জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশের প্রতি ভারতের পানি বৈষম্যের কথা। এবার নয়, এ আগ্রাসন তারা আগেও করেছে। সময় মতো আগামীতেও করবে। তাদের সুবিধা মতো পানি আটকাবে, ছাড়বে। প্রাকৃতিকভাবেই পানির খবরদারিটা তাদের হাতে। তারা উজানে, আমরা ভাটিতে। তাই বলে পানির মোড়লিপনা আন্তর্জাতিক আইনে পারমিট করে না। এরপরও তারা করে আসছে। যেখানে আমাদের দেশের নির্বাচন, ক্ষমতা, সীমান্ত, অর্থনীতির দণ্ডমুণ্ডের অধিকর্তাই তারা, সেখানে পানি তো পানির মতোই মামুলি।
এবার একটু ব্যাতিক্রম। পূর্বসতর্কতা ছাড়া বাঁধ খুলে দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ এবার অন্তত কথা বলছে। আমাদের রাজনীতি নিয়ে ভারতের আধিপত্য এবার খাটেনি। তারা এবার আন্দোলন দমানোর কাজে সুবিধা করতে পারেনি। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট এ বার যে মাত্রায় পৌছেছে সর্বাত্মক চেষ্টা করেও তারা রক্ষা করতে পারেনি তাদের খাস পছন্দের শেখ হাসিনাকে। পেরেছে তাকে আশ্রয় দিতে। আর জেদের মারে পানি ছেড়ে বাংলাদেশকে বিপদে ফেলতে। পরিস্থিতি কিছুটা একটি বিশেষ প্রাণীর মতো। যে প্রাণিটি তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে চরম ক্ষেপেও আর না পারলে শেষমেষ পেশাব করে দেয়। পেশাবের ওই পানিটা তখন জায়গাটা নোংরা ও পিচ্ছিল করে দেয়। বাংলাদেশকে এখন তা সইতে হচ্ছে। ভূগতে হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উজানের কোনো দেশ নদীর ওপর দেওয়া বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার ৭২ ঘণ্টা আগে ভাটির দেশকে জানানোর কথা। কিন্তু পূর্বসতর্কতা ছাড়াই ডুম্বুর ও কলসি বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। এক পর্যায়ে ফারাক্কা বাঁধের বেশিরভাগ গেটও খুলে দিয়ে পেশাব করার মতো জেদ মিটিয়েছে। বাংলাদেশের সচেতন মানুষ উপলব্ধি করছে ভারতের এ ভূমিকা বিশেষ প্রাণীর মতো পেশাবের পানি ছেড়ে দেয়ার মতোই। অর্থাৎ তার সবশেষ শক্তির ব্যবহার করে অসহায়ত্ব আর ঢাকা রাখতে না পারার লক্ষণ। আন্তর্জাতিক নদী আইন লঙ্ঘন করে ৫৪টি নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে পানি আটকানো ও প্রত্যাহারের খবরদারি তারা প্রতিষ্ঠা করেছে। সামনে আরো করবে। সেটা ধরে নিয়েই এখন এগাতে হবে বাংলাদেশকে। ভারত না চাইলে কখনো বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে শেখ হাসিনাকে নামানো যাবে না- সেই ধারনা বা মিথ এবার খান খান করে দিয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তরুণরাজরা। যা সিনেমার কাহিনীর থ্রিলকেও হার মানানো। এক সময় তারা ভারতের পানি সন্ত্রাস-পানি নৈারাজ্যও যে মাঠে মেরে ফেলবে, সেই আশাবাদ জাগায়।
শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়ে মরুকরণের ঝুঁকিতে পড়া নিয়তির মতো। বর্ষা মৌসুমে বাঁধের গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে ভাসিয়ে মারা ভারতের লুডু খেলার মতো। ভারতের এই পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার তাগিদ এখন বেশ জোরদার। মোক্ষম সময় যাকে বলে। ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, খাগড়াছড়িসহ আশপাশে অমানবিক অবস্থা গত ক’দিন কেবল দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও নিয়মিত শিরোনাম। সারা পৃথিবী নতুন করে জেনেছে বাংলাদেশিরা প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে চরম পানিসন্ত্রাসের কী নির্মম শিকার। আক্রান্ত জেলাগুলোকে উপদ্রুত এলাকা ঘোষণা করে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতিতে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে বানভাসি মানুষকে উদ্ধার, নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া ও পর্যাপ্ত ত্রাণসহায়তার জন্য অন্তর্র্বতী সরকারের কাছে দাবি বিভিন্ন মহলের।
ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরায় গোমতী জেলায় অবস্থিত গোমতী পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ডম্বুর স্লুইস গেট খুলে দেয়ার ফলে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্যাপক বন্যা এখন আর নালিশের বিষয় নয়। এটি তথ্য। পাল্টা তথ্য হিসেবে সেখানকার সরকার বলছে, ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরায় গত তিন দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কারণেই এ অবস্থা। তাছাড়া, ভারত কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করে জানিয়ে দিয়েছেন তারা ত্রিপুরার ডম্বরু বাঁধ খুলে দেননি। পানির চাপ বেশি হওয়ায় বাঁধের কপাট নিজে নিজেই খুলে গেছে! এই ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই করার সময় তখন ছিল না। অজুহাত বা যুক্তি যা-ই হোক, আগে কখনো ভারত এ ধরনের জবাবদিহিও বা অজুহাত দেয়ারও গরজ করেনি। ডেমকেয়ার করেছে। এবার অন্তত অজুহাত হলেও দিতে হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো কিছু দেয়া লাগতেও পারে। প্রয়োজনে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বাদ দিতে যা করার দরকার তা করার একটি সেন্টিমেন্ট তৈরি হয়েছে। তাদের ধারনা পাল্টা বাঁধ দেওয়া হলে কখনো ভারতের সামনে আমাদের মাথা নত করতে হবে না। বরং ভারত আমাদের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হবে। এ দাবি ও যুক্তির বাস্তবতা কতোটা যৌক্তিক তা সময়সাপেক্ষ। সেন্টিমেন্ট যে তৈরি হয়েছে, এর একটা জের অবশ্যই না থেকে পারে না।
বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্ধ হোক বললেই বন্ধ হয় না। বন্যা থেকে সৃষ্ট নদীভাঙনের জন্য প্রতিবাদ স্বরূপ তৈরি মানববন্ধন ও লেখা ব্যানারের ভাষা নদীগুলো পড়তে জানে না। নদীতীরের মানুষগুলোও সবাই সেটা বোঝে না। এজন্য রাষ্ট্রীয় কমিটমেন্ট কাজে লাগাতে হয়। এবার গোটা জাতি একাট্টা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের আহ্বানে দশ মিনিটে যে কোনো প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাগিদে যে উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে তাতে দেশে বিদেশে আমাদের আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টন সমস্যার বৈষম্যগুলোর কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সারা পৃথিবী নতুন করে জেনে ফেলেছে আমরা বাংলাদেশিরা প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে চরম পানিসন্ত্রাসের শিকার। এই পানিবৈষম্য আমাদের কৃষি, যোগাযোগ, মৎস্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, সুন্দরবন সবকিছুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে আসছে। গত ৫২-৫৩ বছরে এসবের কড়া প্রতিবাদ হয়নি। বরং ভারতকে ক্ষেপানো যাবে না বলে জুজুর ভয় দেখানো হয়েছে। আর টানা কয়েক বছর ধরে এর উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে বিএনপিকে।
বলা হয়েছে, ভারতকে চটানোর কারণেই দুর্গতি পোহাতে হচ্ছে বিএনপিকে। ঢাকা সফরের সময় প্রণব মুখার্জির সাথে দেখা না করার মস্ত ভুলে কী নাস্তানাবুদ হয়েছে দলটি। আগামী দশ-বারো বছরের মধ্যে বিএনপি ‘নাই’ হয়ে যাবে-এমন জ্ঞানগর্ব যুক্তির বাজারও গরম করা হয়েছিল।
পানির চাপ অনেক বেশি হয়ে গেলে ভারত তাদের বাঁধের গেট খুলে পানি সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এক তরফাভাবে আন্তর্জাতিক নদীর উপর বাঁধগুলো তাঁরা বানিয়েই রেখেছে। তারা তাদের সুবিধা-অসুবিধা মতো বাঁধ খুলবে-আটকাবে। আমাদের নিম্নাঞ্চলে ফ্লাশ ফ্লাড হবে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে উঠে বিছানা পর্যন্ত পানি দেখবো। তব্ওু জাগবো না। জাগলেও ভারতকে ক’টা গাল দেবো। দায়িত্ব শেষ? এই চর্চার অবসানের আলামত এবার স্পষ্ট। প্রাণহানি, ভোগান্তি, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, প্রাকৃতিক বা মানবিক বিপর্যয়ের শিকারদের কাছে তা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা। কুমিল্লা, ফেনী, বৃহত্তর নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলার মানুষ বন্যায় কী যাতনা সইছে তারাই জানে। বাতাস-পানি কখনো সীমানা মানে না। এদের আটকাতে বা ধাওয়াতে পাসফোর্ট ভিসা লাগে না। সুউচ্চু বা বিশাল দেয়াল দিয়েও তা রোখা যায় না। কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় মাত্র। কিন্তু যার বা যে দেশের কারণে এই অনাসৃষ্টি তাদের তো কঠিন বার্তা দেয়া যায়। নিজেদের প্রস্তুতিও নেয়া যায়। তা বুঝেই তো বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দপ্তসমূহের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ছুটি বাতিল করেছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। সেই সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। তা জেনেই তো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারাদেশে রেসকিউ অপারেশন এবং ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।
বন্যা কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক অবিশ্বাস্য রেকর্ড তৈরি হয়েছে এবার। একটু আত্মসমালোচনাও হচ্ছে। বন্যা রুখে দেয়া বা মোকাবেলায় স্থায়ী ব্যবস্থা করার আলোচনা এবার বেশ চাঙ্গা। এই মনুষ্যসৃষ্ট বন্যা থেকে বাঁচার বা ক্ষতি কমানোর কোনো-না-কোনো উপায় নিশ্চয়ই আছে। সেটি নদী ড্রেজিং হতে পারে, খাল খনন বা খাল উদ্ধার হতে পারে। আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়ে ভারতকে শিক্ষাও দেয়া যেতে পারে। এগুলো কম কথা নয়। এক সময় কল্পনাও করা যায়নি এ ধরনের সাহসী ভাবনার ফুসরত আছে। সেইসঙ্গে যত্রতত্র বাড়িঘর, রাজনৈতিক আশ্রয়ে অমানুষের অবিরাম নদী দখল, পানিপথ বন্ধ করে স্থাপনা নির্মাণ নিয়েও কথা হচ্ছে। নদীগুলোতে পরিকল্পিত খনন এবং দখলকৃত জলাশয় ফিরিয়ে আনার বিষয়ও আলোচিত। এটি অবশ্যই ভালো লক্ষণ। বাকিটা নির্ভর করছে চলমান জাতীয় ঐক্য ও সেন্টিমেন্ট ধরে রাখা ও বাস্তবায়ন করা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।