উপ-সম্পাদকীয়
জাহাঙ্গীর আলম:
আমাদের শৈশবে গুরুজনদের মুখে একটি কথা সবসময় শুনা যেত। তারা শিশুদের উদ্দেশ্যে বলতেন, ‘বাছা, অনেক বড় হও, মানুষের মতো মানুষ হও।’
আজকাল এই কথাগুলো খুব বেশি শুনা না গেলেও প্রচলিত রয়েছে। এখনো কিছু গুরুস্থানীয় ব্যক্তি নিজের একান্ত অনুজের উদ্দেশ্যে এমন আশীর্বাদ বচন করে থাকেন। তবে এটা সত্য যে, এমন আদর্শিক নসিহত এখন আগের মতো শুনা যায় না। আমাদের কৈশোর বয়সে পরিবারের আশীর্বাদ বচন হিসেবে আমরা এই বাক্যগুলো অনেক অনেক শুনতে পাইতাম। শুনতে পাইতাম চরিত্রগঠন মূলক নানান উপদেশ। তম্মধ্যে সত্যকথা বলা,সত্যপথে চলা, মিথ্য বলা মহাপাপ, মিথ্যা সকল পাপের উৎস। কখনো মিথ্যা বলবে না, কারো ক্ষতি করবে না, বড়দের সম্মান করবে, ছোটদের স্নেহ করবে, শিক্ষকদের সম্মান করবে, কখনো ওস্তাদের সাথে বেয়াদবি করো না এজাতীয় উপদেশ গুলো প্রায় প্রাত্যহিক শুনে থাকতাম। তাই কোন কাজ করতে গেলে এই কথাগুলো মনে পড়তো। মনে ভাবতাম, গুরুজনের উপদেশ লঙ্ঘিত হয়েছে কি না? এই চিন্তায় পেরেশান হতাম। সারা দিনের কাজের হিসেব নিতেন পরিবার প্রধান হিসেবে মা – বাবা। জবাবদিহিতা ও কঠিন শাস্তির ভয়ে আতঙ্কিত থাকতে হতো সারাক্ষণ। যার কারণে প্রতিটি কাজ করার আগে ভাবতে হতো অনেক বার।
এখন আমরা আধুনিক হয়েছি। পরিবারকে সময় দেওয়ার সময় আমাদের হাতে নেই। সেই মানসিকতা নেই। প্রযুক্তির প্রেমে অন্ধ হয়ে মানব প্রেমের কথা ভুলে যাচ্ছি আমরা। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ফেসবুক, ইন্টারনেটের অপব্যবহার করে দিনেদিনে যেন কৃত্রিম হয়ে যাচ্ছে মানুষ। এসবের মাধ্যমে মুহূর্তে মাঝে মানুষ বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের সাথে পরিচিত হচ্ছে। অজানাকে জানতে পাচ্ছে ,দেখতে পাচ্ছে অতীত এবং বর্তমানের সচিত্র প্রতিবেদন। এদিক থেকে মানবসভ্যতার উন্নয়ন হয়েছে এটা সত্য। কিন্তু ফেসবুক, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পরিবার ও সামাজিক জীবনে পারস্পরিক কমিউনিকেশন থেকে মানুষ ক্রমান্বয়ে দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এসত্যটি আমরা কতটা অনুধাবন করতে পারছি তা ভেবে দেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আজকের সমাজ বাস্তবতায় আমরা চারদিকে অমানবিক আচরণ ও কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করছি। সমাজের মানুষগুলো ক্রমশ যান্ত্রমানবে রূপান্তরিত হচ্ছে। মানুষের প্রতি মানুষের দয়া-মায়া উঠে যাচ্ছে।
মা-বাবার মমতা থকে বঞ্চিত হচ্ছে ছেলেমেয়ে। পরিবারপরিজন পরস্পরের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ ক্রমেই স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে মানবিক সমাজকে পশুর সমাজে পরিণত করছে।এর লাগাম টেনে ধরতে হবে। এই কাজটি সময় মতো করতে না পারলে জাতির জীবনে আরো কঠিন দুঃসময় নেমে আসবে। মানবিক শিক্ষার শেকড় জাতীয় জীবনের যতো গভীরে প্রবেশ করবে ততোই জাতি প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে তরতর বেগে আপন লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে। মানবিক উন্নতি, সভ্য সমাজ ও আধুনিক কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র গঠনে শিক্ষার প্রভাব প্রত্যক্ষ ভাবে পড়ে।
