fenirshomoy logo black

লোকমান বিএসসি :

আলী আজম স্কুল এন্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফল । ১৫৩ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে সকল বিষয়ে মাত্র ৭ জন পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ নির্বাচনী পরীক্ষার এই ফলাফল তাদের অনলাইনে প্রকাশ করেন। ফলাফল নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয় এবং ফেসবুক এ এটি মোটামুটি ভাইরাল হয়। সবাই যার যার মতো করে তাদের মতামত তুলে ধরেন। কোন বিষয়ে মত প্রকাশ করার অধিকার সবার রয়েছে এবং এগুলো তাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত।

নির্বাচনী পরীক্ষার এই ফলাফলকে অনেকেই ফলাফল বিপর্যয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এটিও তাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত। আমার কথা হলো, আসলেই কি আলী আজম স্কুল এন্ড কলেজের নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে? ভাববার আছে।

আমার মতে এটি কোনোভাবেই ফলাফল বিপর্যয় নয়। এটি মাত্র একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফল। যদি উপজেলার ৮/১০ টি কলেজের ফলাফল তুলে ধরা হতো এবং তার তুলনায় এটি খারাপ হতো তবেই আলী আজম এন্ড কলেজের এই ফলাফলকে বিপর্যয় বলা যেতে পারে। কেননা অন্য কোন কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফল অনলাইনে প্রকাশ করেননি। আলী আজম স্কুল এন্ড কলেজের পাশেই রয়েছে একটি ডিগ্রী প্রতিষ্ঠান । তারা করেছে কিনা? তাই বলা যেতে পারে এ ফলাফল অত্যন্ত খারাপ বা একেবারে বাজে ফলাফল কিন্তু বিপর্যয় বলা যায় কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আপনারা খোঁজ নিলে জানতে পারবেন দেশে এমনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে একজন শিক্ষার্থীও পাবলিক পরীক্ষায় পাস করেনি। কিংবা এমনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পাবেন যাদের শিক্ষার্থীরা টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করলেও তাদেরকে টেলিফোন করে বাড়ি থেকে এনে ফরম ফিলাপ করানো হয়। বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে মফস্বল এলাকার প্রায় বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই অবস্থাই এরকম। ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে। একজন শিক্ষার্থী দৈনিক ২৪ ঘন্টার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৬ ঘণ্টা অবস্থান করে। বাকি ১৮ ঘন্টা সে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকে। শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দায়িত্ব থাকে সবচেয়ে বেশি। এজন্য সব দায় শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দেয়া উচিত হবে না। বর্তমানে শিক্ষার্থী পিটালে শিক্ষককে কৈফিয়ত দিতে হয় কিন্তু শিক্ষক পিটালে শিক্ষার্থীকে কৈফিয়ৎ দিতে হয় না। আমি একজন শিক্ষক হিসেবে বলছি না আমি একজন অভিভাবকও বটে। আমি বাস্তব দুটি ঘটনা এখানে তুলে ধরছি।

১. দিদারুল আলম মজুমদার। আমাদের মাদ্রাসার একজন শিক্ষার্থী। দাখিল পরীক্ষায় সে স্টারমার্ক নিয়ে পাশ করে। (তখন জিপিএস সিস্টেম চালু ছিল না) ভর্তি হয় ফুল গাজী সরকারি কলেজে। আমি তাকে বললাম, কেন সে ফেনী সরকারি কলেজে ভর্তি না হয়ে ফুলগাজীতে ভর্তি হলো। সে আমাকে বলল, স্যার, ফুলগাজী আমার জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী। এখানে যাতায়াতে আমার খরচ কম। সবচেয়ে বড় কথা হলো স্যার, পড়াশোনা আমার নিজের কাছে।পড়াশোনা ভালো করলে যেকোনো জায়গা থেকে আমি ভালো ফলাফল অর্জন করতে পারি। হলোও তাই । ফুলগাজী সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে যেখানে দ্বিতীয় শ্রেণি অর্জন করতে পারেনি বিগত কয়েক বছরে। সেখান থেকে সে প্রথম শ্রেণীতে পাস করে। এবং রসায়ন বিভাগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। অনার্স মাস্টার্সে সে খুব ভালো ফলাফল করে। পরবর্তীতে ফৌজদারহাট ক্যাডেট ক্যাম্পাস ইংলিশ স্কুল এন্ড কলেজে রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে। বর্তমানে সে ওই কলেজের সহকারী অধ্যাপক। টেলিফোনে এই খবরটি সে আমাকে জানায়। আল্লাহ তাকে নেক হায়াত দান করুন। আমার মাদ্রাসার অপর দুজন শিক্ষার্থী। যারা সহোদর। প্রাইভেট পড়ে ঠিকমতো প্রাইভেটের ফি গুলো দিতে পারিনি। বর্তমানে তারা উভয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আল্লাহ তাদেরকে কামিয়াবী দান করুক। আলী আজম স্কুল এন্ড কলেজে ইমরান ইমনের কথাই ধরা যাক। এসএসসিতে তার এ প্লাস ছিল না। এইচএসসি আলী অর্জুন স্কুল এন্ড কলেজেই পড়েছে কিন্তু বর্তমানে সে একজন আন্তর্জাতিক মানের কলামিস্ট। সে আমার গ্রামেরই গর্বিত সন্তান।

