতীয় তলার ড্রাইভার কোয়ার্টার, এক তলার বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সাব স্টেশন, আভ্যন্তরীণ সড়ক ও ড্রেন নির্মাণ, গভীর নলকূপ এবং ১৯ শয্যার তিন তলা পুরাতন ভবনের সংস্কার কাজ। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স মনির এন্ড জেএইচএম জেবি ১১মাসের মধ্যে উক্ত কাজগুলো সম্পাদনের শর্তে ২০২২ সালের ৬ জুন কার্যাদেশ পান। দু’বার মেয়াদ বৃদ্ধির পর গত ২০২৪ সালের ৩১মে দ্বিতীয় দফার মেয়াদও শেষ হয়ে যায়।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, তৃতীয় দফা জরিমানা দিয়ে ৩১ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মেয়াদ বৃদ্ধি সম্ভব হয়নি। বর্তমানে তৃতীয় মেয়াদে সময় বৃদ্ধি না করায় নতুন করে দরপত্র আহবানের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের যথাযথ তদারকি যদি থাকত, তাহলে নির্ধারিত মেয়াদেই ভবন নির্মাণ সম্পাদন হত।
স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নোয়াখালী জোনের সহকারি প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম নির্ধারিত সময় কাজ সম্পাদন না হওয়ায় সংশয় প্রকাশ করে বলেন, আমি দায়িত্ব পেয়েছি মাত্র কয়েক মাস হল। কিন্তু আগের দায়ীত্বপ্রাপ্ত সহকারি প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বিষয়টি বেশি বলতে পারবেন।
সাবেক দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারি প্রকৌশলী শেহেদী হাসান বলেন, কাজ শুরুর আগেই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি মোটা অংকের চাঁদা দিয়ে কাজ শুরু করতে হয়েছে। চেয়ারে বসে অনেক বিষয়ে মুখ খুলতে পারিনা। তবে নির্ধারিত সময়ে কাজ সমাপ্ত করানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ঠিকাদারের উদাসীনতায় যথাসময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি পরিচালক তানিম জাহাঙ্গীর বলেন, চাঁদার টাকা পরিশাধ করতে গিয়ে দেরিতে কাজ শুরু করা হয়েছিল। শত চেষ্টা করেও নির্ধারিত মেয়াদে আমরা কাজ শেষ করতে পারিনি। আপনাদের উদাসীনতা ও চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যের কারণে সোনাগাজীর জনগণ তথা রাষ্ট্র যে ক্ষতির সম্মুখীন হল সেটার দায়ভার কে নেবেন, এ প্রশ্নের উত্তর এডিয়ে তিনি বলেন নতুন করে দরপত্র পেলে যথাসময়ে কাজ শেষ করার চেষ্টা করব।
সোনাগাজী হাসপাতালের ১৯ শয্যা বেডের পুরাতন ভবনে ভর্তি থাকা রোগী ইসমাঈল হোসেন বলেন, রোগী ও তাদের স্বজনদের সীমাহীন দুর্ভোগে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। রোগীদের ব্যবহার করার গণশৌচাগারের দরজাগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। অনেকে নিরুপায় হয়ে লোকলজ্জা উপেক্ষা করে প্রাকৃতিক কাজ সারাচ্ছেন। স্থান সংকুলান না হওয়ায় নারী-পুরুষ একাকারে বহু কষ্টে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন।