নাজমুল হক
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন যারা করেছে তাদের বয়স ১০ থেকে ৩৫ বছর। তারা বিগত শতাব্দী এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক পরিস্থিতি গণতন্ত্র,ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সুশাসন ন্যায়বিচার মানবাধিকার রক্ষা ইত্যাদি অনেক কিছুই দেখে নাই। তারা দেখে নাই ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন এবং রফিক সালাম বরকত এবং শফিকের রক্তাক্ত শহীদ হতে। ১৯৬৯ সালে মোহাম্মদ আসাদ হত্যাকাণ্ড এবং ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান জেনারেল আইউব খানের বিদায় দেখিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাত্রিতে পাকিস্তানের গণহত্যা এবং বংগবন্ধুর গ্রেফতার দেখিনি।
২৬ মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা দেখিনি। ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদারদের পরাজয় এবং আত্বসমর্পন দেখিনি। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে ব্যালট বাক্স লুট দেখিনি। সিরাজ শিকদার গুম ও ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ড দেখিনি। ১৯৭৪ সালের দুভিক্ষ এবং রক্ষীবাহিনী অত্যাচার এবং জাসদের ২০,০০০ নেতাদের গুম ও হত্যাকাণ্ড দেখিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বংবন্ধুর হত্যাকাণ্ড দেখিনি।১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ড দেখিনি। ১৯৮২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল দেখেনি। ১৯৮৬ ১৯৮৮ ২০০৮ ২০১৪ ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে ক্ষমতা দখলকারী ভোট ডাকাতি কেউ দেখেছে আবার কেউ দেখেনি। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ছাত্রদের গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের পতন দেখেনি। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধিনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কেউবা দেখেছে এবং কেউবা দেখেনি।১৯৯৬ সালের ভারতীয় আধিপত্যবাদী আমলাদের জনতার মঞ্চ দেখেছে অথবা দেখেনি। ২০০৭ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে লগি বৈঠার তান্ডব এবং প্রকাশ্যে দিবালোকেভ বিরোধী দলের নেতাদের হত্যাকাণ্ড দেখেছে অথবা দেখেনি। ২০১৮ নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং কোটা সংস্কার আন্দোলন দেখেছে অথবা দেখেনি। ২০২৪ সালে ছাত্রদের বৈষম্য বিরোধী সাধারণ ছাত্র আন্দোলনে হেলমেট বাহিনীর হাতে মেধাবী ৮৬০ এর অধিক আবু সাঈদ মুগ্ধদের রক্তাক্ত গণহত্যা দেখেছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এর নতুন প্রজন্মের হিরোদের দেখেছে। ৫ ডিসেম্বর অসহযোগ আন্দোলনে স্বৈরশাসক লেডি হিটলার শেখ হাসিনার পতন দেখেছি। আয়নার ঘর দেখেছে। ৩৬ জুলাই ভারতের তাবেদার হাসিনাকে হটিয়ে দ্বিতীয় স্বাধীন বাংলাদেশ দেখেছে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং শেখ সবকিছু দেখেছে। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফেরত আসে ৩০শে মে দেশপ্রেমিক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ড ঘটে। এ ঘটনার সাথে ফ্যাসিবাদের জননী শেখ হাসিনা, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং জেনারেল এরশাদ জড়িত ছিল। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ড তদন্ত করলে সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে।