জনগণে কল্যাণ সাধনের নিমিত্তেই রাষ্ট্র। মানুষের জীবনধারণের যাবতীয় অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কাজ। অন্ন,বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা,চিকিৎসা, নিরাপত্তা প্রদানসহ, চিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং নাগরিক জীবনের সার্বিক সুযোগ সুবিধা সুনিশ্চিত কারতে পারাই কল্যাণধর্মী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। কোন জাতি-রাষ্ট্রের শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন জাতীয় উন্নতির পরিচয় বহন করে না। মনোজগতের উন্নয়ন সাধন না হলে কোন জাতি আপন জাতিসত্তার উপর খুব বেশি সময় টিকে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। মনোজগতের উন্নয়ন তখনই হয় যখন একজন মানুষ মানবীয় গুণে আলোকিত হয়। উন্নয়নের মানদন্ড হিসেবে সভ্যসমাজে নৈতিকতাকে প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নৈতিকতা এমন একটি বিষয় যা মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়তে শেখায়,বাঁচতে শেখায়। এই শিক্ষা শৈশব থেকে পেতে হয়। আদর্শিক ও নৈতিকশিক্ষা পরিবার থেকে শুরু হয় এবং রাষ্ট্র থেকে নাগরিক জীবনে এই শিক্ষা পূর্ণতা পায়। রাষ্ট্রের চরিত্রের উপর নির্ভর করে নাগরিকদের মূল্যবোধ ও জীবনবোধ।
রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার যারা গ্রহণ করেন তারা জাতির আদর্শ। যেকোন জাতির উন্নয়নের পেছনে জাতীয় নেতৃবৃন্দের ভূমিকা অতুলনীয়। একজন আদর্শ নেতা, আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক তার নেতৃত্বাধীন জাতিকে সততার আদর্শে, ত্যাগের মহিমায়, মেধা মননশীলতায়,শৌর্য- বীর্য ও সাহসিকতায় বলিয়ান করে গড়তে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ ও জাতীয়নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই মানবিকতায় উজ্জীবিত হতে হবে। মানবিকতার আইডল হতে হবে রাষ্ট্রের প্রধানকে। দেশপ্রেমিক রাষ্ট্র প্রধানের প্রথম কাজ দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা স্থাপন করে সমগ্র জাতিকে দেশত্ববোধে উজ্জীবিত করে তোলা। পৃথিবীর উন্নত দেশ ও উন্নত জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এমনটি দেখা যায়। ঐসকল দেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দ নিজেদের ভোগ বিলাসকে কখনো বড় করে দেখে নি। ব্যক্তিস্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেশ গড়ার নিরলস সাধনা করে নিজ দেশ নিজ ও জাতিকে স্বনির্ভর করেছেন। স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হলে আত্মবিশ্বাস প্রয়োজন। ব্যক্তির মনে প্রবল আত্মবিশ্বাস তখনই জেগে উঠে যখন আত্মাকে চিনতে পারে। আত্মার গভীরে সত্যের আলো জ্বালাতে পারলেই আত্মা সত্যের সন্ধান পায়, জাগ্রত ও জীবন্ত থাকে। তখন মানুষ মানবিকতাবোধ থেকে সমাজকে উপলব্ধি করতে শেখে। ভোগাকাঙ্ক্ষা থেকে জীবনকে ভোগ করার প্রবণতা তখন থাকে না।
জীবন হয় মোহমুক্ত। মনোজগতের উন্নতির প্রসঙ্গ নিয়ে বলছিলাম। আমরা জাতি হিসেবে মনোজাগতিক উন্নতিকে আজও উপলব্ধি করতে পেরেছি কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। উন্নয়নের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আমরা স্কুল,কলেজ,ব্রিজ, রাস্তাঘাট, ইলেক্ট্রিসিটি, ইত্যাদিকে খুব বড় করে বুঝিয়ে থাকি। জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে এসবের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ভোগবাদী সমাজে ভৌতিক উন্নয়ন অগ্রগণ্য তাতে সন্দেহ নেই। ভৌতিক উন্নয়ন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন স্বচ্ছতা, সততা ও জবাবদিহিতা। আমাদের নেতৃস্থানীয়দের মাঝে এ গুণের বড় বেশি অভাব রয়েছে।
