এম. মাঈন উদ্দিন :
চিনি, মাদক সহ বিভিন্ন অবৈধ পন্য ভারত থেকে বাংলাদেশের নিরাপদ পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহত হচ্ছে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার আমলীঘাট মেরকুম সীমান্ত এলাকা। এই রুট দিয়ে প্রায় সময় চোরাই পথে এসব পন্য দেশে নিয়ে আসছেন চোরকারবারিা। দুদেশের সীমান্ত রক্ষাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে শত শত বস্তা চিনি আনা হচ্ছে। পাচার কাজে শ্রমিক হিসেবে স্থানীয় যুবকদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অর্থলোভে পড়ে তারাও এ কাজের সাথে জড়ি হয়েছে। এসব চিনি স্থানীয় বাজার ছাড়াও সরবরাহ করা হচ্ছে চট্টগ্রাম ও ফেনী শহরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি ৩ টন চিনি সহ দুই ব্যক্তিকে আটক করেছে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ। চলতি জুন মাসে ৬৫ বস্তা চিনি জব্দ করেছে বিজিবি। সর্বশেষ চিনি পাচারের সময় সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর ধাওয়া খেয়ে ফেনী নদীর পানিতে ডুবে মারা গেছে জাহেদুল ইসলাম (১৭) নামের এক কিশোর। শ্রবণপ্রতিবন্ধী জাহেদুল মিরসরাইয়ের করেরহাট ইউনিয়নের পূর্ব অলিনগর গ্রামের মো. ফারুক ইসলামের ছেলে। মঙ্গলবার (২৫ জুন) ভোর সাড়ে ৬টায় তার মরদেহ নদীতে ভেসে উঠে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মিরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের ফেনী নদীর আমলীঘাট মেরকুম সীমান্ত এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।
আমলীঘাট এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চোরকারবারিরা করেরহাট ইউনিয়নের আমলীঘাট এলাকার মেরকুমকে চিনি সহ বিভিন্ন পন্য চোরাচালানের রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে। একাজে জড়িত রয়েছে এপার ওপাররের বিশাল দুটি সিন্ডিকেট। পাচারের জন্য ভারতীয় পাহাড়ি এলাকায় সুড়ঙ্গ করা হয়েছে। সুড়ঙ্গ দিয়ে ভারতীয় পাচারকারীদের যোগসাযশে চিনিগুলো বাংলাদেশে পাচার করা হয়। চিনি পাচারে ব্যবহার করা হয় স্থানীয়দের। রাত ৮টা থেকে পাচার কাজ শুরু হয়। এসময় কয়েকশ শ্রমিক সুড়ঙ্গ পথে চিনির বস্তাগুলো এনে নৌকায় ভর্তি করেন। প্রতি বস্তা চিনি পারাপারে মজুরী দেওয়া হয় ২শ টাকা করে। একজন কমপক্ষে ৩ থেকে ৬ বস্তা চিনি আনতে পারে। এরপর ওই রাতের মধ্যেই নৌকা থেকে নামিয়ে পিকআপ যোগে চট্টগ্রাম, ফেনী শহর সহ বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়।
স্থানীয়রা জানান, রবিবার রাত ১০টার দিকে প্রায় দুই শতাধিক লোক ভারত সীমান্ত থেকে মাথায় বয়ে আনছিল ভারতীয় চোরাই চিনি। সীমান্তের নো ম্যানস্ ল্যান্ড এলাকায় হঠাৎ ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) এর উপস্থিত হলে একজন বাদে বাকি সবাই পালিয়ে নৌকায় উঠতে সক্ষম হয়।
এদিকে নিহত জাহেদুল ইসলামের চাচা নজরুল ইসলাম দাবি করেন, ‘এলাকার কিছু চিনি চোরাকারবারী টাকার প্রলোভন দেখিয়ে আমার ভাতিজা জাহেদুলসহ আরও অনেক কিশোরকে চিনির বস্তা বহনে ব্যবহার করতো। ওই রাতেও করেরহাট ইউনিয়নের বদ্ধভবানী এলাকার মফিজুল তাকে সীমান্তের ওপারে (ভারত) নিয়ে যায়। পরে বিএসএফ আসলে সবাই পালিয়ে গেলেও আমার ভাতিজা ফিরতে পারেনি।’
এ বিষয়ে চিনি চোরাকারবারী সিন্ডিকেটের সদস্য মফিজুলের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে মফিজুল বলেন, ‘ওই রাতে আমার কোন কাজ ছিলো না। করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম অলিনগর গ্রামের জামাল মাঝি ও তার ভাই রাইফুল জাহেদুলকে এ কাজে নিয়ে যায়।’ চিনি চোরাকারবারীর সঙ্গে যুক্ত কিনা জানতে চাইলে মফিজুল বলেন, ‘আগে এগুলো করতাম, এখন আর করি না।’
পরবর্তীতে মফিজুলের কাছ থেকে পাওয়া জামাল মাঝি ও তার ভাই রাইফুলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলতে চাইলে রাইফুলের ফোনে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে জামাল মাঝি বলেন, ‘আমি হলাম মাঝি, আমার কাজ হলো লোকজন সংগ্রহ করে দেয়া। আমি মফিজুলকে লোকবল সংগ্রহ করে দেই।’ এসময় জামাল মাঝির কাছে চিনিচোরা কারবারীদের তথ্য জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এখানে বড় কোন মাথা নেই। এলাকার প্রায় ৩০ জনের মতো লোক ভারত থেকে সীমান্ত পার করে চিনি নিয়ে আসেন।’
এদিকে একাধিক বাসিন্দা নিজেদের নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘করেরহাট ইউনিয়নের আমলীঘাট মেরকুম সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন হাজারো বস্তা চিনি চোরাই পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আবার চিনির বস্তার ভেতর অনেক সময় ভারতীয় মদ এবং ফেনসিডিল ও শাড়ী আনা হয়। এ কাজে এলাকার উঠতি বয়সি ছেলেদের প্রতি বস্তায় ২’শ টাকা হারে দেয়া হয়। এতে প্রতিজন প্রতিদিন প্রায় ১৫’শ টাকারও বেশি রোজগার করে।’
চিনি পাচারের কাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করা সাইফুল ইসলাম জানান, আমরা পেটেয়ে দায়ে চিনি পাচারে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে থাকি। ওরা পাচার না করলেও তো আমরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতাম না। এ কাজ করে প্রায় ২ থেকে ৩শ মানুষের পরিবার চলে।’
এ ঘটনায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর অলিনগর বিওপি কমান্ডের নায়েব সুবেদার খোরশেদ আলম বলেন, আমরা সব সময় সীমান্তে পাহারায় রয়েছি। স্থানীয়রা অনেক কথা বলে। আমরা চলতি মাসে ৬৫ বস্তা চিনি জব্দ করেছি।’