শেখ হাসিনা এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ দিল্লিতে বসে বাংলাদেশেকে নিয়ে প্রতিনিয়ত নীলনকশা তৈরি করছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং জনগণের জন্য এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ দেশকে যেভাবে চালিয়েছে এবং বর্তমানে ‘র’ এর শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার জন্য ষড়যন্ত্র করছে, তা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ কাশ্মীরে যে নৃশংস এবং অমানবিক দমননীতি গ্রহণ করেছে, সেই একই পদ্ধতি তারা বাংলাদেশেও বিগত ১৫ বছর প্রয়োগ করেছে। বাংলাদেশের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলনকে দমন করতে তারা অস্ত্র হাতে নেমেছে। এটি শুধুমাত্র একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি শক্তির সরাসরি হস্তক্ষেপ নয়, এটি আমাদের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় হুমকি। শেখ হাসিনা এবং ‘র’ এর মধ্যে যে গোপন চুক্তি এবং ষড়যন্ত্রের কার্যক্রম চলছে, তা এদেশের জন্য অশুভ সংকেত বহন করছে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা এবং শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা অজিদ ডোভালের সরাসরি তত্ত্বাবধানে হাসিনা নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য যা করছে, তা দেশ ও জাতির স্বার্থের পরিপন্থী। মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যে বর্বর দমননীতি প্রয়োগ করা হয়েছে, তা জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করার চক্রান্তেরই অংশ।
সবচেয়ে মজারবিষয় হলো, শেখ হাসিনা নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে, ভারতের মতো একটি আধিপত্যবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে নিজেদের ভাগ্য সঁপে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং গোয়েন্দা সংস্থার চাপে তারা দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল এবং ৮৬০জন মেধাবী ছাত্রদের হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে । ভারতের ১৫ বছরের বড়ভাই সুলভ হস্তক্ষেপ আমাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরুপ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসে, একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আমাদের এই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে, তা জাতি হিসেবে কখনোই কল্পনাও করতে পারি নাই। শেখ হাসিনা এখন দিল্লিতে অবস্থান করছেন এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা এবং তাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সরাসরি তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে, প্রতিদিন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জ্বাল বিস্তার করছে। শেখ হাসিনা সরকারের পরাজয় ভারত মেনে নিতে পারে নাই। র এর এজেন্টদের দিয়ে হিন্দুদের বাড়িতে হামলার ঘটনা প্রচার করে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনাকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করে। পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য পুলিশ ধর্মঘট লাগিয়ে দিয়েছে। বিচারকদের কর্মবিরতি, শাহবাগে হিন্দুদের দিয়ে অবরোধ, আনসার বিদ্রোহ ইত্যাদি চালু করে।
বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, ভারতের ‘র’ এখন বাংলাদেশে একটি নতুন ষড়যন্ত্রের প্রস্তুতি নিচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধ্বংস করতে এবং দেশের বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে তারা একাধিক ষড়যন্ত্রের নীলনকশা তৈরি করছে। তারা ইসলামী রাজনৈতিক দলের সাথে জামায়াত শিবির এবং অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর নাম ব্যবহার করে দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করার পরিকল্পনা করছে। এই ষড়যন্ত্র শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি আমাদের সমাজের বুনিয়াদকে নাড়া দেবে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে ধ্বংস করবে। বিভিন্ন শ্রেণির অধিকার আদায়ের নামে আন্দোলন, কর্মবিরতি, মানববন্ধন, রাজনৈতিক দলের হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি করে কেয়ারটেকার সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দেওয়া ইত্যাদি করে যাচ্ছে।