আমরা জানি, চরিত্র মানবজীবনে মুকুট। সত্য ও সততা চরিত্রের মৌলিক সোপান। আমরা এই মহামূল্যবান সত্যকে রাষ্ট্রীয় ভাবে এখনো ধারণ করতে পারি নি। তাই মিথ্যাচারের সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারছে না জাতি। অবিশ্বাস, স্বার্থপরতা, প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা, জাতীয়স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম, জাতির সাথে বারবার তামাশা, রাষ্ট্রের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি এসব দেখতে দেখতে জাতির বিশ্বাসে ঘুণ ধরছে। যুগের পর যুগ ফেরিয়েছে কিন্তু আমাদের সমাজনীতি,রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতিতে ধারাবাহিক আশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেনি। মিথ্যাচারের রাজনীতি আমাদের জাতিসত্তাকে চারদিক থেকে ঘিরে আছে। এই ভয়াবহ বলয় ছিন্ন করে বাঙ্গালি জাতিসত্তা নামক বৃক্ষটি স্বমহিমায় অতিকায় মহীরুহে বিকশিত হতে পারছে না। এ বাঁধন থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হলে সর্বপ্রথম মূলসমস্যার জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। আমাদের দেশে অনেক বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ সাদা চোখে যা কিছু দেখতে পায় তা অকপটে স্বীকার করতে পারে না। আমরা সাদাকে সাদা বলতে পারি না, কালোকে কালো বলতে পারি না। বরং যুক্তি দিয়ে মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করতে চাই আবার সত্যকে মিথ্যা বলে চালিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠি। উচ্চপর্যায়ে এসব দৃশ্য দেখে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সচেতন-অসচেতন সর্বমহলে ক্রমেই আদর্শহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। প্রভাবশালীদের আনুকূল্য লাভ করতে তথাকথিত সুবিধাভোগীরা এমন সমস্যার জন্ম দিয়ে থাকেন। যেই বিতর্ক জাতিকে আদর্শচ্যুত করে দ্বিধা-বিভক্তির পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। এমনটি জাতির জন্য কাম্য নয়। বুদ্ধিজীবী,সুশীলসমাজ ও রাজনীতিবিদগণ প্রকারান্তরে জাতির অভিভাবক। সুতরাং অভিভাবক সুলভ বক্তব্য, পর্যালোচনা ও নেতৃত্ব জাতিকে পদস্খলনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এক্ষেত্রে মূল্যবোধ ও নৈতিক গুণাবলীর আধিকারী হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন।
নৈতিকতা বিবর্জিত হলে অপরাপর যতোই যোগ্যতা থাকুক না কেন তার পক্ষে কখনো মানবিক সমাজ গড়ার আদর্শ স্থাপন করা সম্ভব নয়। আমরা জাতীয় জীবনে বহুসমস্যায় জর্জরিত। এসমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চাই। সমাজ থেকে অপরাধ নিরসন শুধু আইন দিয়ে সম্ভব নয়, স্থায়ীভাবে ফল ভোগ করতে নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের কোন বিকল্প নেই। রাষ্ট্রের সকল স্তরে যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন না করলে মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে পশুত্বকে লালন করতে থাকে। আর পশুত্বে তাড়নায় মানুষ ভালো-মন্দ মূল্যায়নের জ্ঞান বিকিয় ফেলে। চরম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শুধু ভোগের লক্ষ্যে ছুটতে থাকে। মানুষের অধিকার লঙ্ঘন করে নিজে বাড়ি-গাড়ি, বিত্ত-বৈভব, প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রভু