রশিদ আহমদ শাহীন :
তাকওয়া শব্দের অর্থ বিরত থাকা, বেঁচে থাকা, নিষ্কৃতি লাভ করা, ভয় করা, নিজেকে রক্ষা করা। ব্যবহারিক অর্থে: দ্বীনদারি, ধার্মিকতা, পরহেজগারি, আল্লাহভীতি, খোদাভীতি, আত্মশুদ্ধি, আল্লাহ ও সত্যের প্রতি সচেতন এবং পরিজ্ঞাত হওয়া, ধর্মপরায়ণতা, “আল্লাহর ভয়” ইত্যাদি বুঝায়। ইসলামি পরিভাষায়, সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআ’লাকে ভয় করে হারাম থেকে বেঁচে থাকা এবং তাঁর হুকুম-আহকাম মেনে চলাই হল তাকওয়া। অন্যকথায় সকল প্রকার হারাম থেকে নিজেকে রক্ষা করে কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করাকে তাকওয়া বলা হয়।”অক্সফোর্ড ডিকশনারি অফ ইসলাম” অনুসারে, “তাকওয়া” শব্দটি এবং এর থেকে উৎপন্ন শব্দসমূহ কুরআনে “২৫০ বারের বেশি” উপস্থাপিত হয়েছে। তাকওয়া মুমিনের একটি অপরিহার্য গুণ। কুরআনে কারীমের প্রায় ২৭ স্থানে তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য সুসংবাদ বর্ণিত হয়েছে। “যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে তারা থাকবে উদ্যানরাজি ও নহরে। সত্যিকারের মর্যাদাপূর্ণ আসনে, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মহা সম্রাটের সান্নিধ্যে”। (সূরা ক্বমার-৫৪)।
তাকওয়া সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেমন, হযরত নুমান ইবনে বাশীর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-হালাল সুস্পষ্ট, হারামও সুস্পষ্টই। এ দুয়ের মাঝে যা কিছু আছে তা হল, ‘মুশতাবিহাত’ বা সন্দেহপূর্ণ (অর্থাৎ হালালও হতে পারে, হারামও হতে পারে)। অনেক মানুষ এ সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান রাখে না। সুতরাং যে শুবহাত (সন্দেহপূর্ণ বিষয়) এড়িয়ে চলবে, সে তার দ্বীন ও সম্মান নিয়ে নিরাপদে থাকবে। আর যে ওই শুবহাত তথা সন্দেহপূর্ণ বিষয়ে জড়িয়ে পড়বে, সে হারামে নিপতিত হবে।(সহীহ মুসলিম, হাদীস-১৫৯৯)
সাহাবায়ে কেরামের জীবন ছিল তাকওয়ার জীবন। হারাম জিনিস থেকে সতর্ক থাকার অসংখ্য ঘটনা রয়েছে তাঁদের জীবনে। হযরত আবু বকর রা.এর ঘটনা আমরা অনেকেই জানি। আবু বকর রা.এর একজন গোলাম ছিল। সে তার উপার্জনের একটি অংশ আবু বকর রা.কে দিত। হযরত আবু বকর রা. তা খেতেন। একদিন সে কিছু (খাবার) নিয়ে এল। আবু বকর রা. তা থেকে কিছু খেলেন। তখন সে বলল, আপনার কি জানা আছে, এই খাবার আমি কীভাবে লাভ করেছি? আবু বকর রা. জানতে চাইলে সে বলল, জাহেলী যুগে আমি এক ব্যক্তির জন্য গণকের কাজ করেছিলাম। (অর্থাৎ গণকের মত ভবিষ্যতের বিষয় বলেছিলাম।) আমি তো গণকের কাজ পারি না (তার কাছে গণক সেজেছিলাম) তাকে ধোঁকা দিয়েছিলাম। আজ তার সাথে দেখা হলে সে তার বিনিময়ে এ খাবার দিয়েছে। একথা শোনার সাথে সাথে আবু বকর রা. তার গলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলেন এবং যা খেয়েছিলেন বমি করে সব বের করে দিলেন।