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূস এবং তার অস্থায়ী সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করতে এবং দেশের জনগণের মনে বিভ্রান্তি ছড়াতে, ‘র’ এবং হাসিনা সরকার একত্রে কাজ করছে। তাদের উদ্দেশ্য একটাই—দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা এবং গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করা। আমাদের দেশ এবং আমাদের জনগণকে বাঁচাতে হলে, এই ধরনের ষড়যন্ত্র এবং বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমরা একটি স্বাধীন দেশ এবং আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদেরই নির্ধারণ করতে হবে, কোনো বিদেশি শক্তি বা তাদের পৃষ্ঠপোষকতার অধীনে নয়। জনগণের আন্দোলনকে দমন করতে যে নৃশংসতা এবং ষড়যন্ত্র চলছে, তার বিরুদ্ধে জাতিকে সোচ্চার হতে হবে এবং এই অশুভ শক্তির মুকাবিলা করতে হবে। দেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, এবং গণতন্ত্র রক্ষার জন্য এখনই সময় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার।
ফেসবুকে শেখ হাসিনা সর্ম্পকে নাগরিকদের অভিমত : ৫ আগস্ট গণভবনে ঢুকে আমি প্রথমে পুকুর পারটায় যেয়ে বসি। কেউ পুকুর পাড়ে বসে কাঁদছে, কেউ গোসল করছে, কেউ মাছ ধরছে। সবার মাঝে মুক্তির আনন্দ। এর মধ্যে এক মধ্য বয়সী ভদ্রলোক আমার পাশে এসে বসেন। যে গ্রুপটা সর্বপ্রথম গণভবনে ঢুকে তাদের মধ্যে তিনি একজন। লোকটা নানান গল্প করতে করতে বেশ বিষন্ন হয়ে যায়। একটা পর্যায়ে বলে, জানেন ভাই, এই মহিলা দুপুরে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তার ডাইনিংয়ে ১০-১২ পদের আইটেমের বুফে প্রস্তুত ছিল। একদম গরম টাটকা খাবার। তার ফ্রিজ্গুলো খুলে দেখেছিলাম। এত বড় বড় পাংগাস মাছ আমি জীবনেও দেখিনি। একেকটা ১৫-২০ কেজি ওজনের নদীর পাংগাস। অন্তত ১০-১২ টা আস্ত ইলিশ মাছ দেখেছি। একেকটা ১.৫ কেজির কম না। একটা গরীব দেশে এই মহিলা রানীর মত বসবাস করছিল। অথচ এই মহিলা আমাদেরকে পিয়াজ ছাড়া, তেল ছাড়া রান্না করতে বলতো, বাচ্চাদেরকে কাঁঠালের বার্গার খাওয়াতে বলতো, ভাতের বদলে আলু খেতে বলতো। আমার বাচ্চা অনেক দিন ইলিশ মাছ খায় না। সাধ্য হয় না কেনার। বলতে বলতে লোকটা কেঁদে ফেললো। আমি কিচ্ছু ধরি নাই। খুব ঘৃনা লেগেছে এই খাবারগুলো দেখে। তারপর চোখ মুছতে মুছতে বললো, শেখ হাসিনা এদেশের মানুষকে প্রচন্ড ঘৃণা করতেন আর আমাদের কস্ট দেখে আনন্দ পেতেন। কথা সত্য। উনি আমাদেরকে ঘৃনা করতেন, অসম্ভব রকমের ঘৃনা করতেন।
ভারতের আধিপত্যবাদী শেখ হাসিনার দোষর ১৩.৫ লক্ষ সরকারী কর্মচারীর একটি অংশ বিভিন্ন দাবী দাওয়া নিয়ে সরকারকে অসহযোগিতা করার কর্মসুচী দিয়ে যাচ্ছে। বিপ্লব টিকিয়ে রাখতে হলে প্রতিটি গ্রামে দেশপ্রেমিক নাগরিক শক্তি গঠন করতে হবে। ড. ইউনুস কে ২০ লক্ষ ছাত্রদের আধা সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারতীয় আগ্রাসন রুখতে প্রস্তুত রাখতে হবে। ভারতের সাথে করিডোর চুক্তি বাতিল করতে হবে। ভারত নির্ভর পররাস্ট্রনীতি দেশপ্রেমিক কুটনৈতিকদের দিয়ে ঢেলে সাজাতে হবে। ন্যায়্যতা এবং সমতার নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ভারতের সাথে চলতে হবে। শিক্ষা সংস্কৃতি দেশপ্রেমিক নাগরিকদের নিয়ে বিশ্বের উপযোগী করে ঢেলে সাজানোর জন্য ইসলামী এবং জাতীয়তাবাদী চেতনাকে প্রধান্য দিতে হবে।
লেখক : গবেষক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।