সাজতে অদম্যমোহে ছুটে যায়। মানুষকে মানবিক করতে মানুষের মাঝে মানবীয় গুণাবলীর সমারোহ ঘটাতো হবে। স্বার্থের পেছনে ছুটে যাওয়ার প্রবণতা থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মানুষকে নিজের মতো করে ভালোবাসতে হবে। নিজের জীবনে চাওয়া- পাওয়া, সুখ- স্বাচ্ছন্দ্য প্রভৃতি তুচ্ছ করে দেখলে বস্তুবাদী হয়ে গড়ে উঠার আর কোন সুযোগ থাকে না। এক্ষেত্রে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিদেরকে সর্বাগ্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
নৈতিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন না করলে যেকোনো ব্যক্তি তার জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে নানান অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষবাণিজ্য, নারী কেলেঙ্কারি, হত্যা, ধর্ষণ,নারী ও শিশুপাচার, খাদ্যেভেজাল, মাদক সেবন ও মাদকবাণিজ্যসহ সবধরণের নীতিগর্হিত কাজে জড়িয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। লোভ লালসার বশবর্তী হয়ে অন্যের অধিকার কেড়ে নিতে এতটুকু কুণ্ঠিত হয় না। যুগেযুগে এটা পরীক্ষিত যে, ধর্মীয় ও নৈতিকতার বিপরীত স্রোতে যে জাতি বা জনগোষ্ঠী ধাবিত হয়েছে, সময়ের বিবর্তনে তারা মানবসভ্যতার ইতিহাস থেকে মুছে গেছে। আর টিকে থাকলেও চরম অসম্মান, হতাশা ও অভিশাপগ্রস্ত জীবনের গ্লানি বহন করতে হচ্ছে। যা গোটা মানবসভ্যতার জন্য বিপদসংকেত। মানুষের মাঝে মানবীয় গুণের সমাবেশ না ঘটলে মানুষে ও পশুতে আকৃতিগত পার্থক্য ছাড়া কোন প্রভেদ থাকে না। যখন মানুষের বিবেকের পতন ঘটে তখন বনের পশুর মতো পেশিশক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ন্যায়ের শাসনের অভাবে সমাজে পতন ধরে। এ পতন এক সময় পুরো জাতিকে গ্রাস করে। এর যাত্রা এতটা নীরবে ঘটে যে, বুঝে উঠতে সময় লেগে যায়। এই ধ্বংসের ক্ষতিকর প্রভাবে রাষ্ট্রের প্রতিটি অর্গান বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। এভাবে চলতে চলতে পচন ধরে যায় রাষ্ট্রের দেহে। সে পচন ছড়িয়ে পড়ে রাজনীতি,অর্থনীতি ও শিক্ষানীতিসহ সকল স্তরে।
রাজনীতিবিদগণ রাজনীতির মাধ্যমে দেশকে পরিচালনা করেন। রাজনৈতিক দর্শনের আলোকেই নির্ধারণ হয় জাতির আগামীর রাষ্ট্রনীতি, রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতেই নির্ধারণ হয়ে থাকে জাতির চূড়ান্ত ভাগ্য। সুতরাং কোন দেশে যদি সুস্থ ও শুদ্ধাচারের রাজনীতি না থাকে সে দেশে কখনো কাঙ্ক্ষিত মানের আদর্শিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে না। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সত্যের সন্ধান পায়, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝতে পারে। শিক্ষা মানুষকে সাম্যের চেতনায় গড়ে উঠতে পথ দেখায়। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ মনের পশুত্ব থেকে বের হয়ে আসতে পারে। শিক্ষার সাহায্যে হিংসা,পরশ্রীকাতরতা এবং লোভ লালসার মোহ থেকে মুক্ত থেকে ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত হতে শেখে। শিক্ষা আত্মার উদ্বোধন ঘটায়, হৃদয়ে দেশপ্রেম জাগায়,সবার উপরে মানুষ সত্য একথা বুঝতে শেখায়। শিক্ষা জাতিগড়ার হাতিয়ার।