পরবর্তীতে তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীগণ, দূর এবং নিকট অতীতের সালাফে সালেহীন সকলেই ছিলেন মুত্তাকী, হারাম থেকে কঠোর সতর্কতা অবলম্বনকারী। তাঁদের জীবনের সবটুকুই ছিল তাকওয়ায় ভরপুর। তাঁদের তাকওয়ার এমন এত অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, যেগুলোর উপর স্বতন্ত্র কিতাবও রচিত হয়েছে। যেমন, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর ‘কিতাবুল ওয়ারা’।
ইমাম নববী রাহ. তাঁর ‘তাহযীবুল আসমা’ কিতাবে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। শাফেয়ী মাযহাবের বড় শায়েখ, ‘আলমুহাযযাব ফিল মাযহাব’ কিতাবের লেখক ইমাম আবু ইসহাক আশ-শীরাযী রাহ. ছিলেন খুবই দরিদ্র। কিন্তু সততা এবং তাকওয়ায় পাহাড়-কঠিন। একদিন তিনি মসজিদে প্রবেশ করলেন কিছু খাওয়ার জন্য। বের হওয়ার সময় ভুলে এক দীনার ফেলে আসলেন। কিছুদূর গিয়ে তার মনে পড়ল, তিনি মসজিদে এক দীনার ফেলে এসেছেন। তখন তিনি আবার মসজিদে গেলেন এবং তার দীনারটি পেয়েও গেলেন। কিন্তু তখনই তাঁর হালত পাল্টে গেল। তিনি মনে মনে ভাবলেন, কতজনের দীনারই তো এখানে পড়ে থাকতে পারে। এটা যদি আমার না হয়!
এটা তারই ফেলে যাওয়া দীনার- এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু যদি না হয়! হারামের এ সামান্য সন্দেহে তা আর নিলেন না। কারণ, হারাম পেটে যাবে, এটা তো মানা যায় না। তাই দীনারটি তিনি স্পর্শ করলেন না। ফিরে গেলেন। সুবহানাল্লাহ! কত কঠিন সতর্কতা। অথচ তাঁর অবস্থা এমন ছিল যে, একটি দীনার ছিল তাঁর জন্য অনেক বড় কিছু। তাকওয়ার এত বড় বড় প্রতিদান ও পুরস্কার এবং মহামনীষীগণের তাকওয়ার প্রতি এত ইহতিমাম দেখে আমরাও উদ্বুদ্ধ হই তাকওয়া অবলম্বন করতে, মুত্তাকী হতে। তাহলে আমাকে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করতে হবে। হারাম থেকে এবং সন্দেহজনক বিষয় থেকে বেঁচে থাকতে হবে। গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে।চারিদিকে এখন হারামের ছড়াছড়ি। এমনকি আমাদের অনেক খাবারেও এখন হারাম মিশ্রিত হওয়ার খবর শোনা যায়। সুতরাং আমরা সতর্ক ও সচেতন হব। যাচাই-বাছাই করে খাওয়ার অভ্যাস করব। আল্লাহকে ভয় করব।
মোটকথা, সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে হারাম থেকে বেঁচে থাকা এবং তাঁর হুকুম-আহকাম মেনে চলা- এরই নাম তাকওয়া। সুস্পষ্ট হারাম কী কী তা তো আমরা একটু অধ্যয়ন করলেই জানতে পারি। কিন্তু যেগুলো স্পষ্ট নয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে আমরা মুফতীগণের শরণাপন্ন হব এবং নিজের বুঝবুদ্ধি ব্যবহার করব। আল্লাহ আমাদেরকে তাকওয়াওয়ালা এবং তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত মুত্তাকী বান্দা হিসেবে জীবন যাপনের তাওফীক দান করুক, আল্লাহুম্মা আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, তাযকিয়াতুল উম্মাহ মডেল মাদ্রাসা।