মাহমুদুল হাসান ও শুভর ১৫ মিনিট ১২ সেকেন্ডের একটি অডিও কথোপকথন ফেনীর সময় এর কাছে এসেছে
“মারা লাগবে না, চোখে রাঙ্গালে চলে যাবে। আমার তো হুজুর শুধু কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক কি, আমার সাথে ড. ইউনুসের সাথেও হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়”
নিজস্ব প্রতিনিধি :
অনিয়ম-দূর্নীতির দায়ে ফেনী আলিয়া কামিল মাদরাসা থেকে অধ্যক্ষ পদ থেকে সাময়িক বহিস্কার হওয়া মাহমুদুল হাসানকে ফেরাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সুবিধাভোগী মহল। এদের মধ্যে ফাঁস হওয়া এক অডিও কথোপকথনে উঠে আসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেনী জেলা কমিটি থেকে বহিস্কার হওয়া ওমর ফারুক শুভর নাম।
মাহমুদুল হাসান ও শুভর ১৫ মিনিট ১২ সেকেন্ডের একটি অডিও কথোপকথন ফেনীর সময় এর কাছে এসেছে। ওই কথোপকথনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুল কাদের ও হামজা মাহবুবের নাম ভাঙিয়ে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবী করে শুভ। একইসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী আজিজুর রহমান রিজভীর নাম ‘মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে উল্লেখ করেন শুভ।
কথোপকথনে ওমর ফারুক শুভ বলেন, “আমি বলি, কোন নারী, কোন মেয়ে- আপনি আমার ওস্তাদ মানুষ আমি আপনাকে কি বলবো, কোন মেয়ের গায়ে (শরীরে) নাকি আপনি হাত দিয়েছেন। এটা সেন্ট্রালে অভিযোগ জানানো হয়েছে। সেন্ট্রাল থেকে আমাকে বলা হয়েছে। আজকেও রিজভী ভাই ফোন দিয়েছে। বলছে, শুভ বিষয়টা যতটুকু দেখছো তোমাকে ডাকার পর, মিটিং এর পর তোমাকে আলাদা আব্দুল কাদের আর হামজা ভাই কি বলছে তুমি তো দেখছো? আমি বলছি, হ্যাঁ। ভাই আমি তো শুনছি। তুমি আব্দুল কাদের আর হামজা ভাইকে বলো আমরা একটা এমাউন্ট দিয়ে দিবো, এগুলা নিয়া ওরা বিভিন্ন জায়গায় মতবিনিময় সভা করবে যে, ওখানে ভাড়ার জন্য ব্যবহার করবে। আমি বলছি, ঠিকাছে। আজকেও আমাকে ফোন দিয়েছে, এজন্য আমি আপনাকে ফোন দিয়েছি। এখন আপনি বলেন, আমি কি আপনাকে গত ১ মাস কল দিয়েছি? দি নাই। আমার আগ্রহ ছিল না। এখন কেন দিয়েছি? তারা বলছে এজন্য দিয়েছি। এখন আপনি যদি বলেন, আপনি দিবেন, আপনার ইচ্ছা। আমি তো আর আমার পকেট থেকে দেওয়া সম্ভব না। আমি ১ হাজার, ২, ৪ ও ৫ হাজার টাকা দিতে পারবো। কিন্তু এক-দুই, পাঁচ লাখ টাকা তো আর আমার দেওয়া সম্ভব না। হুজুর, আমি একটা মানুষ, সাকিব (আলিয়া মাদরাসার ছাত্র) আমাকে দিতে চাইছে, এরপরও তো আমি নিই নাই। দেড় মাস আমি নিই নাই। কেন নিই নাই, কারণ বাড়ী থেকে যেটা দেয় সেটা দিয়ে আমি চলতে পারি।”
এর প্রেক্ষিতে মাহমুদুল হাসানকে বলতে শুনা যায়, “কিন্তু সাকিব তো এ কথাটা জানাইলো না আজ পর্যন্ত। আমি বুঝলাম না, সে তো এমন না। সে ১০ টাকা নিয়ে বাজার করে ৯ টাকা খরচ হলে বাকি ১ টাকা ফেরত দেয়। সে এরকম ছেলে। কিন্তু আমি একটা এমাউন্ট খরচের জন্য দিলাম, সে আমারে জানাইলো না।”
শুভকে বলতে শুনা যায়, “আপনি যাদের প্রিয় মনে করেন তারা আসলে প্রিয় না। আপনাকে আরো আপডেট জানাবো। বেশি দিন না, সামনের মাসের ১৫ (জানুয়ারি) তারিখের আগেই সেরে ফেলবো। আমি সব দিয়ে চেষ্টা করতেছি। আমি সরাসরি কাউন্টার দিচ্ছি। আমি আলিয়াতে নিয়মিত ক্লাস করবো। আপনিও আসবেন। কেও উুঁও করবে না কিছু করতে। উুঁ করলে বিড়ালের মত চলে যাবে। মারা লাগবে না, চোখে রাঙ্গালে চলে যাবে। আমার তো হুজুর শুধু কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক কি, আমার সাথে ড. ইউনুসের সাথেও হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়। আমি একজন সমন্বয়ক। সেন্ট্রালে লিড দিয়ে থাকি। উপদেষ্টাদের সাথেও আমার যোগাযোগ হয়। আর আপনাকে যেটা বলছি, ওটা করলে করিয়েন, না করলে আপনি আমাকে জানাই দিয়েন। কারণ আমি তাদের না করে দিতে হবে।”