আমরা এমন শিক্ষা চাই, মানবিক শিক্ষা জাতিকে সৎ নেতৃত্ব উপহার দেবে,দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গড়তে সাহায্য করবে। পরমতসহিষ্ণু ও পরমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখাবে। অপরিকল্পিত বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থা সু-দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের জাতিকে সঠিক লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে রেখেছে। যার ফলে জাতিগত ভাবে আমাদের নৈতিক অধপতন দিনে দিনে চরমে পৌঁছে যাচ্ছে। তবে তার আগে নিশ্চয় নৈতিক-মানবিক উন্নতি সাধন খুবই জরুরি। কারণ মানবিক উন্নয়ন হলো জাতীয় উন্নতির ফাউন্ডেশন। দুর্বলভিত্তির উপর কোন স্থাপনা তৈরি করলে তা শুধু ভেঙ্গে পড়ে ক্ষান্ত হয় না বহু জীবনেরও সমাধি রচনা করে। ভবন বা স্থাপনার দিক থেকে আমরা পিছিয়ে নেই। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর কথা বলতেই হয়। ইট পাথরের দেয়ালঘেরা সুরম্য বহুতল ভবন চারদিকে শোভাবর্ধন করছে। এই অতিকায় ভবনগুলো মাঝে টেকসই শিক্ষক,শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ ও যাবতীয় শিক্ষা উপকরণ সবই রয়েছে, নেই শুধু টেকসই শিক্ষা।
অতীত ইতিহাস থেকে জানা যায়, একসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছিল কাঁচা আর শিক্ষার মান ছিল পাকা। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে পাকা কিন্তু শিক্ষারমান যেন হয়ে যাচ্ছে কাঁচা। এখানে কোন রকম ভুল বুঝার অবকাশ নেই, আমি উন্নয়ন বিদ্বেষী নয়। উন্নয়ন যুগের দাবি। তবে উন্নতমানের শিক্ষা যুগের প্রয়োজনে নয় কি? তাহলে কেন আমরা যুগোপযোগী ও নৈতিকশিক্ষায় সমৃদ্ধ হতে পারছি না? তাহলে কী আমরা শুধু বাহ্যিক উন্নতিতে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছি? যদি তাই হয় এ বিশ্বাস থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। একথা নিঃসন্দেহে সত্য যে, জাতি প্রকৃত অর্থে মানুষ হতে হলে নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। তাই প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের জন্য নিজনিজ ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে সুশিক্ষা অর্জন শুরু হোক। তবেই আমাদের মানবিক উন্নয়ন ঘটবে। তারপর জাতীয় উন্নতির ভিত্তি মজবুত হবে।
প্রতিটি পরিবার থেকে আবার মানবিক শিক্ষার শুভসূচনা হোক। শৈশব থেকে আমাদের সন্তানদের মাঝে মহৎগুণাবলি জাগিয়ে তুলতে হবে। জীবনের সার্থকতা ঐশ্বর্যে নয় মনুষ্যত্বে। শিক্ষার সার্থকতা সার্টিফিকেট অর্জনে নয়, মানবিক জ্ঞানার্জনে, মানবতায়, সততায়, ত্যাগ ও তিতিক্ষায়। শিক্ষা অর্জন করার সার্থকতা কেবল ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়াতে নয়, একজন ভালো মানুষ হওয়ার মাঝে শিক্ষা অর্জনের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত। তাই আমাদের উচিৎ শৈশবকাল থেকে নিজের সন্তানের চরিত্রে মানবিক শিক্ষার বীজবপন করা। অতিরঞ্জিত অতিশ্বর্যের স্বপ্ন না দেখিয়ে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখানো। এই কাজ সমন্বিত ভাবে করতে পারলে অচিরেই সমাজ মানবিকতায় উদ্ভাসিত হবে। মানুষের জন্য মানুষের প্রাণ কাঁদবে। জীবন জীবনের জন্য মানুষ মানুষের জন্য এই মনোভাব নিয়ে প্রতিটি শিশু নিজের জীবনকে বিকশিত করে তুলবে। অসামাজিক, অমানবিক তথা মানবতা পরিপন্থী কাজ থেকে নৈতিকতার তাড়নায় তারা নিজেদের বিরত রাখতে শিখবে। তবেই সমাজে হানাহানিসহ সকল প্রকার নৈরাজ্য বন্ধ হবে। জাতীয় জীবনে সত্যিকারার্থে মানবতার শুভ উদ্বোধন হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, কবি ও প্রাবন্ধিক।