২. 2018 কি 2019 সাল হবে। আমি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল সংগ্রহের জন্য ফুলগাজী সরকারি কলেজে যাই। তখন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন শ্রদ্ধেয় ইব্রাহিম স্যার। স্যার আমার হাতে ফলাফলের একটি কপি দিলেন। আমি পড়ে দেখে স্যারকে বললাম। স্যার, ফলাফল তো একেবারেই খারাপ। স্যার আমাকে বলল, আমাকে কি কাঁচামাল দিয়েছেন যে আপনি ভালো প্রোডাক্ট আশা করেন! আমার এখানে জিপিএ এক এর ঊর্ধ্বে শিক্ষার্থী নেই। আমি অনেকক্ষণ নীরব হয়ে ছিলাম। সেবার আমি ফলাফলের কোন রিপোর্টই করতে পারিনি। তাহলে ভাবুন তো আলী আজম স্কুল এন্ড কলেজে যারা ভর্তি হয়েছে তাদের মধ্যে a+ ধারি কয়জন আছে, এ কয়জন আছে, এ মাইনাস কয়জন আছে, বি কয়জন আছে সি কয়জন আছে এবং ডি কয়জন আছে? কিংবা বিসিএস ক্যাডার শিক্ষক কয়জন আছে? তবুও সবার দায় আছে। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আছে। শিক্ষকের আন্তরিকতার অভাব আছে । শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ঘাটতি আছে। অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব আছে। কিন্তু আমার অনেক কিছুই নেই তা নিয়ে আফসোস না করে আমার যা কিছু আছে তাই দিয়ে চেষ্টা করে যেতে হবে। সফলতার মালিক একমাত্র আল্লাহ। আমি মনে করি নির্বাচনী পরীক্ষার এই ফলাফল শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সতর্কতা সংকেত। শিক্ষার্থীরা যাতে পড়াশোনায় মনোযোগী হয় তারা যাতে না ভাবে যে ভবিষ্যতে তারা এমনি এমনিতেই পাশ করে ফেলবে তাহলে এটি তাদের ভুল ধারণা। যদি কলেজের শিক্ষকগণ 153 জন শিক্ষার্থীর মধ্যে 150 জনকেই পাস দেখিয়ে দিতেন তাহলে কি এটি খুব ভালো ফলাফল হতো? মোটেই না। এই ফলাফলে অন্তত শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী হবে এটাই আমার বিশ্বাস। অভিভাবকরা আরো বেশি সচেতন হবেন, ঘটনাটি যেভাবে মানুষের মুখে মুখে যেভাবে রটেছে সেজন্য শিক্ষকেরা আরো বেশি মনোযোগী হয়ে শিক্ষার্থীদেরকে পাঠদান করাবেন এবং কলেজ কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। পরিশেষে আলী আজমের উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষার্থী ও এলাকার একজন হিসাবে বলব, আলী আজম স্কুল এন্ড কলেজ ও মুন্সিরহাট ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রী মাদ্রাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুটি এই এলাকার ঐতিহ্যবাহি প্রতিষ্ঠান। এই এলাকার মানুষের শ্রমে- ঘামে-অর্থে এ দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠিত । কোন ব্যক্তি বা কোনো মহল দ্বারা (হোক সেটা প্রতিষ্ঠানের ভিতরের লোক কিংবা বাইরের লোক) এই দুটি প্রতিষ্ঠানের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেই দিকে এলাকাবাসীর সচেষ্ট থাকা উচিত। উল্লেখ্য ফুলগাজী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ মুন্সীরহাট আলী আজম স্কুল এন্ড কলেজে দ্বাদশ শ্রেণির টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ১৫৩ পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৭জন উত্তীর্ণ হয়েছে। অনলাইনে মুন্সীরহাট আলী আজম স্কুল এন্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির টেস্ট পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ১ বিষয়ে অকৃতকার্য ২ জন, ২ বিষয়ে ৫ জন ও ৩ বিষয়ে ৮ জন।মানবিক বিভাগে ১ বিষয়ে ২১ জন ২ বিষয়ে ১২ জন ও ৩ বিষয়ে ৯ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে। সর্বমোট ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগের ৫৬ জন শিক্ষার্থী এক থেকে তিন বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে। সকল বিষয়ে পাস করেছে ৭ জন। অর্থাৎ ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের জন্য ১ থেকে ৩ বিষয় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের তালিকা করা হলে ৬৩ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে পারবে। মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেছে ১৫৩ জন। সকল বিষয়ে ফেল বা অকৃতকার্য হয়েছে ৯০ জন। দ্বাদশ শ্রেণিতে সকল বিভাগের মোট শিক্ষার্থী ২৬৪ জন। তন্মধ্যে ১৫৩ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে।

কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে কলেজে ভর্তি হয় ২৬৪ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে মানবিক বিভাগে ১৫০ জন ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ১১৪ জন। প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে ১৯৬ জন ও নির্বাচনী (টেষ্ট) পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে ১৫৩ জন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!