মাহমুদুল হাসান অধ্যক্ষ পদ ফিরিয়ে পেতে কত টাকা লাগবে এমন প্রশ্নে শুভ বলেন, “হুজুর সে (রিজভী) আমারে বলে যে ৫। আমি বলি যে, আস্তাগফিরুল্লাহ। হুজুরের বেতন হলো ৩৫-৪০ হাজার। হুজুর এক বছরের বেতন দিলেও তো ৫ লাখ হবে না। হুজুর কিভাবে দিবে? হুজুর দুই মাস অফিসও করতে পারছে না। বেতনও বন্ধ। হুজুর- আমারে কল দিয়ে বলে যে ৫ লাখ নাও, হামজা-কাদেরকে পাঠাবো। আমি বলছি যে ৫ লাখ হবে না। এত টাকা হুজুর পাবে কই।”
অধ্যক্ষ সর্বশেষ কত লাগবে পুনরায় এমন প্রশ্ন করলে শুভ বলেন, “৩ লাখ লাগবে বলছে। বলছে, ৩ লাখে হবে। সে বলছে, এটা কাদের ভাই ও হামজা ভাইকে দিয়ে দিবো। তাহলে আপনার আর সমস্যা হবে না। আমি বলছি আমার ওস্তাদের সাথে দেখা হলে জানামু নে বিষয়টা। আমাকে আজকেও ফোন দিয়েছে, আমি ধরি নাই। হুজুর বুঝিয়েন, এরা সেন্ট্রাল সমন্বয়ক। আমি তো তাদের সাথে টকিং এ যেতে পারি না। হুজুর আমি হেদের কিছু বললে আমারে বহিষ্কার করে দিবে, তখন আমি কিছু করতে পারবো? কারণ এখন তাদের ক্ষমতা। আর আমারে যদি বহিষ্কার করে তাহলে আপনার প্রতি স্ট্রিমরোলার চলবে। আর সেন্ট্রালে যারা আছে তারা হচ্ছে জামায়াত সমর্থিত। আর আমাদের নাহিদ ভাই বিএনপি। নাহিদের বাবা মির্জা আব্বাসের সাথে ২৪নং ওয়ার্ডে যুবদল করে। নাহিদের বাবা জয়েন সেক্রেটারি, মির্জা আব্বাসের কর্মী। নাহিদের যে পিএস আছে সে সারাক্ষণ আমার সাথে যোগাযোগ করে। আমি আপনার জন্য নাহিদের সাথে সর্বোচ্চ লবিং করতেছি। আমি ওস্তাদ হিসেবে বলতেছি, আমার কোন চাওয়া-পাওয়া নাই। আপনি যদি ওনার সাথে কথা বলতে চান, তাহলে আপনারে উনার নাম্বার দিতে পারি।”
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হামজা মাহবুব ফেনীর সময়কে বলেন, “ফেনীতে আমার এবং কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুল কাদেরের নামে সমন্বয়ক পরিচয়ে বিভিন্ন মানুষজনের কাছ থেকে টাকা-পয়সা চাওয়ার বিষয়টি জেনেছি। আমার নাম ব্যবহার করে কেউ কোন বেআইনী কাজ করলে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোন ধরনের অনৈতিক কর্মকান্ডকে প্রশ্রয় দিবে না।”
আজিজুর রহমান রিজভী ফেনীর সময় কে বলেন, “ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতবিনিময় সভাকে কেন্দ্র করে ওমর ফারুক শুভসহ আরো অনেকের সাথে যোগাযোগ হয়। ওই মিটিং শেষে শুভর সাথে কোন মিটিং তো দূরে থাক, দেখাও হয়নি। জেলা কমিটিতে তার জন্য সুপারিশ করতে বিভিন্নসময় কল করতো। আমাকে জড়িয়ে কোন ফিন্যান্সিয়াল ট্রান্সজেকশন ও আবদার নিয়ে আলোচনা করে তাহলে সেটার দায়ভার একান্তই শুভর। ইতিমধ্যে বিষয়টি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় আহবায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহকে জানিয়েছি। তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।”
প্রসঙ্গত: এর আগে চলতি বছরের আগস্টে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নীতি ও শৃঙ্খলা বিরোধী কার্যক্রমে জড়িত থাকায় শুভকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ফেনী জেলার সহ-সমন্বয়ক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপরও বিভিন্ন কর্মসূচী ও আচার-অনুষ্ঠানে ‘সমন্বয়ক’ পরিচয় দিয়ে বেড়ায় শুভ।
এদিকে ফেনী আলিয়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মাহমুদুল হাসানের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের সত্যতা মিলেছে। এর আগে গত ৩ অক্টোবর ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী অধ্যক্ষ পদ থেকে মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
অবশ্য মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে কথোপকথনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ওমর ফারুক শুভ। তার দাবী, “গত দুই মাসেও মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে কথা হয়নি। উনি হয়ত (মাহমুদুল হাসান) মনগড়া এসব প্রচার করছেন।”